মায়ের কথা যেমন মনে পড়ে। বাবার কথাও মনে পড়ে। বাবাদের কথা মনে পড়ে। এর আগে ঈদ সংখ্যায় লিখেছিলাম মায়ের কথা মনে পড়ে। বাবার কথা কি মনে পড়ে না? প্রতিটি সন্তানের কাছেই বাবার কথা খুব মনে পড়ে। শিশু বয়সে বাবার কাঁধে চড়ে ঈদের পোশাক কিনতে যাওয়া। শৈশব থেকে বাবা যতদিন বেঁচে থাকেন সবাই মিলে তার সঙ্গেই ঈদের নামাজ পড়তে যান। আমরা যারা প্রান্তিক থেকে উঠে এসেছি আমাদের কাছে সেই দিনগুলো নস্টালজিয়ায় কাঁদায়ই না, মনে করিয়ে দেয় মধ্যবিত্ত পরিবারের নানা টানাপড়েনের মধ্যেও বাবার কষ্টার্জিত অর্থে অনেক ছেলেমেয়ে নিয়ে গড়া মধুর সংসারখানি কতই না সুখের ছিল। মায়ের চেয়ে ছেলেবেলায় বাবার সঙ্গেই ছিল আমার যত সখ্যতা। সরকারি চাকরি করতেন। নানা জায়গায় ছুটে বেড়াতেন। বাবা এলে সেই ছোট্ট বেলায় রিকশায় করে শহরে নিয়ে গিয়ে দেশবন্ধুর মিষ্টির দোকানে রসগোল্লা খাওয়াতেন। বায়না ধরলে সামর্থ্যের মধ্যে কতকিছু কিনে দিতেন। জেলার নামিদামি জুবিলি স্কুলের সামনে দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের অনেক আগে আঙ্গুল তুলে দেখিয়ে বলেছিলেন, ওই দেখ কত বড় স্কুল। তুমি ওই স্কুলে পড়ে অনেক বড় হবে। এই স্কুলে লেখাপড়া করলেও আকাশ ছুঁতে পারিনি কখনো। আমার স্বপ্নের মৃত্যু দেখি বারবার। বাবা ছিলেন সেকেলের সাদাকালো যুগের অতি সহজ-সরল সাদা মনের মানুষ। আল্লাহর কাছে নিজেকে সঁপে দেওয়া এমন মানুষ আমি কম দেখেছি। তাহাজ্জুদের নামাজ দিয়ে তার এবাদত-বন্দেগি শুরু হতো। ফজরের নামাজ পড়ে কোরআন তেলাওয়াত করে ভোরের আলোয় স্নিগ্ধ হাওয়ায় শহর ঘুরে আসতেন। সেই বাবা গাছগাছালি ঘেরা সুনামগঞ্জ শহরের বাড়িটিকে রোজ সকালে ঝাড়ু দিতেন। বাড়ির আঙিনায় একটি গাছের পাতাও যাতে না থাকে সে জন্য ঈদের সময় আমাদেরও কাজে লাগিয়ে দিতেন। গৃহকর্মীদের ওপর নির্ভর করে বসে থাকতেন না। আমরা ছিলাম পাঁচ ভাই। হয়েছি তিন ভাই। তিন বোনের মধ্যে বড় আপা চলে গেছেন। বাকি দুই বোন সিলেটে যার যার সংসারে। দুই ভাই এখন স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে বাড়িতে। আমি যানজট ও সস্তায় মানুষ খুনের নগরী ঢাকায় বাস করি। নগর সভ্যতায় আমাকে টানতে পারে না। আমার এক প্রিয়জন বলেছিল, আমার নাকি শিশুর সারল্যতা আছে। হয়তোবা সারল্যতা আছে হয়তোবা ছিল। এই সারল্যতা আমি আমার বাবার কাছে পেয়েছিলাম। উত্তরাধিকার সূত্রে আমাদের সময় বাবা-মায়ের কাছ থেকে আদর্শলিপির পাঠ নিতাম। পারিবারিক অনুশাসন, সামাজিক দায়বদ্ধতা আর ধর্মীয় মূল্যবোধে আমাদের জীবন তৈরি করে