বৃহস্পতিবার, ২ ফেব্রুয়ারি, ২০১৭ ০০:০০ টা

পর্যটনসমৃদ্ধ লেবাননে বিশ্বে বিরল রাজনৈতিক সমঝোতা

শিমুল মাহমুদ, বৈরুত (লেবানন) থেকে

পাহাড় ও সমুদ্রের তীরে গড়ে ওঠা ছোট্ট রাষ্ট্র লেবাননে আরববিশ্বের অন্যসব দেশের মতো প্রাকৃতিক সম্পদ বলতে কিছু নেই। একাধিকবার যুদ্ধের কবলে পড়া লেবাননের অর্থনীতির মূল চালিকা শক্তি পর্যটন। প্রায় ১০ হাজার ৪৫২ বর্গকিলোমিটার আয়তনের দেশটিতে ৪০ লাখ মানুষের বাস। লেবাননের  প্রায় ১০ লাখ নাগরিক বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ব্যবসা-বাণিজ্য করছে। নেতৃত্ব দিচ্ছে বিশ্বের বড় বড় বহুজাতিক কোম্পানি। ফলে পর্যটনের পর রেমিট্যান্স তাদের জাতীয় আয়ের অন্যতম একটি খাত। মাথাপিছু আয় ১৬ হাজার ডলারের বেশি। সামারে লাখ লাখ পর্যটকের কোলাহলে মুখর থাকে লেবাননের পথঘাট। ইউরোপীয় পর্যটকরা দলবেঁধে আসে এখানে। আসে মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশের ধনাঢ্য ব্যবসায়ীরা। আসে আরবের বিভিন্ন পর্যায়ের শেখরা। তারা পুরো লেবানন জুড়ে অসংখ্য নিজস্ব প্রাসাদ গড়ে তুলেছেন। বছরে একাধিকবার এসে সেসব প্রাসাদে সময় কাটান। ভাষাগত নৈকট্য এর একটা বড় কারণ। লেবাননের সরকারি ভাষা আরবি, এ ছাড়া ফ্রেন্স, ইংরেজিও চলে সমানতালে। এখানে তাদের অবকাশ কাটানোর সঙ্গী হিসেবে লেবানিজ তরুণীদের সঙ্গ পান তারা। এসব প্রাসাদ ও ভবন সারা বছর প্রায় খালিই পড়ে থাকে। নামে মুসলিম দেশ হলেও সংস্কৃতিতে পশ্চিমাদের চেয়েও অগ্রসর। রবিবার ও অন্যান্য সরকারি ছুটির দিনে দলবেঁধে রাস্তায় বেরিয়ে পড়ে লোকজন। গান গায়, সিসা খায়। সিসা নামের হুঁকা লেবাননের তরুণ তরুণীদের অনেক পছন্দের। লেবাননের সাহিত্যের সবচেয়ে বড় তারকা ‘দি প্রফেট’ খ্যাত খলিল জিবরানকে নিয়ে অসম্ভব গর্ব করেন তারা। মধ্যপ্রাচ্য ও অন্য আরব দেশের মতো অভ্যন্তরীণ হানাহানিতে নেই লেবানিজরা। আরব দেশ হলেও লেবাননে রাজতন্ত্র কিংবা পরিবারতন্ত্র নেই। এখানে খ্রিস্টান ও মুসলমানরা নজিরবিহীন সমঝোতার মাধ্যমে সরকার পরিচালনা করে ধর্মীয় সংখ্যানুপাতের ভিত্তিতে। ফলে, রাজনীতি নিয়ে লেবাননে কোনো সংকট নেই। ধর্ম নিয়েও সংঘাত নেই। সরকারে ও সমাজে খ্রিস্টানদের সঙ্গে মিলেমিশে আছে মুসলিমরা। পারস্পরিক সম্প্রীতির এমন নজির বিশ্বে বিরল। দেশটির আইনানুসারে প্রেসিডেন্ট হবেন একজন ম্যারোনেইট খ্রিস্টান, প্রধানমন্ত্রী হবেন সুন্নি মুসলমান, স্পিকার হবেন শিয়া মুসলমান। এখানকার সংসদীয় আসনগুলো মুসলমান এবং খ্রিস্টানদের মধ্যে সমানভাগে ভাগ করা। দেশের সংসদ চার বছরের জন্য নির্বাচিত হয়। সংসদ দুই-তৃতীয়াংশ ভোটে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত করে। পরে প্রেসিডেন্ট