মঙ্গলবার, ৫ জুলাই, ২০১৬ ০০:০০ টা

গুলশান হামলা সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সমস্যা

জিন্নাতুন নূর

গুলশান হামলা সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সমস্যা

অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী

বাংলাদেশে জঙ্গি তত্পরতা বহুদিন ধরে চলছিল। তবে গত শুক্রবার গুলশানের হলি আর্টিজান রেস্তোরাঁয় হামলার মধ্য দিয়ে জঙ্গি তত্পরতা নতুন মাত্রা পেল। একে অপ্রত্যাশিত বলা গেলেও একেবারে অস্বাভাবিক বলা যাবে না। আমরা এত বড় মাত্রায় কোনো সন্ত্রাসী হামলা হবে তা আশঙ্কা করিনি, তবে সন্ত্রাসী হামলা হতে পারে এমন লক্ষণ যে ধারাবাহিকভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছিল তা টের পাচ্ছিলাম। একই সঙ্গে এ ঘটনায় কয়েকটি তরুণ কেন এই বিপজ্জনক পথে গেল তা নিয়েও আমাদের ভাবতে হবে। কারণ হামলাকারীদের অধিকাংশই বিত্তবান ঘরের এবং এরা ভালো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে শিক্ষা নিয়েছে। অর্থাৎ এ ঘটনাটি থেকে বোঝা যাচ্ছে যে, সমস্যাটি সামাজিক ও সাংস্কৃতিক। গতকাল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে শিক্ষাবিদ, প্রাবন্ধিক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী এ কথা বলেন। তিনি বলেন, এ ঘটনায় যে তরুণরা হামলা চালিয়েছে তারা খুবই সংগঠিত ছিল। এরা যে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ছিল তা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। তারা নিজেদের বাড়ি থেকে বহুদিন নিরুদ্দেশ ছিল। কাজেই বলা যায় যে, এরা ঘরে এবং বাইরে উভয় জায়গা থেকেই প্রস্তুতি নিয়েছে। তারা সংগঠিতভাবে গোপনে এ প্রস্তুতি নিয়েছে। সেখানে আমাদের রাষ্ট্রীয় সংস্থা বিশেষ করে গোয়েন্দা বিভাগ এ হামলার বিষয়ে যে অবহিত হলো না সেটি আমাদের জন্য আশঙ্কার বিষয়। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী গত কয়েক দিনে ১৩-১৪ হাজার সন্দেহভাজন মানুষকে গ্রেফতার করেছে কিন্তু তারা এই বিপথগামী তরুণদের হামলা চালানোর আগে ধরতে পারল না। এমনকি তাদের সম্পর্কে কোনো খোঁজই রাখল না। এর মাধ্যমে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দুর্বলতা প্রকাশ পেয়েছে। আমি ধারণা করছি সমাজের মধ্যে এই তরুণরা বিচ্ছিন্ন বোধ করছে। তারা এমন কিছু কাজ করতে চাচ্ছে যেটি হবে দুঃসাহসিক। যার মাধ্যমে তারা তাদের ক্ষমতা প্রকাশ করতে পারবে। এ ছাড়া সাংস্কৃতিকভাবেও সুস্থ সংস্কৃতির চর্চা আমাদের দেশে সংকুচিত হয়ে আসছে। তরুণরা এখন ফেসবুক ও ইন্টারনেট এগুলোর মধ্যেই আবদ্ধ থাকে। সামাজিকভাবে এই তরুণরা যে অন্যদের সঙ্গে মিশবে, বড় জায়গায় যাবে, খেলাধুলা করবে এবং সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে যুক্ত হবে তা হচ্ছে না। এমনকি তারা যে প্রতিষ্ঠানগুলোয় শিক্ষা পেয়েছে সেখানেও এ বিষয়গুলো নেই। ফলে তাদের সাংস্কৃতিক জীবন সংকুচিত এবং তারা সামাজিকভাবেও বিচ্ছিন্ন। অর্থাৎ একদিকে নতুন প্রজন্মের সাংস্কৃতিক ভিত্তি দুর্বল অন্যদিকে তাদের বিচ্ছিন্নতাবোধও