শুক্রবার, ১০ মে, ২০১৯ ০০:০০ টা
পিছনে ফেলে আসি

বরেন গঙ্গোপাধ্যায়ের গল্প

ইমদাদুল হক মিলন

বরেন গঙ্গোপাধ্যায়ের গল্প

চুয়াত্তোর সালের ফেব্রুয়ারি মাস। কলকাতা থেকে বিশাল এক লেখক দল এলেন ঢাকায়। দলপ্রধান অন্নদাশংকর রায়। তাঁর সঙ্গে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, শক্তি চট্টোপাধ্যায়, অতীন বন্দ্যোপাধ্যায় আর বরেন গঙ্গোপাধ্যায়। উঠলেন হোটেল পূর্বাণীতে। একুশে ফেব্র“য়ারির সকালবেলায় বিশাল কবিতা পাঠের আসর বসল বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে। তখনো বইমেলা বড় চেহারা নেয়নি। পাঁচ-সাতটা স্টল ঢিমেতালে চলে। বাংলা একাডেমিতে গেছি। কবিতা পাঠের অনুষ্ঠানটির সভাপতি ছিলেন বেগম সুফিয়া কামাল। আমাদের শামসুর রাহমান, আল মাহমুদ, শহীদ কাদরী, ফজল শাহাবুদ্দিন, রফিক আজাদ, আবদুল মান্নান সৈয়দ, নির্মলেন্দু গুণ, সব বড় কবির সঙ্গে সুনীল-শক্তিও কবিতা পড়লেন। শক্তিদা পড়লেন ‘অবনী বাড়ি আছো’। সুনীলদা কী একটা কবিতা পড়লেন প্রথমে, তারপর সুফিয়া কামালের অনুরোধে পড়লেন ‘কেউ কথা রাখেনি’। বরেন গঙ্গোপাধ্যায় পড়লেন দু-তিনটি ছড়া।

অনুষ্ঠান শেষ হওয়ার পর শক্তি-সুনীলের অটোগ্রাফ নেওয়ার চেষ্টা করলাম। সামনে ভিড়তেই পারলাম না, এত ভিড়। ওদিকে বরেন গঙ্গোপাধ্যায় একা দাঁড়িয়ে আছেন। আমি গিয়ে তাঁর অটোগ্রাফ চাইলাম। বেচারা নরম নিরীহ ধরনের মানুষ। আমাকে পেয়ে খুশি। অটোগ্রাফ দিতে দিতে বললেন, তুমি লেখ? এইভাবে পরিচয়। কথায় কথায় তিনি জানলেন আমি বিক্রমপুরের ছেলে। জেনে তাঁর চোখেমুখে অদ্ভুত এক আলো খেলে গেল। আরে তাই নাকি? আমিও তো বিক্রমপুরেরই লোক। বিক্রমপুরের ‘কয়কীর্তন’ গ্রামে ছিল আমাদের বাড়ি। দেশ বিভাগের সময় চলে গিয়েছিলাম। বিক্রমপুরে আর কখনো ফেরা হয়নি। আমাদের বাড়ি নিশ্চয় অন্য কেউ দখল করে নিয়েছে। বাড়িটা হয়তো চিনতেও পারব না। তারপরও যদি একবার ‘কয়কীর্তন’ গ্রামে যেতে পারতাম। আচ্ছা শোনো, সকালে গিয়ে বিকালে ‘কয়কীর্তন’ দেখে ফেরা যাবে না?

