সালটা সঠিক মনে নেই, ১৯৯১ বা ‘৯২ সাল হবে। আমার বাবাকে বিএনপি’র দুঃশাসনামলে চাকরি থেকে বরখাস্ত করার পর আমি পোগলদিঘা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে এসে ভর্তি হই। বিদ্যালয়ের দুইটা ভবনেরই টিনের চালা ছিল। সেই টিনের চালায় বড় বড় করে লিখা ছিল “সাজা ভাইকে নৌকা মার্কায় ভোট দিন”। লেখার মাঝে বিশাল বড় সাইজের নৌকাও আঁকা ছিল। এখনও চোখ বন্ধ করলে সেই টিনের চালা, লেখা আর নৌকার ছবি চোখে ভাসে। শৈশবে সেটাই মনে হয় প্রথম ‘নৌকা’ প্রতীক, ‘ভোট’ শব্দগুলোর সাথে আমার পরিচয়, সেইসাথে আরেকটা নামের সাথে পরিচয় হয় ‘সাজা’। বাড়িতে ফিরে আমার বাবার কাছে জানতে চাই ‘সাজা’ কে? আব্বা বলেন, “তোমার মতিয়র রহমান তালুকদার চাচার ডাক নামই সাজা।”
অ্যাডভোকেট মতিয়র রহমান তালুকদার আমাদের পরিবারে খুব পরিচিত একটা নাম। আমি বা ছোট ভাই এর বয়স তখন খুবই কম হলেও আমরাও এই নামের সাথে পরিচিত ছিলাম। উনি ছিলেন আমাদের কাছে একটা আদর্শিক নাম। আমার বাবার মুখে সবসময় শুনে এসেছি “অ্যাডভোকেট মতিয়র রহমান তালুকদার আমার রাজনৈতিক গুরু।” যদিও আমার বাবা কর্মজীবনে একজন সরকারি আমলা ছিলেন তাই সক্রিয়ভাবে রাজনীতি না করেন নাই, তবে ছাত্রজীবনে রাজনীতি করেছেন সেইসূত্রে সবসময় চাচাকে তিনি গুরুই মানতেন। ছোটবেলা থেকেই আমরা দেখছি আমাদের পরিবারে কোন সমস্যা হলে বা কোন বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হলে আব্বা চাচার সাথে বুদ্ধি-পরামর্শ করতেন। ছোট বয়সের আমি সে সময় বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ বা নৌকা বলতে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, তার কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা আর মতিয়র রহমান তালুকদারকেই বুঝতাম।
মতিয়র রহমান চাচাকে আমি সামনাসামনি প্রথম কবে দেখেছিলাম তা আর এতবছর পরে মনে পড়ছে না, সম্ভবত আমাদের বাড়িতেই। চাচা যতদিন সুস্থ ছিলেন আমরা সব সময় দেখেছি ঈদের পরদিন উনি আমাদের বাড়িতে আসতেন। মূলত, উনি উনার নিজ পৈতৃকবাড়ি দৌলতপুর গ্রামে যেতেন, দৌলতপুরের ঠিক একটা গ্রাম আগেই আমাদের গ্রাম তাই যাওয়ার সময় আমার বাবার সাথে দেখা করে যেতেন। ঈদ ছাড়াও অন্য সময়ও যখনি উনি দৌলতপুর যেতেন আমাদের বাড়িতে নামতেনই। এমনও হয়েছে ঈদের পরদিন আমাদের বাড়ির সামনে কোন গাড়ির হর্ন বা দরজায় টোকা দিলেও আমরা না দেখেই আব্বাকে বলতাম “আব্বা মতিয়র রহমান চাচা এসেছেন।”
যতদিন উনি চলাফেরা করার মত অবস্থায় ছিলেন উনি আমাদের ঘরে এসে বসতেন। জীবনের শেষের দিকে এসে উনার চলাফেরা করায় কষ্ট হতো তখন উনি গাড়িতে বসে থেকে ড্রাইভারকে পাঠাতেন আব্বা খবর দিতে। আমাদের বাড়ি রাস্তা থেকে বেশ নিচুতে হওয়ায় সিঁড়ি দিয়ে নামতে হয়, যা উনার জন্য কষ্টকর হতো তাই আমার বাবা গিয়ে উনার সাথে দেখা করে আসতেন।