প্রবল হয়ে উঠছে। এর ফলে এরা বড় ও দুঃসাহসিক কাজের দিকে ঝুঁকছে এবং কোন কাজটি ভালো এবং কোনটি মন্দ তা বিচার করতে পারছে না। এ কারণে তারা নিজেদের লক্ষ্যও স্থির করতে পারছে না। শিক্ষাবিদ সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, তরুণদের সাংস্কৃতিকভাবে সমৃদ্ধ করার জন্য দেশে কোনো সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান নেই। এ সমাজে আমরা তরুণদের গান-নাটক ও খেলাধুলা ইত্যাদি সৃজনশীল কর্মকাণ্ডে উৎসাহিত করছি না। এর কারণে সাংস্কৃতিক ও সামাজিকভাবে তাদের পরিসর ছোট হয়ে যাচ্ছে। এর সঙ্গে নেতিবাচক ও ধ্বংসাত্মক কাজের জন্য তরুণদের প্ররোচনা দেওয়া হচ্ছে। আর বিপথগামী তরুণরা ভালোমন্দের বিচার না করে ধরে নিয়েছে যে প্ররোচনাদানকারীদের দেখানো পথই সঠিক পথ। যদিও এই পথটি ভুল, কিন্তু এই পথটিকেই তারা সঠিক বলে মনে করছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে তাদের রাজনৈতিক লক্ষ্য। এই তরুণরা মনে করছে যে, এই রাষ্ট্রব্যবস্থা যথার্থ নয়। তারা একটা খেলাফত রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে চায়। যে কথাটি আন্তর্জাতিকভাবে জঙ্গিরা এখন প্রচার করতে চাইছে। বিশ্বব্যাপী আমরা এখন রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহার দেখতে পাচ্ছি। একপক্ষ এটি যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশের সময় থেকে শুরু করেছে। তখন তারা ক্রুসেডের কথা শুরু করে। আবার এখন জিহাদের কথা বলা হচ্ছে। অর্থাৎ ক্রুসেড ও জিহাদ এ দুই ইস্যুতেই ধর্মের ব্যবহার হচ্ছে। আর দিকভ্রান্ত তরুণরাও জিহাদকে মনে করছে একমাত্র পথ যার মাধ্যমে তারা পরবর্তী জীবনে সার্থকতা পাবে। অর্থাৎ এর মাধ্যমে তারা বেহেস্তে চলে যাবে। অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, জঙ্গি হামলার প্রস্তুতি শুধু দেশের ভিতরেই নয় বাইরে থেকেও যে আসছে তা বুঝতে পারছি। সাম্প্রতিক সময় বিভিন্ন ওয়েবসাইটে প্রাপ্ত তথ্য থেকে আমরা জানতে পেরেছি যে, জঙ্গিরা এখন বাংলাদেশকে তাদের এলাকার মধ্যে নিয়ে এসেছে এবং এখানে তারা তত্পরতা চালাবে। তবে সিরাজুল ইসলাম মনে করেন শুধু বলপ্রয়োগ করে সমাজ থেকে এ ধরনের গুরুতর সমস্যার সমাধান করা সম্ভব নয়। অপরাধী গ্রেফতার করে বা কয়েকজনকে শাস্তি দিয়ে এর প্রতিকার মিলবে না। বরং সামাজিক ও সাংস্কৃতিক লালনভূমির যে জায়গা সেটিকে পরিষ্কার করতে হবে। তার মতে, এ জায়গাগুলোয় বন্ধ্যত্ব এসেছে একে উর্বর করতে হবে। তা না হলে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হবে। কারণ গুলশানের ঘটনায় ছয় জঙ্গি সম্পৃক্ত ছিল। এরই মধ্যে হয়তো আরও বহু তরুণ ঘর থেকে বেরিয়ে পড়েছে এবং তারা এখন কী করছে তা জানা নেই। এখনই ব্যবস্থা না নিলে এই বিপথগামী তরুণদের দ্বারা অন্য তরুণরাও অনুপ্রাণিত হতে পারে। এজন্য আমাদের তরুণদের জন্য সুস্থ ও স্বাভাবিক জীবনযাপনের ব্যবস্থা করতে হবে। এদের যে বিচ্ছিন্নতা তা দূর করতে হবে এবং তরুণদের মানসিক বিকাশে সমাজের জন্য মঙ্গলজনক আদর্শবাদকে উৎসাহিত করতে হবে।

সর্বশেষ খবর