‘কয়কীর্তন’ গ্রামটা আমি চিনতাম। শ্রীনগরের কাছে। তখনো বাংলাদেশের খাল নদীতে অনেক জল। সদরঘাট থেকে সাড়ে তিন ঘণ্টায় লঞ্চ চলে যায় শ্রীনগরে। ঘণ্টায় ঘণ্টায় লঞ্চ আছে। সকাল ৭টা-৮টার দিকে রওনা দিলে সন্ধ্যায় সন্ধ্যায় ঘুরে আসা যাবে। বললাম কথাটা। শুনে তিনি খুবই উৎসাহী। তাহলে চলো কাল সকালেই যাই। সকাল ৬টার মধ্যে তুমি পূর্বাণী হোটেলে চলে আসবে। আমি রেডি হয়ে থাকব। কাল ছাড়া সময়ও নেই। পরশু আমরা কলকাতায় ফিরব।

আমি মহা উৎসাহে রাজি। পরদিন ঠিক সময়ে গিয়ে হাজির হয়েছি পূর্বাণী হোটেলে। গিয়ে দেখি তিনি মুখ কালো করে বসে আছেন। মন খারাপ করা গলায় বললেন, বুড়োটা পারমিশন দেয়নি। অন্নদাশংকর! দাদা কিছুতেই রাজি না। টিমলিডার, বললেন যদি কোনো দুর্ঘটনা ঘটে যায়! যদি টাইমলি ফিরতে না পারি ইত্যাদি ইত্যাদি। চা খাও। তিনি চা খাচ্ছিলেন। টি পট থেকে আমাকে চা ঢেলে দিলেন, দুধ চিনি মিশিয়ে দিলেন। তারপর থেকে কলকাতার যে পত্রিকাতেই তাঁর লেখা পাই, পড়ি। বেশ অন্যজাতের লেখক। এমন সব বিষয় নিয়ে গল্প লেখেন, অবাক লাগে। ভাষা বেশ স্বচ্ছ।

সে বছরের শেষদিকে ‘অমৃত’ পত্রিকায় একটা গল্প পাঠালাম। গল্পের নাম ‘জোয়ারের দিন’। অমৃতের কী একটা বিশেষ সংখ্যা বেরোবে। কয়েক সপ্তাহ ধরে কলকাতার বড় বড় সব লেখকের সঙ্গে, যেমন মুস্তাফা সিরাজ, অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়, প্রফুল্ল রায়, বরেন গঙ্গোপাধ্যায় এরকম আরও কিছু কিছু লেখকের সঙ্গে আমার নামটিও ছাপা হতে লাগল। অর্থাৎ আমার ‘জোয়ারের দিন’ও ওই বিশেষ সংখ্যায় ছাপা হবে। যথাসময়ে বিশেষ সংখ্যাটি বেরোল, সবার লেখাই আছে আমারটি নেই। পরের সপ্তাহেই গল্পটি বিশেষ মর্যাদা দিয়ে ছাপা হলো। তখন বুঝিনি, এখন বুঝি, বিশেষ সংখ্যাটিতে জায়গা হয়নি দেখে আমার লেখাটি বাদ পড়েছিল। কমল চৌধুরী নামে এক ভদ্রলোক চিঠি লিখে আমাকে পরে সেটা জানিয়ে ছিলেন। তিনি অমৃত পত্রিকার সহকারী সাহিত্য সম্পাদক। মূল সাহিত্য সম্পাদক কবি মনীন্দ্র রায়। কমল চৌধুরীর সঙ্গে পরে কলকাতায় আমার দেখা হয়েছে, মনীন্দ্র রায়ের সঙ্গে দেখা হয়নি। ‘অমৃত’ এবং ‘যুগান্তর’ দুটো পত্রিকাই পরে বন্ধ হয়ে যায়। অমৃতে আমি চারটি গল্প লিখেছিলাম।

‘জোয়ারের দিন’ নতুন করে বরেন গঙ্গোপাধ্যায়ের সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দিল। যে সপ্তাহে ‘জোয়ারের দিন’ ছাপা হলো তার দুই সপ্তাহ পর ‘অমৃত’ পত্রিকার চিঠিপত্রের পাতায় বরেন গঙ্গোপাধ্যায়ের একটা চিঠি ছাপা হলো ‘জোয়ারের দিন’ গল্পটি নিয়ে। তাতে গল্পের যে পরিমাণ প্রশংসা...

