আমি যখন খুব ছোট তখন পারিবারিকভাবে আমার মাথায় প্রথম যে চাপটি আসলো সেটি হলো আমাকে ক্লাসে প্রথম হতে হবে। খুব ছোটকাল থেকেই জানতাম, প্রথম হতে না পারলে মার একটাও মাটিতে পড়বে না। তৃতীয় শ্রেণিতে যখন দ্বিতীয় হলাম, ভয়ে আমার প্রায় দম বন্ধ হয়ে আসছিল। বাসায় যেতে পর্যন্ত ভয় পাচ্ছিলাম। কিভাবে সেটা কাটিয়েছি মনে নাই। আমার শুধু একটি বিষয় মনে আছে, আমি নিজেকে অনেক ভালোবাসতাম এবং ভালোবাসি।
প্রত্যেক মানুষ যে আলাদা সেটা আমরা নিজেরাই প্রায়শই ভুলে যাই আর ভুলে যাই বলেই আমরা বারবার তুলনা করি। পরীক্ষায় খারাপ করলে "অমুকের ছেলে ভালো করলো, তোর মাথায় তো গোবর ভর্তি, তোকে দিয়ে হবে না" এরকম কত নেগেটিভিটি'র মধ্য দিয়ে যে যেতে হয়।
কোনোভাবে আপনার পরিবার যদি আধুনিক ও অন্য রকম হয়েও যায়, আপনি বিন্দুমাত্র চিন্তা না করলেও চলবে, আপনার আত্মীয়, স্বজন ও প্রতিবেশীরা সেই মহান দায়িত্ব কাঁধে তুলে নেবেন। তারা বারবার আপনাকে বুঝিয়ে দেবে কোনো প্রতিযোগিতায় আপনি ছিটকে পড়েছেন মানেই আপনার জীবন শেষ। আশেপাশের কানাঘুষা শুনতে শুনতে আপনার ঠিক থাকা পরিবারও আপনাকে কথা শোনানো শুরু করবে।
একটা মানুষের নানাবিধ কারণ থাকতে পারে ডিপ্রেসড হবার। সকলে সেই যুদ্ধ নিজের মত লড়তে পারে না! কারো জুতোয় পা ঢুকানোর আগে পর্যন্ত কেউ কারো বেদনা বুঝতে পারে না! আমরা বলে ফেলি খুব সহজে, এটা হওয়া উচিত হয়নি কিন্তু আমরা এটা কখনোই বলি না এটা কেন হলো? আপনার মানসিক আঘাত পাওয়া বন্ধুর চাওয়া কি সেটি বন্ধু হিসেবে আপনি বুঝতে না পারলে, আপনাদের বন্ধুত্ব অর্থবহ নয়। বলছিনা প্রচন্ড ডিপ্রেসড থাকা বন্ধুকে আপনি সাধারণ একজন মানুষ ঠিক করে ফেলতে পারবেন, কিন্তু আপনি তাকে একজন ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট'র কাছে রেফার করতে পারেন। এতটুকু অনুভূতি দিতে পারেন যে, তার এই দুঃসময়ে তিনি একা নন! দুঃখজনক হলেও সত্যি, ছেলে বন্ধুদের এরকম ডিপ্রেশন যে আসতে পারে, সেটি অন্য ছেলেরা মানতেই পারেনা। এটিকে লোক হাসানোর পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া হয় বলে, ডিপ্রেসড বন্ধুটি আরও ডিপ্রেশনে চলে যেয়েও মুখ খুলতে চায় না।
যে জীবনের জন্য মানুষের এত আকুতি সেই জীবনের স্বেচ্ছা বিসর্জন গ্রহণযোগ্য নয়। অবসাদগ্রস্ত মানুষ পরিবার ও কাছের মানুষদের সমর্থন পেলে অনেকটাই ঘুরে দাঁড়াতে পারে। ডিপ্রেশনের মাপকাঠি নির্ধারণের সুযোগ নেই, হাজারো কারণ থাকতে পারে। পরিবারের উচিত ছোটবেলা থেকেই সন্তানদের নিজেকে তথা জীবনকে ভালোবাসতে শেখানো। সততা, নৈতিকতা, আত্মবিশ্বাস, মহানুভবতা, নিজের প্রতি ভালোবাসা এই বিষয়গুলোর সাথে ধীরে ধীরে সন্তানকে পরিচিত করানো খুব জরুরি। অবসাদগ্রস্ত মানুষটি কিন্তু একদিনে অবসাদে ভুগে না! একটা সময় পাড়ি দিয়েই মানুষটি অবসাদে ভুগতে থাকেন, একাকীত্ব পেয়ে বসে তাকে। সকলে সেই একাকিত্ব ছেড়ে বের হয়ে আসতে পারে না।
জীবনে অনেক মানুষ পাবেন, যারা মানসিক স্বাস্থ্য কি, ডিপ্রেশন কি এসব বোঝেনই না! জীবন দিব্যি কাটিয়ে দিয়েছেন। গ্রামের সেই বৃদ্ধাকে দেখুন যিনি মারা যাওয়ার আগের দিন পর্যন্ত গরুর দুধ টেনে তা বাজারে বিক্রি করতে পাঠিয়েছেন। তিনি হয়তো জীবনে কখনো ভেঙে পড়েছেন, কেঁদেছেন আবার উঠে দাঁড়িয়েও গেছেন। জীবন তার কাছে বিদ্যমান সমস্যার চেয়েও অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিধায় এই ডিপ্রেশন তার উপর চড়াও হতে পারেনি।
