বৃহস্পতিবার, ৯ জুন, ২০১৬ ০০:০০ টা

টার্গেট কিলিং এরপর কে

সাখাওয়াত কাওসার

টার্গেট কিলিং এরপর কে

রাজধানী ঢাকা থেকে মফস্বলের অজপাড়াগাঁ। ঘাতকদের জাল যেন বিস্তৃত সর্বত্রই। তাদের থাবা থেকে বাদ যাচ্ছেন না মসজিদের ইমাম-মুয়াজ্জিন, পুরোহিত-ফাদার, ব্লগার, বিদেশি নাগরিক, পুলিশ কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়ের নিরীহ শিক্ষক। সর্বশেষ চট্টগ্রামে এসপি বাবুল আক্তারের স্ত্রীর খুনের ঘটনা গোয়েন্দাদের সব ধারণাকেও যেন ছাপিয়ে গেছে। পরিবারের সদস্যদের নিরাপত্তা নিয়ে রীতিমতো চিন্তিত হয়ে পড়েছেন আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যরা। অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গোযেন্দা নজরদারির ঘাটতি রয়েছে। একই সঙ্গে নিরাপত্তা বেষ্টনীতে সাধারণ নাগরিকদের সম্পৃক্ত করা হচ্ছে না। তবে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের দাবি, দেশকে অস্থিতিশীল এবং সরকারকে বিব্রত করার জন্যই একের পর এক অপচেষ্টা চালাচ্ছে কুচক্রী মহল। তাদের রুখে দিতে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যরা তত্পর। তবে সাম্প্রতিক এসব হত্যাকাণ্ড রীতিমতো ভাবিয়ে তুলছে গোয়েন্দাদের। প্রশ্ন উঠেছে, গুপ্তহত্যার মিশনে এরা কারা? তাদের কী উদ্দেশ্য। পরবর্তী টার্গেটই বা কে?