এসবের কয়েক মাস পর, পঁচাত্তোর সালের এপ্রিল-মে মাসের দিকে বরেনদা তাঁর একটা গল্পের বই পাঠালেন আমাকে। বাংলা একাডেমির এক ভদ্রলোক গিয়েছিলেন কলকাতায় তাঁর হাতে পাঠিয়েছেন। আমি বাংলা একাডেমিতে গিয়ে বইটি নিয়ে এলাম। বইয়ের নাম ‘একালের বাঙলা গল্প’। বইয়ের প্রথম গল্প ‘বজরা’। এই গল্প লিখে বরেনদা একেবারে কাঁপিয়ে দিয়েছিলেন। ‘দেশ’ পত্রিকায় প্রকাশের পর দিকে দিকে বেশ সাড়া পড়েছিল। ‘দেশ’ শারদীয়ায় তিনি উপন্যাস লিখেছিলেন ‘নিশীথফেরি’। তার আগে পড়লাম ‘পাখিরা পিঞ্জরে’ ও ‘ভালোবেসেছিলাম’। একটা ডিটেকটিভ উপন্যাস পড়লাম ‘হিমশীতল’। এসবের অনেককাল পড়ে সুন্দরবন অঞ্চলের মানুষজন নিয়ে পড়লাম তাঁর উচ্চাকাক্সক্ষী উপন্যাস ‘বনবিবি উপাখ্যান’।

এক সময় সুন্দরবন অঞ্চলের স্কুলে শিক্ষকতা করতে গিয়েছিলেন বরেনদা। বেশ কয়েক বছর সেখানে থেকে ফিরে আসেন। রেসের মাঠ ছিল তার প্রিয় জায়গা। বিমল কর অবশ্য লিখেছেন ‘খেলার মাঠ’। আর সমরেশ মজুমদার আমাকে বলেছেন, রেসের নেশা ছিল বরেনদার। সমরেশকে তিনিই রেসের মাঠ চিনিয়ে ছিলেন। যে জীবন নিয়ে সমরেশ মজুমদার লিখেছিলেন তাঁর প্রথম উপন্যাস ‘দৌড়’। বিমল করের দুটো স্মৃতিকথামূলক বই আছে। ‘আমি ও আমার তরুণ লেখক বন্ধুরা’ আর একটি হলো দুই পর্বের ‘উড়ো খই’। দুটো বইতেই বরেনদার বহু প্রসঙ্গ এসেছে। বিমল করের বিখ্যাত উপন্যাস ‘খড়কুটো’ বরেনদাকে উৎসর্গ করা হয়। তাঁরা এক সময় ‘ছোটগল্প নতুনরীতি’ নামে একটি গল্প আন্দোলন করেছিলেন, তাতে দেবেশ রায়, বরেন গঙ্গোপাধ্যায়, দীপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, দিব্যেন্দু পলিত প্রমুখ ছিলেন। অসাধারণ কিছু গল্প সে সময় লেখা হয়েছিল। একটি মাঠের এককোণে ছিল একটি ডালিম গাছ। দিনের কাজকর্ম শেষ করে বিকালবেলা সবাই এসে জড়ো হতেন ওই মাঠে। তুমূল আড্ডা হতো সাহিত্যের। শংকর চট্টোপাধ্যায় সেই আড্ডার নাম দিয়েছিলেন ‘ডালিমতলার আড্ডা’।

উপন্যাসে তেমন নাম করতে পারেননি বরেনদা। তাঁর কৃতিত্ব ছিল ছোটগল্পে। বজরা, তোপ, কানীবোষ্টমীর গঙ্গাযাত্রা, কালোজল, জব চার্ণকের কলকাতা, জুয়া, দধীচির হাড়, গোলকধাম, শনাক্তকরণ, হাত, দ্রৌপদি-এরকম কত গল্প। বাংলাদেশের চট্টগ্রামে ছিল খুবই বনেদী এক প্রকাশনা ‘বইঘর’। সেই প্রকাশনা থেকে বেরিয়েছিল বরেনদার গল্পগ্রন্থ ‘কয়েকজন অপু’। অসীম রায়ের ‘আবহমানকাল’ বইটিও বইঘর থেকে বেরিয়েছিল। আমরা মন্ত্রমুগ্ধের মতো এসব বই পড়েছি।