দেওয়া হতো। সেই সাদাকালো যুগে আমাদের বাবা-মায়েরা যেমন সরল ছিলেন তেমনি তাদের চারপাশকেও সরল মুগ্ধতায় তৈরি করতেন। আমরা রঙিন যুগের মানুষেরা শঠতা, প্রবঞ্চনা, চতুরতা, লোভ, হিংষা বিদ্বেষের পথে সমাজকে এক অসুস্থ প্রতিযোগিতায় তুলে দিয়েছি। আমাদের সময়ে মফস্বল শহরে অনেক বিত্তবানরা, অনেক ভূ-সম্পত্তির মালিক বা বড় ব্যবসায়ীরাও সাদামাঠা জীবনে অভ্যস্ত ছিলেন। বিলাসবহুল দূরের কথা সাদামাঠা বাড়িতে সবাইকে একটি সুশৃঙ্খল জীবনে বাঁধতেন। মানুষ হওয়ার শিক্ষা দিতে চাইতেন। আমাদের বাবা-মায়েরা প্রকৃত ভালো মানুষ ছিলেন। ক্ষমতা ও বিত্তের দাম্ভিকতায় মানুষের মূল্যায়ন হতো না। মানুষ হিসেবেই মানুষের মূল্য ছিল। সমাজে শিক্ষিত, ভদ্র, বিনয়ী ও সম্ভ্রান্ত রুচিশীল মানুষের কদর ছিল বেশি। আমাদের যেমন আট ভাইবোনের সংসার ছিল তেমনি প্রায় সব পরিবারেই সন্তান-সন্ততি নিয়ে পারিবারিক কাঠামোটিই ছিল বড়। কিন্তু প্রতিটি পরিবারে যে সুখ আনন্দ ঈদে পার্বণে দেখা দিত তার প্রভাব সমাজেও পড়ত। এত দামি দামি গরু কোরবানির হিড়িক ছিল না। শরিকানায়ও কোরবানি দিতে কোনো লজ্জা ছিল না। ধর্মীয় দায়িত্ব পালনই ছিল প্রধান। একালে মানুষের ক্রয়-ক্ষমতা বাড়লেও বিলাসিতার অপর পিঠে নিষ্ঠুর দারিদ্র্যের যে বসবাস তার কথা চিন্তা না করেই অনেকে চাকচিক্য দেখাতে, অসুস্থ সমাজে নিজেকে জাহির করতে হাটে গিয়ে ১০ থেকে ১২ লাখ টাকার গরু উট কিনে খবর হচ্ছেন। আল্লাহর অনুগ্রহ লাভের চেয়ে সমাজে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করছেন। রঙিন যুগে বিজ্ঞান অগ্রসর হলে, প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়লেও এমনকি যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি ঘটলেও সাদাকালো যুগের সেই সৌন্দর্য মূল্যবোধ, মানবিকতা এবং সামাজিক রুচিবোধ বিপর্যয় ঘটেছে। যাক যে কথা বলছিলাম, সেই সাদাকালো যুগে আমাদের আটপৌরে মায়েরা সীমিত আয়ের মধ্যে সংসারের যে বাঁধন দিতেন সেখানে নিয়ম-শৃঙ্খলা আর মায়া-মহব্বত ছিল বড় প্রাচুর্য। আমাদের বাবারা ঈদের জামাতে আমাদের দল বেঁধে নিয়ে যেতেন। আল্লাহর অশেষ রহমতে সেঞ্চুরি করে বাবা চিরনিদ্রা নিয়েছেন। ছেলেবেলায় কোলে-পিঠে করে আদর-স্নেহে বড় করা বাবা-মায়ের কবর জেয়ারত ঈদের দিন একটি বড় দায়িত্ব হয়ে দাঁড়ায়। আমার দুরন্ত শৈশব আর কৈশোরে বাড়ির যে পুকুরটিতে অবাধ্য দুপুরে সাঁতারে পড়ে থাকতাম, কবি শামসুর রাহমানের স্বাধীনতার স্বর্গ সুখ পেতাম। সেই সাঁতার থেকে কঞ্চি বা বেত হাতে মায়ের শাসনে উঠে আসতে হতো। বাবা