জানা গেছে, জঙ্গিগোষ্ঠী নতুন মাত্রায় সক্রিয় হওয়ার পর গত বছরের জানুয়ারি থেকে এ পর্যন্ত সারা দেশে ৪৫টি হামলার ঘটনা ঘটেছে। এতে নিহত হয়েছেন ৪৭ জন। যদিও ২০১৩ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি কথিত নাস্তিক ব্লগার আহমেদ রাজীব হায়দারকে চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে হত্যার মাধ্যমেই শুরু হওয়া ঘাতকদেও কিলিং মিশন ধারাবাহিকভাবে চলছে। বেশির ভাগ ঘটনারই দায় স্বীকার করেছে মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক জঙ্গিগোষ্ঠী আইএস (ইসলামিক স্টেট) ও আল-কায়েদার ভারতীয় উপমহাদেশের কথিত বাংলাদেশ শাখা আনসার আল ইসলাম। যদিও বাংলাদেশ সরকার ও পুলিশের পক্ষ থেকে বরাবরই বলা হচ্ছে, দেশে আইএস বা আল-কায়েদার কোনো সাংগঠনিক অবস্থান নেই। দেশীয় জঙ্গি সংগঠন জেএমবি বা আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের (বর্তমান নাম আনসার আল ইসলাম) সম্পৃক্ততা পাওয়া গেছে অনেক ঘটনায়। মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিস কেন্দ্র—আসকের নির্বাহী পরিচালক (ভারপ্রাপ্ত) নূর খান লিটন বলেন, গণতন্ত্রকে সংকুচিত করা হলে এবং রাষ্ট্রের জবাবদিহিতা না থাকলে জঙ্গি উত্থানের মাত্রা বেড়ে যাওয়ার পরিবেশ তৈরি হয়। অন্যকে দোষ দিয়ে লাভ কী? এমন অবস্থা তৈরির জন্য তো আমরাই দায়ী। দুর্বৃত্তরা এখন আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যদের ওপর হামলার সাহস দেখাচ্ছে। সত্যিই এসব ভাবতেও কষ্ট হয়। তবে দেশের সাধারণ মানুষকে এখনো সচেতন করা হয়নি। নিরাপত্তা বলয়ে এখনো সাধারণ মানুষকে সম্পৃক্ত করা হচ্ছে না এটাও একটা দুর্বলতা। তিনি আরও বলেন, আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যদের মনোবল ভেঙে দেওয়ার জন্যই এমন হামলা চালিয়েছে জঙ্গিরা। যদিও ইসলামে বলা আছে কারও অপরাধের জন্য অন্য কাউকে ক্ষতি করা যাবে না। সর্বশেষ এসপির স্ত্রীকে খুন করে অপরাধীরা নতুন একটি বিষয় ভাবতে বাধ্য করছে। জানা গেছে, একটি মোটরসাইকেল। তিনজন আরোহী। টার্গেটকৃত ব্যক্তির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে ছুরিকাঘাত ও কুপিয়ে মৃত্যু নিশ্চিত করছে। মাঝেমাঝেই ব্যবহূত হচ্ছে আগ্নেয়াস্ত্র। রাজধানীর কূটনৈতিক ও স্পর্শকাতর এলাকা গুলশানে ইতালির নাগরিক তাভেলা সিজারকে হত্যার মাধ্যমে মোটরসাইকেলের তিন আরোহী চক্রটি তাদের অস্তিত্ব জানান দেয়। একে একে রংপুরে জাপানের নাগরিক হোশি কোনিও, ঝিনাইদহে হোমিও চিকিৎসক মীর সানাউর, রাজশাহীতে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক এ এফ এম রেজাউল করিম সিদ্দিকী, সর্বশেষ চট্টগ্রামে এসপি বাবুল আক্তারের স্ত্রী মাহমুদা খাতুন মিতুকে একই কায়দায় খুন করা হয়। এর আগে ২০১৩ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি কথিত নাস্তিক ব্লগার আহমেদ রাজীব হায়দারকে চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে হত্যায় নিজেদের অস্তিত্ব জানান দেয় চাপাতি গ্রুপ। অনেকটা ধারাবাহিকভাবেই চলছে তাদের কিলিং মিশন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক জিয়া রহমান বলেন, গোয়েন্দা তত্পরতা একই সঙ্গে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর প্রযুক্তিগত সক্ষমতা বাড়ানোর উদ্যোগ নিতে হবে। কোনো হত্যাকাণ্ডকেই বিচ্ছিন্ন ঘটনা মনে করা হবে মারাত্মক ভুল। দ্রুততর সময়ের মধ্যে অন্তত দু-একটি হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত প্রকৃত অপরাধীদের গ্রেফতার করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। এতে অন্য অপরাধীরা ভয় পাবে। নেপথ্য মদদদাতারাও তাদের পলিসি থেকে সরে আসতে বাধ্য হবে। তিনি আরও বলেন, আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোয় অত্যাধুনিক প্রযুক্তির সমন্বয় ঘটাতে হবে। তবে এখন যে পরিস্থিতি দাঁড়িয়েছে, সেখানে হত্যা টার্গেটে আর কোনো বাচবিচার নেই। শুরু থেকে এক ধরনের গোষ্ঠীকে টার্গেট মনে করা হলেও এখন তা অনেক বিস্তৃত হয়েছে এবং কেউই নিশানার বাইরে নয় বলে মনে হচ্ছে, যা কিনা জঙ্গিগোষ্ঠী আসলে চায়। গোয়েন্দাসংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, মোটরসাইকেলে দাপিয়ে বেড়ানো এই খুনি চক্রটি প্রশিক্ষিত। এরা এতটাই দুর্ধর্ষ যে শরীরের কোথায় গুলি করলে বা ছুরিকাঘাত করলে মৃত্যু নিশ্চিত হবে, তা তাদের জানা। এ কারণে প্রতিটি কিলিং মিশনেই সফল হচ্ছে তারা। প্রাথমিকভাবে এসব গ্রুপকে নিষিদ্ধ একাধিক জঙ্গি সংগঠনের ‘স্লিপার সেল’ বলে ধারণা করছেন বিভিন্ন ঘটনায় তদন্তসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। তবে স্লিপার সেলের সদস্য হওয়ার কারণে তাদের কাছ থেকে সহযোগীদের সম্পর্কে তথ্য উদ্ঘাটন করা যাচ্ছে না। এ কারণে মূল হোতাদের অনেকেই আড়ালে থেকে যাচ্ছে। তবে মূল হোতাদের কয়েকজনকে শনাক্ত করে গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে। আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যদের নিজেদের নিরাপত্তা নিশ্চিতে আরও সচেতন হওয়ার কথা বলা হয়েছে পুলিশ সদর দফতর থেকে। বিভিন্ন সময় ঝুঁকিপূর্ণ অপারেশনের কারণে যারা হুমকিতে রয়েছেন ওই সদস্য এবং তাদের পরিবারের সদস্যদের নিরাপত্তা নিশ্চিতের জন্য বিশেষ নির্দেশনাও দেওয়া হয়েছে পুলিশ সদর দফতর থেকে। এর আগে গণমাধ্যমকর্মীদের একই ধরনের বক্তব্য দিয়েছিলেন পুলিশের অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক মোখলেসুর রহমান।