‘দেশ’ পত্রিকায় মাঝে মাঝে গল্প লিখতেন বরেনদা। ‘বেস্পতির এক বাবু ছিল’ নামে একটি গল্প পড়ে চমকে উঠলাম। আর একটি গল্পের কথা মনে পড়ছে ‘বনমোরগ’। দেশেই ছাপা হলো। কী সুন্দর গল্প। তারপর ধীরে ধীরে বরেনদা লেখার জগৎ থেকে সরে গেলেন। তারপর বরেনদার সঙ্গে আর একবার মাত্র দেখা হয়েছিল। নব্বইয়ের মাঝামাঝি সময়। কলকাতায় গেছি। ততদিনে সমরেশ মজুমদারের সঙ্গে গভীর বন্ধুত্ব হয়েছে। তাঁকে বরেনদার কথা বলতেই লাফিয়ে উঠলেন। আরে বরেনদা হচ্ছেন আমার গুরু। চলো তোমাকে তাঁর বাড়িতে নিয়ে যাই। পুরনো কলকাতার ছোট্ট একতলা বাড়ি। সামনে মফস্বল শহরের বাড়ির মতো একটুখানি বাগান আছে। বরেনদা চিরকুমার। ছোট ভাইয়ের সংসারে থাকেন। নিতান্তই মধ্যবিত্ত পরিবার। বসারঘরে ঢুকে আমাকে দেখিয়ে সমরেশদা বললেন, দেখো তো বরেনদা, এই ছেলেটাকে চিনতে পারো কি না।

বরেনদা ফ্যাল ফ্যাল করে আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন। চিনতে পারার কারণ নেই। সমরেশদা আমার নামটা বলার পর কী যে উজ্জ্বল হলো তাঁর মুখ। সঙ্গে সঙ্গে চিনতে পারলেন, দুহাতে আমাকে জড়িয়ে ধরলেন। আরে এসো এসো। তোমার কথা আমার মনে আছে। একদম ভুলিনি। কী সুন্দর একটা গল্প লিখেছিলে অমৃতে। ‘জোয়ারের দিন’ এর কথা তখনো তাঁর মনে আছে।

অনেকক্ষণ আড্ডা দিলাম আমরা। চা গল্প। বরেনদার ছোটভাইর স্ত্রী আপন বড়ভাইয়ের মতো আগলে রেখেছেন বরেনদাকে। শরীর তখন ভালো যাচ্ছিল না তাঁর। তখন কলকাতায় বইমেলা চলছে। বরেনদা বললেন, তোমরা কাল বিকালে মেলায় থেকো, আমি আসবো। খুব আড্ডা দেওয়া যাবে। পরদিন আমি সাহিত্যমের স্টলে বসে আছি। পাঠক কেমন কেমন করে জেনেছেন আমি বাংলাদেশের লেখক। তাঁদের আগ্রহ হয়েছে। ছোটখাটো একটা ভিড়ও লেগেছে। সেই ভিড়ের মধ্য থেকে আমি আর বেরোতেই পারলাম না। বরেনদাও যেন কোনো এক স্টলে আটকে গেছেন। কোথায় আড্ডা, কোথায় কী, আমাদের আর দেখাই হলো না। দেখা হলো না তো, হলোই না। এই জীবনেই আর দেখা হলো না। কয়েক বছর আগে বরেনদা চলে গেলেন, আমি টেরও পেলাম না। বরেনদার সেই বই ‘একালের বাংলা গল্প’ এখনো আমার কাছে আছে। হঠাৎই কোনো কোনোদিন বইটা একটু বের করি, একটু নেড়েচেড়ে দেখি। সেই বই থেকে সময় অতিক্রম করে ভেসে আসে কিছু অসাধারণ গল্পের সুবাস। সেই সুবাসে মন ভালো হয়ে যায়।

সর্বশেষ খবর