উনাকে নিয়ে আমার শৈশবের দেখা একটা ছবি এখনও জ্বলজ্বল করে। ‘৯২/৯৩ সালের কোন একটা ঈদের সময় আমরা ভাই-বোন সবাই আব্বা-আম্মাসহ জামালপুর শহরে গিয়েছিলাম ঈদের কেনাকাটা করতে। সে সময় তো যাতায়াতের জন্য এতো ভালো রাস্তা-ঘাটও ছিল না কিংবা যানবাহনও ছিল না। আমাদের সরিষাবাড়ীর মানুষজনকে ওই সময় জামালপুর, ময়মনসিংহ বা ঢাকায় যাতায়াতের জন্য ট্রেনের উপরই নির্ভর করতে হতো। ঈদের কেনাকাটা শেষ করে আমরা জামালপুর রেলস্টেশনে রাতের ট্রেনের জন্য অপেক্ষা করছিলাম। সেই সময় হঠাৎ করে বিদ্যুৎবেগে দুনিয়া কাঁপিয়ে “জয় বাংলা”, “জয় বঙ্গবন্ধু” স্লোগান নিয়ে একটা মিছিল পুরো রেলস্টেশন প্রদক্ষিণ করে। “জয় বাংলা” স্লোগান শুনে আমরা যথারীতি উদ্বেলিত। সেই মিছিলের পুরোধা ছিলেন একজন দৃঢ়চেতা বলিষ্ঠব্যক্তিত্ব অ্যাডভোকেট মতিয়র রহমান তালুকদার। 
আরেকটা বিষয় এখানে উল্লেখ করি, সেই শৈশবকাল থেকেই আমরা আব্বার মুখে উনার গল্প জানতাম ‘উনি খুব রাগী, রাসভারি এবং সৎ মানুষ। সততার সাথে, ন্যায়পরায়ণতার সাথে উনি কখনও আপোস করেন নাই।’
আস্তে আস্তে প্রাথমিক বিদ্যালয়, মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের গণ্ডি ছাড়িয়ে কলেজে ভর্তি হলাম। আমাদের শৈশব-কৈশোর বা টিনএজ আমরা পার করেছি সরিষাবাড়ীর সালাম তালুকদার ও তার জ্ঞাতি-গোষ্ঠির দুর্দান্ত প্রভাব, প্রতিপত্তি আর রোষের গল্প শুনে।
 
ব্যক্তিগতভাবে আমার পরিবার যেহেতু রোষের শিকার ছিল তাই ওই বয়স থেকেই রাজনীতি মাথায় ঢুকতে শুরু করেছিল। তাছাড়া, জন্ম থেকেই তো বড় হয়েছি “জয় বাংলা” স্লোগান শুনে আর ঘরে টানানো বঙ্গবন্ধু আর আপার (মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুকন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা’র) ছবি দেখে। আমার কলেজজীবন থেকে রাজনীতি সচেতনতা শুরু হয় আমার। সেই সময় বাড়িতে যে পত্রিকা রাখে হতো সেই পত্রিকা আর কলেজ লাইব্রেরির বিশাল সমৃদ্ধ ভান্ডার ছিল আমার জ্ঞান আহরণের প্রধান উৎস। মূলত কলেজে উঠার পর থেকেই রাজনীতি এবং রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বদের সম্পর্কের জানার আগ্রহ তৈরি হয়। কলেজ পেরিয়ে মেডিক্যালে পড়তে ব্যর্থ হয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এ ভর্তি হলাম। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের সাথে সাথে শুরু হলো আরেকটা নতুন জীবন, আমি সক্রিয়ভাবে ছাত্র রাজনীতির সাথে যুক্ত হলাম। ২০০২ সাল থেকে রাজনীতিতে সম্পৃক্ত হওয়ার পর জাতীয় রাজনীতির পাশাপাশি জানতে চেষ্টা করেছি আমার নিজ জেলাসহ বৃহত্তর ময়মনসিংহ অঞ্চলের রাজনীতি এবং রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে জানতে। 