এই জীবনে কত শত ঘটনা ঘটবে যা আপনার মনের মত হবে না, তাই বলে থেমে যাবেন? না জীবনকে চালাতে হয়! আপনার জীবন শুধু আপনার একার তো নয়! অনেকের অধিকার আছে আপনার উপর। আপনার বিদ্যমান দুঃখের চেয়েও আপনার চলে যাওয়ার পর যে দুঃখের মাশুল আপনার আপনজনেরা দিয়ে যাবেন সেটিকে এক পাল্লায় মেপে দেখুন, আপনার দিকের ওজন অবশ্যই অনেক কম! এই ভাবনাটুকু ভাবা জরুরি।
যখন খারাপ কিছু ভাবার সাহস পাচ্ছেন তখন আপনজনের বেদনাটুকু ভাবার সাহসও রাখবেন, এতে প্রভেদ টানার সুযোগ পাবেন। জীবন হয়তো আপনার কষ্টের চেয়েও অনেক বেশি অর্থবহ মনে হবে তখন!
জীবনের কাছে আকাশচুম্বী প্রত্যাশা রাখতে নেই! যার প্রত্যাশা যত সংকুচিত তার সুখ তত বেশি।  নিজের মনের মত কিছু না পেলে বিশ্বাস করে নিতে শিখুন সেটা আপনার জন্য ছিল না, হয়তোবা আরও ভাল কিছু অপেক্ষায় আছে আপনার জন্য অথবা কোনকিছুই অপেক্ষা করছে না!
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একদম ছোট থেকে নিজেই নিজের মোটিভেটর হওয়ার চেষ্টা করুন, অতি নির্ভরশীল হয়ে যেয়েন না! নিজেকে এতটাই ভালোবাসুন যেন অতি আপনজনও কষ্ট দিতে চাইলে তা থেকে নিজেকে রক্ষা করতে পারেন!
নিজেকে ভালোবাসতে না পারলে আপনি অন্যকে ভালোবাসবেন কিভাবে? এই বিশ্বাসটুকু জরুরি! জীবন অনেক সুন্দর, তা কখনোই কারো জন্য থেমে থাকেনি, থামবেও না! আপনার প্রথম পছন্দের কিছু না পেলে, দ্বিতীয় পছন্দ দিয়ে একে সাজান তা না পেলে নিজের জন্য কমফোর্ট জোন তৈরি করুন, তা নিয়েই এগিয়ে যান। তবুও বেঁচে থাকুন।
আমাদের প্রত্যেকের আলাদা আলাদা সমস্যা রয়েছে! লক্ষ্য করে দেখুন সবাই কিন্তু আত্মহননের পথ বেছে নিচ্ছে না! অনেকে ডিপ্রেশনের সাথে পরিচিতই না কারণ তারা জীবনকে নিজেদের সীমাবদ্ধতা নিয়েই মেনে নিতে শিখেছে! বেঁচে থাকাটা খুব জরুরি! বেঁচে থাকলেই না জীবনকে অর্থবহ করতে পারবেন!
নিজেকে ভালোবাসুন! পরিবার, পরিজন, আত্মীয়, স্বজন, নিয়ে বেঁচে থাকুন! কষ্ট থাকলে নিজেকে তুলে ধরুন, কাউকে না কাউকে আপনার পাশে পাবেনই! যদি কাউকেই যোগ্য মনে না করেন, তাহলেই নিজেই নিজেকে মোটিভেট করুন।
জীবনে সমস্যা আসবেই, বারবার জয়ী হবেন এই ধারণা থেকে বের হয়ে আসুন। যারা আপনার উপর ঋনাত্মক চাপ প্রয়োগ করেন তাদেরকে এড়িয়ে চলুন! নিজের মত করে, নিজেকে ভালোবেসে বাঁচতে শিখুন....একটিবার হাসপাতালে যেয়ে দেখুন, কি ভীষণ বেঁচে থাকার ইচ্ছে মানুষের! আত্মহননে চেষ্টারত মানুষগুলোও আবার ফিরে আসতে চায় জানেন, কিন্তু তখন অনেক দেরি হয়ে যায়! ফিরেই যদি আসতে চাইবেন তবে কেন সেই ভুল পথে যাবেন?
নিজেকে ভালোবাসতে শিখুন, উদ্বৃত্ত হলে অন্যের মাঝে সেই ভালোবাসা ছড়িয়ে দিন। যদি তা না চান তারপরও শুধু নিজেকে ভালোবেসে হলেও বেঁচে থাকুন।
লেখক : এডিসি, ক্যান্টনমেন্ট ও খিলক্ষেত, ডিএমপি।
(ফেসবুক থেকে সংগৃহীত)
বিডি প্রতিদিন/আরাফাত
 
                         
                                     
                                                     
                                     
                                     
                                     
                                     
                                     
                                     
                                     
                                     
                                     
                                     
                                     
                                     
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                        