প্রধানমন্ত্রী নির্বাচন করেন। নৃতাত্ত্বিক তথ্য-প্রমাণ অনুযায়ী, লেবাননের সাত হাজার বছরের পুরনো অতীত রয়েছে। একে একে অনেকেই শাসন করেছে লেবাননকে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর লেবাননের দায়িত্ব দেওয়া হয় ফ্রান্সের ওপর। ফরাসি উপনিবেশ থেকে ১৯৪৩ সালে এটি স্বাধীনতা লাভ করে। ১৯৭৫-৯০ সালের গৃহযুদ্ধের আগ পর্যন্ত দেশটিতে বিরাজ করছিল শান্তি ও সমৃদ্ধির অবস্থা। পর্যটন, কৃষি, ব্যাংকিং ইত্যাদি নিয়ে বেশ ভালো সময়ই কাটায় লেবানন। বলা হতো সুইজারল্যান্ডের মতোই পূর্ণ বিকাশ ঘটেছিল লেবাননে। তবে সংঘাত সহিংসতা যা আছে তা পার্শ্ববর্তী দেশ ইসরায়েলের সঙ্গে। ইসরায়েল একাধিকবার সশস্ত্র হামলা চালায় লেবাননে। বর্তমানে জাতিসংঘের তৎপরতায় দেশটিতে স্বস্তির পরিবেশ রয়েছে। লেবাননের সবচেয়ে শক্তিশালী সশস্ত্র সংগঠন হিজবুল্লাহ গত কয়েক বছর ধরে নীরব। এদিকে জাতিসংঘের খবরদারিতে লেবাননে ইসরায়েল তার আগ্রাসন বন্ধ রেখেছে। লেবানরে সবচেয়ে উঁচু পাহাড়ি এলাকা ফারায়ায় শীতের পুরো সময় বরফে ঢেকে যায় ঘরবাড়ি, রাস্তাঘাট। অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে মানুষের জীবনযাত্রা। কিন্তু পর্যটকরা সেই বরফ দেখতে গিয়ে অনাবিল আনন্দ লাভ করে। অনেকে বরফের মধ্যে স্কি করে। সপরিবারে গিয়ে উপভোগ করে। জৈয়িতা নামের হাজার বছরের পুরনো গুহাটি তারা সংরক্ষণ করছে পর্যটকের দর্শনীয়স্থান হিসেবে। সেখানে পাহাড়ের ভিতরে প্রাকৃতিকভাবে এমন দৃষ্টিনন্দন লাইমস্টোন তৈরি হয়েছে যা দর্শনার্থীদের অভিভূত করে। ২০০৬ সালের যুদ্ধের আগে লেবাননে ছিল স্থিতিশীল অবস্থা। যুদ্ধের পর বৈরুত তার পুরনো ক্ষতগুলো মুছে ফেলতে প্রায় পুরোপুরি সক্ষম হয়। লাখো পর্যটক আবারও বিমোহিত হতে শুরু করেছিল লেবাননের সৌন্দর্যে। লেবাননের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি পর্যটকও বেড়াতে যায় গত বছর। লেবাননের সুন্দর আবহাওয়া, অগণিত ঐতিহাসিক দর্শনীয় স্থান প্রতি বছরই পর্যটককে টানে লেবানন ভ্রমণে। পর্যটন থেকেই লেবাননের অর্থনীতি বিকশিত হয়। জনগণ খুঁজে নেয় তাদের আয়ের রাস্তা। লেবাননের পর্যটন খাতে দেশটির জনশক্তির মোট ৬৫ শতাংশ জড়িয়ে আছে। মোট আয়ের ৬৭ শতাংশ আসে এই পর্যটন খাত থেকেই। যুদ্ধের সময়টায় পর্যটন একেবারেই বন্ধ হয়ে যায়। এ ছাড়া লেবাননের আয়ের ক্ষেত্রে রেমিট্যান্স এখন উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখছে। গত বছর এর পরিমাণ ছিল ৫ দশমিক ৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, যা দেশটির মোট আয়ের এক-পঞ্চমাংশ। লেবানন ইউরোপ এবং আরব দেশগুলোতে প্রচুর দক্ষ শ্রমিক পাঠিয়ে থাকে।

সর্বশেষ খবর