বৃহত্তর ময়মনসিংহের প্রবীণ রাজনীতিবিদ, রাজনৈতিক গবেষক ও শিক্ষাবিদসহ নানা ক্ষেত্রে যারা আলোকিত ও আলোচিত মানুষ তাদের সাথে কথা বলে, তাদের বক্তৃতা শুনে কিংবা লিখা পড়ে অ্যাডভোকেট মতিয়র রহমান তালুকদার সম্পর্কে যতটুকু জেনেছি- সবাই একটা ক্ষেত্রে একবাক্যে একমত হয়েছেন তা হলো “তিনি দেশপ্রেমিক, কর্তব্যপরায়ণ, ন্যায়পরায়ণ, সৎ ও বিচক্ষণ রাজনীতিবিদ ছিলেন।”
তার যিনি ঘোর শত্রু তিনিও তার সততা বা ন্যায়পরায়ণতার দিকে আঙ্গুল তোলার সাহস করবেন না। ক্ষমতার লোভ কিংবা আত্মস্বার্থের কাছে কখনও মাথা নত করেন নাই তিনি। দেশের জন্য, দলের জন্য, বঙ্গবন্ধু ও জননেত্রী শেখ হাসিনার জন্য তিনি জেল-জুলুম নির্যাতন সহ্য করেছেন। দেশের ও দলের দুর্দিনে মানুষের পাশে, নেতা-কর্মী, সমর্থকের পাশে দাঁড়িয়েছেন।
তার রাজনৈতিক জীবনের একটা অন্যতম অধ্যায় (১৯৫৬-৫৯)সাল। এই সময় তিনি সরকারি আশেক মাহমুদ কলেজ ছাত্র সংসদের ভি.পি ছিলেন। ১৯৫৮ সালে পাকিস্তানের সামরিক শাসক আইয়ুব খান সামরিক শাসন জারি করলে এবং রাজনীতি নিষিদ্ধ করলে পূর্ব পাকিস্তান তথা বাংলায় ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। এই উত্তাল সময়ে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন, ১৯৫৯ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যায়নকালেই তিনি বঙ্গবন্ধু’র সাহচার্য লাভ করেন এবং বঙ্গবন্ধু’র আদর্শে উজ্জীবিত হয়ে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে সক্রিয় হন।
তার বাবা ছিলেন বিত্তবান। বিত্ত-বৈভবের মধ্যে বড় হলেও তার মন পড়ে থাকত অল্পশিক্ষিত, অসহায়, দরিদ্র মানুষের কাছে। অসহায়-নিপীড়িত মানুষকে আইনী সহায়তা করে পাশে দাঁড়ানোর অভিপ্রায় থেকেই আইনজীবী হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন এবং অতি অল্প সময়ের মধ্যেই তিনি একজন সফল আইনজীবী হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন।
আমাদের মুক্তি সংগ্রামের প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক যেমন ‘৬৬ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালির মুক্তির সনদ ঐতিহাসিক ৬ দফা পেশ করার পর বঙ্গবন্ধু’র বিরুদ্ধে পাকিস্তানের সামরিক সরকার নানা ষড়যন্ত্র করতে থাকে। এরই ধারাবাহিকতায় ‘৬৮ সালের আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা দিয়ে বঙ্গবন্ধু’র বিরুদ্ধে প্রহসনের বিচার শুরু হলে পূর্ব পাকিস্তান তথা সারা বাংলা ফুঁসে ওঠে। বঙ্গবন্ধু’র মুক্তির দাবিতে ‘৬৯ সালে দেশব্যাপী আন্দোলন ছড়িয়ে পরলে সেই আন্দোলনের উত্তাপ সারাদেশের মত জামালপুর মহকুমায় এসেও লাগে। সে সময় অ্যাডভোকেট মতিয়র রহমান তালুকদার আইন পেশা স্থগিত রেখে সেই আন্দোলনের সাথে একাত্ম হয়ে বঙ্গবন্ধু’র মুক্তির আন্দোলনকে আরও বেগবান করেন। জামালপুর মহকুমায় ‘সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ’ গঠন করেন এবং নিজে সেই পরিষদের আহ্বায়ক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