ছিলেন আমার কাছে সকল আদরের জায়গা। মা-ভাইয়েরা ছিলেন শাসকের আসনে। দুষ্টুমি আর চঞ্চলতায় ভরা ডানপিটে সেই সময়টিতে কি স্কুল কি বাসা মানসিক ও শারীরিক পীড়ন অতিমাত্রায় করা হতো। কঠোর অনুশাসন আর শাসন একালে তেমনটি নেই। সেকালের শাসনটি বেশি ভয়ঙ্কর ছিল। কারণ এ ধরনের শাসন মানুষের সাহস, ব্যক্তিত্ব ও সৃজনশীলতাকে দমিয়ে দেয়। সৃষ্টিশীলতার পথে তাকে পঙ্গু করে দেয়। তবুও এ দিকটি ছাড়া সেই সাদাকালো যুগের দিনগুলোও আমাদের কাছে ছিল সোনালি সময়। এমন সোনার দিন আর ফিরে আসবে না। এবার বাড়ি যাওয়া হয়নি আমার। বাবাও নেই, মাও নেই। মায়ের হাতের কোরমা পোলাও, ছোট আপার হাতের স্বাদের রান্না আর বাবার সঙ্গে সাত সকালের তাড়া খেয়ে ঈদগাহ ময়দানে ঈদের জামাত আদায় করার সেই দিনগুলো মনে পড়লে আমার মন খারাপ হয়ে যায়। বাড়িতে থাকলে বাবা-মায়ের শূন্য চেয়ার ও শয্যা দেখেও মাটির ঘ্রাণ নেওয়া যায়। বেদনা আর আনন্দ সেখানে হৃদয়ে একসঙ্গে দোল খায়। প্রান্তিকের বাড়ি মানেই হৈচৈ আনন্দ আর মায়ের অাঁচলে বাঁধা সোনার সংসারের উপচে পড়া স্নেহ ভালোবাসার রূপ। বাবা-মা হীন বাড়িতে গেলে আগন্তুকের মতো স্মৃতিময় পথ ধরে সেই হারানো সোনার সুখগুলো খুঁজে ফেরা যায়। বাবা-মা সন্তানদের দুহাত উপুড় করে ঢেলে দেন। সন্তানের কাছে হাত পাততে জানেন না। বাবা-মায়েরা শিশু সন্তানদের লালন-পালন করে বড় করেন। বৃদ্ধ বয়সে শিশুর মতো হয়ে যাওয়া বাবা-মাদের সন্তানরা দেখভাল করলে তারা বটবৃক্ষের মতো ছায়া দেন। তৃপ্তির ঢেঁকুর তোলেন। আর যে সন্তান জীবনে প্রতিষ্ঠা লাভের পর বৃদ্ধ বাবা-মাকে বৃদ্ধাশ্রমে ফেলে রাখে তাদের দীর্ঘশ্বাসে অজান্তেই সন্তানের অমঙ্গল না চাইলেও তাদের জন্য অভিশাপ নেমে আসে। এমন সন্তান যেন কারও না হয় যে প্রতিষ্ঠা লাভের পর মা-বাবাকে বৃদ্ধাশ্রমে ফেলে রেখে নচিকেতার গানের চেয়েও করুণ চিত্রকল্প তৈরি করেন। বাবা মারা যাওয়ার আগে একবার সুনাগঞ্জের সেকেলে বাড়িটিতে একটি শেরোয়ানি ও জিন্নাহ টুপি তার নাতি অন্তরকে উপহার দিয়েছিলেন। অন্তর তখন ছোট ছিল। বাবার মৃত্যুর পর ঈদের জামাতে অন্তর সেটি পরে গিয়েছিল। সেই নেহরু শেরোয়ানি তার গায়ে ঠিকঠাক মতো লেগেছিল। অন্তর যখন পরেছিল এটি ছিল ৫০ বছরের পুরনো। নাতির জন্য ছিল দাদার হাতের পাওয়া পরম স্নেহ ভালোবাসা। হৃদয় উজাড়িত ভালোবাসার চেয়ে বড় প্রাচুর্য নেই বলেই আমার মনে হয়। যেসব বাবা-মা চিরনিদ্রায় শায়িত তাদের জন্য ঈদের জামাতে আমরা আত্দার মাগফিরাত কামনা করে দোয়া চাইব। যেসব বাবা-মা জীবিত তাদের ঈদের দিন