সূত্র আরও বলছে, বিদেশি নাগরিক, হিন্দু পুরোহিত বা খ্রিস্টান মিশনের ফাদার ও শিয়া মসজিদে হামলাগুলোর সঙ্গে নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন জামা’আতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশ—জেএমবির একটি অংশ জড়িত। আর ব্লগারসহ পেশাজীবী তথা সমাজের বিভিন্ন স্তরের সচেতন মানুষ হত্যায় আনসারুল্লাহ বাংলা টিম জড়িত। যদিও নিষিদ্ধ ঘোষণার পর আনসারুল্লাহ বাংলা টিম তাদের নাম পরিবর্তন করে আনসার আল ইসলাম ধারণ করেছে। সম্প্রতি সালাউদ্দীনের ঘোড়াসহ বিভিন্ন ওয়েবসাইটে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যদের টার্গেট করা হচ্ছে বলে বিভিন্ন সময় পোস্ট দিচ্ছে ঘাতকদল। অতিরিক্ত আইজিপি (প্রশাসন) মোখলেসুর রহমান জানান, খুনি যেই হোক তাদের আইনের আওতায় নিয়ে আসা হবেই। তবে এসপি বাবুলের স্ত্রীকে খুনের ঘটনাটি কাপুরুষোচিত। খুনিরা যদি মনে করে, এতে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যদের মনোবল ভেঙে যাবে— তা হবে তাদের মারাত্মক ভুল। পুলিশ সদস্যরা শোককে শক্তিতে রূপান্তরিত করে দ্বিগুণ উদ্যমে ঝাঁপিয়ে পড়বে অপরাধ দমনে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা বলছেন, আনসারুল্লাহ বাংলা টিম বা চাপাতি দিয়ে হত্যাকারী গ্রুপের সদস্যরা রাজধানী ঢাকায় সক্রিয় বেশি। আর জেএমবির যে ভগ্নাংশটি গুপ্তহত্যায় লিপ্ত তারা উত্তরাঞ্চলে সক্রিয় বেশি। তবে ঢাকার বাইরে জনবহুল এলাকাগুলোতেও সক্রিয় হয়ে উঠছে তারা। জঙ্গি নিয়ে দীর্ঘদিন কাজ করে আসা কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটের প্রধান মনিরুল ইসলাম বলেন, জঙ্গি গ্রুপগুলোর সঙ্গে শিক্ষিত ও প্রযুক্তিতে দক্ষ কিছু ব্যক্তি সম্পৃক্ত হয়েছে। এ কারণে তারা খুব কৌশলে সময় নিয়ে একেকটি হামলা পরিচালনা করছে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই আমরা তাদের শনাক্ত ও গ্রেফতার করেছি। এ গ্রুপগুলোর মাস্টারমাইন্ডদের ধরতে নিয়মিত অভিযান চালানো হচ্ছে।

সর্বশেষ খবর