এরপর আসে আমাদের মুক্তি সংগ্রামের সেই মাহেন্দ্রক্ষণ ৭ই মার্চের রেসকোর্স ময়দানের সেই ঐতিহাসিক ভাষণ। আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রাম পরিচালনার যাবতীয় দিক-নির্দেশনা ঐ দিনই ঘোষণা করা হয়, বঙ্গবন্ধু সেদিন মূলত অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেন। অসহযোগ আন্দোলনের ডাকে সাড়া দিয়ে অ্যাডভোকেট মতিয়র রহমান তালুকদার জামালপুর মহকুমার সাধারণ জনগণকে সংগঠিত করে মুক্তিযুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি নিতে থাকেন। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ কালরাতের পর তিনি জামালপুরের মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠিত করেন। তিনি শুধু মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠিতই করেন নাই, নিজেও মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। তিনি একাধারে বীর মুক্তিযাদ্ধা ছিলেন এবং মুক্তিযুদ্ধকালীন ‘মুজিবনগর সরকার’ এর অধীন উত্তর রণাঙ্গনের ১১ নম্বর সেক্টরের সদরদপ্তর কামালপুর, মহেন্দ্রগঞ্জে অত্যন্ত বিচক্ষণতার সঙ্গে বিচারকের দায়িত্ব পালন করেন।
স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু’র নেতৃত্বে দেশ পুর্নগঠনেও তিনি জামালপুরে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন।
এরপর নেমে আসে বাঙালির জীবনে এক অমানিশার কালো অন্ধকার অধ্যায়। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির পিতাকে সপরিবারে হত্যা করা হয়। জাতির সেই ক্রান্তিকালে যারা বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার প্রতিবাদে বিক্ষোভ করেছিলেন তাদের মধ্যে অ্যাডভোকেট মতিয়র রহমান তালুকদারও ছিলেন। দেশব্যাপী খুনীদের পরিচালিত সরকার দমন-পীড়ন শুরু করে, গ্রেফতার করা হয় প্রতিবাদী সাহসী সন্তানদের। 
কারাগারে তাদের উপর নেমে আসে অমানবিক নির্যাতন। বঙ্গবন্ধু’র আদর্শ থেকে সরে আসতে নানা ধরনের নির্যাতন ও চাপ প্রয়োগ করা হয়। কিন্তু খুনীদের রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে ও দমন-পীড়নকে দাঁতে দাঁত চেপে সহ্য করে নিজেদের অবস্থান ও আদর্শে অটল থাকেন তারা। 
অ্যাডভোকেট মতিয়র রহমান তালুকদার মুক্তিযুদ্ধকে সংগঠিত করার পাশাপাশি বাংলাদেশ আওয়ামী লীগকেও সংগঠিত করতে ভূমিকা রেখেছেন। ‘৭৫ পরবর্তী বৈরী পরিস্থিতি মোকাবিলা করে নেতা-কর্মীদের সাহসী করেছেন। সেই কঠিন সময়ে ১৯৭৭ সালে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের একাদশ সম্মেলনে সৈয়দা জোহরা তাজউদ্দীন দলের আহ্বায়ক হয়ে দল গোছানোর দায়িত্ব নেন। জামালপুর জেলা শাখার সভাপতি নির্বাচিত হন অ্যাডভোকেট মতিয়র রহমান তালুকদার। ১৯৭৭ থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত জামালপুর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন তিনি। এছাড়াও পরপর তিনবার তিনি বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য হিসেবে নিষ্ঠার সাথে দায়িত্ব পালন করেন।
