বৃহস্পতিবার, ১৬ মার্চ, ২০১৭ ০০:০০ টা

বঙ্গবন্ধুর ভাষণ ছিল মুক্তিযুদ্ধেরই আহ্বান

কর্নেল জাফর ইমাম, বীরবিক্রম

বঙ্গবন্ধুর ভাষণ ছিল মুক্তিযুদ্ধেরই আহ্বান

১৯৭০ সালে আমি পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ক্যাপ্টেন পদে কর্মরত ছিলাম। ৭০-এর শেষ দিকে পূর্ব পাকিস্তানে বদলি হয়ে আসি। পোস্টিং ছিল কুমিল্লায়।

আমি পাকিস্তান আর্মির ২৫ মার্চ ক্রাকডাউনের কয়েকদিনের মধ্যে ঢাকা পুরান এয়ারপোর্ট থেকে পালিয়ে ক্যাপ্টেন আকবর, ক্যাপ্টেন সালেক, আমিনুল হকসহ আমরা চারজন পদাতিক অফিসার মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেই।  যখনই চেতনার কথা চিন্তায় আসে, তখনই স্মৃতির পাতায় ভেসে আসে সেই যুদ্ধকালীন দিনগুলো। সেদিন বাংলার দামাল ছেলেরা জীবনবাজি রেখে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। আর আমি তাদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যুদ্ধ করেছি, রণাঙ্গনে তাদের নেতৃত্ব দিয়েছি। লক্ষ্য একটাই দেশকে শত্রুমুক্ত করে স্বাধীনতা অর্জন করব। তাই এ যুদ্ধ ছিল আমাদের গর্ব ও অহংকারের। আমরা চেয়েছিলাম নিজেদের হাতে দেশকে গড়ে তুলব। সেখানে থাকবে না কোনো হিংসা-বিদ্বেষ, হানাহানি। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণে উদ্বুদ্ধ হয়ে জাতি-দল-মত নির্বিশেষে এক কাতারে দাঁড়িয়েছিল। (স্বাধীনতা বিরোধীরা ছাড়া)। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ ছিল মুক্তিযুদ্ধেরই আহ্বান। বঙ্গবন্ধু সাড়ে সাত কোটি বাঙালিকে আহ্বান জানিয়েছিলেন, শত্রুর মোকাবিলায় পাড়ায় পাড়ায় আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সংগ্রাম পরিষদ গড়ে তুলতে। এই মন্ত্রে দীক্ষিত বাঙালি জাতি চূড়ান্ত বিজয় অর্জনে তার নেতৃত্বে একটি স্বপ্ন বাস্তবায়নে সংকল্পবদ্ধ ছিল। তারই অনুপ্রেরণায় যুদ্ধের দিনগুলোতে আমরা হাজারো মায়ের কান্না, শিশুর আর্তনাদ ও বোনের হাহাকারের শোধ নিতে শত্রুর মোকাবিলা করেছিলাম। অনেকে আজ ইতিহাস বিশ্লেষণ করতে গিয়ে বলেন, বঙ্গবন্ধুকে যদি প্রধানমন্ত্রী হিসেবে পাকিস্তান মেনে নিত তাহলে স্বাধীনতা যুদ্ধ হতো না বা প্রয়োজন ছিল না। তাদের এই মূল্যায়ন সঠিক নয়। কারণ ’৭০-এর নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনের পর পাকিস্তান শাসকগোষ্ঠী সময়ক্ষেপণ ও তালবাহান না করে গণতান্ত্রিক ধারায় ও রীতিনীতি অনুযায়ী যদি ক্ষমতা হস্তান্তর করতেন তাহলে বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হতেন। তবে, অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছতে সংগ্রামের দীর্ঘ পথ আরও কিছুটা অতিক্রম করতে হতো। বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে বাংলার মানুষের অধিকার সংরক্ষিত রেখে পুরো পাকিস্তানের ওপর তার কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতেন। তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী উপলব্ধি করলেন—তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান বর্তমান বাংলাদেশ পরোক্ষভাবে সর্বাত্মক বাড়তি সুযোগ-সুবিধা ভোগ করবে এবং  অঘোষিতভাবে একটি স্বতন্ত্র জাতীয় সত্তা বিকশিত হয়ে স্বতন্ত্র রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ সময়ের অপেক্ষায় থাকবে। এ পরিস্থিতিতে তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানের প্রদেশগুলোতে (পাঞ্জাব, ফন্ট্রিয়ার, সিন্ধু, বেলুচিস্তান) একে অন্য থেকে পৃথক হয়ে যাওয়ার আওয়াজ উঠবে। তখনো কিন্তু উল্লিখিত এই প্রদেশ ও অঞ্চলগুলোর ওপর পাঞ্জাব প্রদেশের তথা পাঞ্জাবিদের রাজনৈতিক/অর্থনৈতিক কর্তৃত্ব একতরফা ছিল। সেই মুহূর্তে বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করলে তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানের এই অঞ্চলগুলো থেকেও বৈষম্যের বিরুদ্ধে সেখানকার জনগণ প্রতিবাদী হওয়ার জন্য উৎসাহিত হতেন। এতে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান তথা বর্তমান বাংলাদেশ ছাড়া অবশিষ্ট পাকিস্তান ভেঙে টুকরো টুকরো হযে যাবে। এই বাস্তব উপলব্ধিতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী/ভুট্টো গংরা ক্ষমতা হস্তান্তর না করার সিদ্ধান্ত ’৭০-এর নির্বাচনের পরপরই নিয়েছিলেন। কোনো অবস্থাতেই বঙ্গবন্ধুর হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করা যাবে না অর্থাৎ পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর কর্তৃত্ব দেওয়া যাবে না। এই সিদ্ধান্ত আগ থেকে তারা মনে লালন করে আসছিলেন। সেই জন্য তারা গভীর ষড়যন্ত্রের নীল-নকশা অনুযায়ী আমাদের জাতীয় সত্তা বিকশিত হওয়ার সুযোগ না দিয়ে সর্বক্ষেত্রে পঙ্গু করে তাদের অধীনস্ত একটি কলোনিতে পরিণত করার জন্য সর্বাত্মক প্রস্তুতি প্রায়ই সম্পন্ন করে ফেলেছেন। তাই বঙ্গবন্ধু প্রধানমন্ত্রী হলে স্বাধীনতার যুদ্ধ হতো না বা প্রয়োজন ছিল না—যারা বলেন তাদের এই ধারণা ঠিক নয়। পাকিস্তানিরা সংলাপের নামে কালক্ষেপণ, তালবাহান এবং সর্বোপরি তাদের অনড় অবস্থান বঙ্গবন্ধু বুঝতে পেরেছিলেন বলেই তিনিও দেখলেন—মুক্তিযুদ্ধ অনিবার্য এবং এর বিকল্প আর কিছু নেই। তাই তো তিনি খুব কৌশলে ধাপে ধাপে মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতির দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলেন। ইতিহাস মূল্যায়নে দেখা যাবে, দীর্ঘ মুক্তির সংগ্রাম ও ’৭১-এর যুদ্ধ দুটিই বঙ্গবন্ধুর দূরদর্শিতা ও তার নেতৃত্বে জনগণের ত্যাগের ফসল।

সর্বশেষ খবর