পর্যাপ্ত সঙ্গদানই নয়, আল্লাহর দরবারে তাদের শতায়ু কামনা করে মোনাজাত করব। ঈদের দিনে বাবার সঙ্গে জামাতে যাওয়া সন্তানের মধুর স্মৃতি ভোলার নয়। এমন স্মৃতি ভুলতেও হয় না। ঘুরে-ফিরে ঈদের দিন বাবা-হারা সন্তানের কাছে বাবার কথাই মনে পড়ে। মা-হারা সন্তানের কাছে মায়ের জন্য ভাবতে ভাবতে চোখে জল আসে। জীবনের পড়ন্ত বেলায় অস্তমিত সূর্যের মতো পড়ে থাকা মায়েদের স্নেহ ছায়া দিতেই সন্তানের মন খুব বেশি টানে। মায়ের অাঁচলেই নিরাপদ আশ্রয় ছিল। স্নেহভরা মায়া ছিল। বাবার কোমল হৃদয়ের স্পর্শ আমি পাই। বাবার শরীরের ঘ্রাণ খুব বেশি লাগে মাঝে মধ্যে। ঈদের দিনে আমার বাবার কথা খুব মনে পড়ে। মায়ের কথা মনে পড়ে। বাবা-মায়ের কথা মনে পড়ে। সেই সাদাকালো যুগের সরল জীবনযাপনের আনন্দে অবগাহন করতে ইচ্ছে করে। ইচ্ছে করে সেই দিনগুলোতে সাঁতার কেটে শিশুর সারল্যতা নিয়ে ফের বিশুদ্ধ হই।
শিরোনাম
- প্রথমবারের মতো বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হয়ে দ্বিতীয় স্থানে দক্ষিণ আফ্রিকা
- বগুড়ায় উন্নয়নের দাবীতে মানববন্ধন ও স্মারকলিপি প্রদান
- ভোটকেন্দ্র মেরামত করতে চার সচিবকে ইসির চিঠি
- দুর্নীতি মামলায় যবিপ্রবি’র সাবেক উপাচার্য ড. আব্দুস সাত্তার কারাগারে
- রংপুর এক্সপ্রেসসহ ১৪ আন্তঃনগর ট্রেন ছাড়ছে নির্দিষ্ট সময়ের পরে
- ভ্যাপসা গরমে স্বস্তি পেতে জলকেলিতে মেতেছে শিশুরা
- ইতালি প্রবাসী বাংলাদেশিদের যে বার্তা দিল দূতাবাস
- দুই হাজার কোটি টাকা পাচার : দুদকের জালে সাবেক হাইকমিশনার মুনা
- এটিএম বুথের ভেতরে কারখানা শ্রমিককে ধর্ষণ
- সরকারি চাকরি অধ্যাদেশ পুনর্বিবেচনার সুযোগ আছে : আইন উপদেষ্টা
- রেমিট্যান্স যোদ্ধাদের জন্য আরও ৪ রুটে বিমানের বিশেষ ভাড়া
- দ্রুত নির্বাচনের মাধ্যমে গণতন্ত্রে উত্তরণ চায় জনগণ : আমীর খসরু
- দেশে ফিরেছেন ২৩৬৫৯ বাংলাদেশি হাজি, মৃত্যু ২৯
- বাংলাদেশের মানুষ ভোট দিতে উন্মুখ হয়ে আছে : মঈন খান
- নগরভবনে সভা করলেন ইশরাক
- সাকিবসহ ১৫ জনের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা
- বিস্ফোরক মামলায় বিএনপি নেতা এ্যানিসহ ৯ জন খালাস
- ইরানের ৩৭০ ক্ষেপণাস্ত্র হামলা: ইসরায়েলে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি
- ইরান-ইসরায়েল দ্বন্দ্বে দুই পক্ষের সঙ্গেই সম্পর্ক রাখতে চায় ভারত
- ১১৬ বছরের ইতিহাসে প্রথম: ব্রিটিশ গোয়েন্দা সংস্থা এমআই৬-এর প্রধান হচ্ছেন নারী
বাবার কথা খুব মনে পড়ে
পীর হাবিবুর রহমান
প্রিন্ট ভার্সন

এই বিভাগের আরও খবর
সর্বশেষ খবর