নেতৃত্বের প্রদানের ক্ষেত্রে তার বিচরণ ছিল নানা সেক্টরে। তিনি জামালপুর জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি ছিলেন ছয়বার এবং জাতীয় আইনজীবী সমিতির সহ-সভাপতি ছিলেন। তার নিজ জেলা পিছিয়ে পড়া জনপথ জামালপুরে তিনি ল’ কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন এবং অধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করেন। জনকল্যাণেও তার ভূমিকা ছিল উল্লেখ করার মত। দরিদ্র মানুষের জন্য তিনি আজীবন কাজ করে গেছেন। দুঃস্থ-অসহায় মানুষকে সেবা দেয়ার জন্য তিনি জামালপুর অন্ধকল্যাণ সমিতি প্রতিষ্ঠা করেন এবং সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। এছাড়াও বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি জামালপুর জেলা শাখার সভাপতির দায়িত্ব নিয়ে তিনি মানুষের সেবা করেছেন।
বৃহত্তর ময়মনসিংহ অঞ্চলের মানুষের যোগাযোগের জন্য ‘তারাকান্দি থেকে বঙ্গবন্ধু সেতু’ পর্যন্ত যে রেল যোগাযোগ চালু রয়েছে এটির স্বপ্নদ্রষ্টা তিনি। তার স্বপ্নের সফল বাস্তবায়ন হয়েছে। ২০১২ সালের ৩০ জুন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুকন্যা দেশরত্ন শেখ হাসিনা রেল সংযোগ (তারাকান্দি থেকে বঙ্গবন্ধু সেতু) এবং অ্যাডভোকেট মতিয়র রহমান তালুকদার রেলস্টেশন উদ্বোধন করেন। এছাড়াও প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা ২০২০ সালের ২৬ জানুয়ারি জামালপুরের জনগণের জন্য ‘জামালপুর এক্সপ্রেস’ নামে একটু অত্যাধুনিক আন্তঃনগর ট্রেন চালু করেছেন, যা এই সংযোগ লাইনে ঢাকা থেকে জামালপুর চলাচল করছে। 
তিনি একজন দূরদৃষ্টিসম্পন্ন রাজনীতিক ছিলেন। আমাদের অত্র এলাকার অনেক প্রথিতযশা রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব তৈরি হয়েছে তার সাহচর্য ও দিক-নির্দেশনায়। উদাহরণ হিসেবে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের বর্তমান সাংগঠনিক সম্পাদক, যুবকণ্ঠ, আমাদের সকলের প্রিয় জনাব মির্জা আজম ভাই এর কথা উল্লেখ করছি, তার রাজনৈতিক গুরু ছিলেন তিনি। আজম ভাই এর মাঝে যে কাজ করার স্পৃহা, নেতৃত্বের গুণাবলী ও সাহস ছিল তা তিনি উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন। একজন অনুসারী বা কর্মীর অন্তর্নিহিত গুণাবলী আবিষ্কার করা একজন নেতার বিশেষ একটা গুণ, যা তার মাঝে ছিল।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য ড. মুহাম্মদ সামাদ স্যার পত্রিকায় প্রকাশিত ‘মানবতাবাদী রাজনীতিক মতিয়র রহমান তালুকদার’ শীর্ষক লিখায় উল্লেখ করেছেন “একটা কথা আমি বিশেষভাবে বলবো- আজকের বাংলাদেশে যে রাজনৈতিক পরিস্থিতি, রাজনৈতিক নেতাদের মর্যাদা যেভাবে ক্ষুন্ন হচ্ছে, সেই তুলনায় মতিয়র রহমান তালুকদার ছিলেন একজন আদর্শ রাজনীতিবিদ। তার যে প্রজ্ঞা, তার যে জ্ঞান, তার যে ব্যক্তিত্ব, তার যে আত্মমর্যাদাবোধ তা আজ আমাদের জন্য অনুকরণীয়।”
এই লেখায় তিনি একটি অংশে বলেছেন- “একজন আইনজীবী হিসেবে তার মহত্বের কথা উল্লেখ না করলেই নয়। তিনি প্রথমে একজন মক্কেলের কথা শুনতেন। কথা শোনার পর মামলায় জেতার সম্ভাবনা না থাকলে বলতেন, ‘গ্রামে গিয়ে পারলে আপোস রফা করে ফেলেন। উকিল বাইটা খাওয়াইলেও এই মকদ্দমায় আপনি জিততে পারবেন না। বাংলাদেশে এমন কোন উকিল নাই যিনি আপনাকে এই মামলায় জিতায়।’ তারপর মহুরীকে বলতেন ‘টাকাটা ফেরত দিয়ে দাও।’ একজন আইনজীবী এত সততার সঙ্গে এভাবে ওকালতি করতে পারেন, মফস্বল শহরে, জেলা শহরে এমন মহৎ আইনজীবীর কথা কখনও শুনিনি। অন্যদিকে, সামরিকজান্তা জেনারেল জিয়ার দুঃশাসনকালে বিনা ফি-তে আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ ও যুবলীগের নেতাকর্মীদের নামে দায়ের করা অসংখ্য হয়রানিমূলক মামলা পরিচালনা করেছেন।”
এবার একটু ভিন্ন ঘটনা বলছি। অ্যাডভোকেট মতিয়র রহমান তালুকদার চাচার পরিচিতি কতোটা বিস্তৃত ছিলো সেই বিষয়ে জানা যাবে আমার জীবনের এই ঘটনা থেকে। ২০০৯ সালের সেপ্টেম্বর মাসে আমি বিসিএসের ভাইভা দিতে বাংলাদেশ সরকারি কর্মকমিশনে যাই। আমার প্রেসিডেন্সিয়াল ভাইভা ছিল, বাংলাদেশ সরকারি কর্মকমিশনের চেয়ারম্যান ড. সাদাত হোসেন স্যার ভাইভা বোর্ডেরও চেয়ারম্যান ছিলেন। আমি রুমে ঢুকে সালাম বিনিময়ের পর উনি আমার কাগজপত্রে নিজ জেলা জামালপুর দেখে প্রশ্ন করেছিলেন আমি অ্যাডভোকেট মতিয়র রহমান তালুকদারের নাম শুনেছি কিনা কিংবা উনার সম্পর্কে জানি কিনা। প্রশ্ন শুনে প্রথমেই একটু অবাক হয়েছিলাম যে চেয়ারম্যান স্যারও চাচাকে চিনেন। এরপর নিজেকে সামলে উনার সম্পর্কে যতটুকু জানতাম তা বলার পর বলেছিলাম উনাকে আমরা চাচা ডাকি, উনি আমার বাবার রাজনৈতিক গুরু। এই ঘটনাটা এইজন্য বললাম যে শুধু মাত্র রাজনৈতিক অঙ্গনেই তিনি পরিচিত ছিলেন না, সরকারি আমলা বা নীতিনির্ধারণী পর্যায়েও উনি সমান পরিচিত ছিলেন।
স্মৃতিকথা শেষ করবো কিছু দিনের স্মৃতির কথা জানিয়ে, যা মূলত চাচার জীবনেরও শেষ কিছুদিন ছিল। 
আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর রাজনীতির পাশাপাশি কিছু স্বেচ্ছাসেবী ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের সাথেও যুক্ত ছিলাম। আমি রোকেয়া হলের আবাসিক ছাত্রী ছিলাম, হলের স্বেচ্ছায় রক্তদাতাদের সংগঠন ‘বাঁধন’ এ আমার বান্ধবীরা কাজ করত। আমি যেহেতু রাজনীতিতে খুব সক্রিয় ছিলাম তাই বাঁধনের কমিটিতে থাকতাম না কিন্তু রক্তদাতা খোঁজার কাজটা সব সময় করতাম এবং নিজে ২০ বার রক্তদান করেছি। ২০০৮ সালে মতিয়র রহমান চাচা অসু্স্থ হয়ে বারডেম হাসপাতালে ভর্তি হন। তার কিডনি ডায়ালাইসিস করতে হতো প্রায় প্রতিদিনই। প্রতিবার ডায়ালাইসিস এর জন্য রক্ত লাগত। উনার জন্য রক্ত লাগবে শোনার পর আমি নিজ থেকে ডোনার জোগাড় করার দায়িত্ব নিই। আমার নিজের বড় ভাইসহ, বন্ধু-বান্ধব এবং হলের অনেক জুনিয়রকে নিয়ে গিয়ে রক্ত দেয়াই। উনি যে কয়দিন বারডেম এ ভর্তি ছিলেন প্রায় প্রতিদিনই আমি বারডেম এ গিয়েছি, এমনকি আইসিইউ তে ভর্তি অবস্থাতেও আমি উনাকে দেখেছি। একজন বলিষ্ঠ-তেজদীপ্ত মানুষকে বিছানায় পরে থাকতে দেখাটা খুব কষ্টকর ছিলো। 
বারডেম থেকে কিছুদিন পর উনাকে ধানমণ্ডির রেঁনেসা ক্লিনিকে ভর্তি করা হয়। সেখানে ডোনার নিয়ে যাওয়ার পর মাত্র একদিনই আমি চাচাকে দেখেছিলাম, এরপর আর আমার উনাকে দেখতে যাওয়ার সাহস হয় নাই। সারাগায়ে মেশিন বসানো, নাকে-মুখে নল লাগালো, চারপাশে মেশিনের আওয়াজ নেয়ার মত মনের জোর সেই বয়সে আমার ছিল না। রেঁনেসার সেই একদিনেই স্মৃতিই আমার মনে গেঁথে আছে। যদিও আমার মানসপটে তিনি আছেন তেজদীপ্ত, পাহাড়সম দৃঢ়কঠিন, সততায় অবিচল, অসহায় মানুষের প্রতি মমত্ববোধের আধার এক মহান পুরুষ।
পরিশেষে বলবো, এই প্রজাতন্ত্রের অভিভাবক, আমাদের সকলের প্রাণপ্রিয় নেত্রী, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুকন্যা দেশরত্ন শেখ হাসিনার হাতকে শক্তিশালী করতে একজন ব্যক্তি মতিয়র রহমান তালুকদার কিংবা তার নীতি-আদর্শের প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম। আমরা যদি উনার মত নেতাদের পদাঙ্ক অনুসরণ করি তাহলেই আমাদের নেত্রীর হাত শক্তিশালী হবে এবং সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্ঠায় আমরা বঙ্গবন্ধু’র স্বপ্নের ‘সোনার বাংলা’ গড়ে তুলতে পারবো।
(“মতিয়র রহমান তালুকদার স্মারকগ্রন্থ” এ প্রকাশিত আমার লেখা থেকে নেয়া)
আগামীকাল ১৬ জুলাই তার ১৪তম মৃত্যুবার্ষিকীতে বিনম্র শ্রদ্ধা জানাই এবং তার আত্মার মাগফিরাত কামনা করছি। সৃষ্টিকর্তা আপনাকে জান্নাতবাসী করুন, আমীন।
(ফেসবুক থেকে সংগৃহীত)
বিডি প্রতিদিন/আরাফাত
 
                         
                                     
                                                     
                                     
                                     
                                     
                                     
                                     
                                     
                                     
                                     
                                     
                                     
                                     
                                     
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                        