বৃহস্পতিবার, ১৩ জুন, ২০১৯ ০০:০০ টা

ওয়াশিংটনে বাংলাদেশ ভবন রাষ্ট্রদূতের কিচেন

পাঁচ বছরেও সংস্কার না করে থাকেন ৮ হাজার ডলারের ভাড়া বাড়িতে, ৫ লাখ ডলার গচ্চা

লাবলু আনসার, নিউইয়র্ক থেকে

ওয়াশিংটনে বাংলাদেশ ভবন রাষ্ট্রদূতের কিচেন

তিন মিলিয়ন ডলার বরাদ্দের পর পাঁচ বছরেও সংস্কার করা হয়নি ওয়াশিংটনে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতের বসবাসের জন্য ক্রয় করা নিজস্ব ভবনটির। মেরিল্যান্ডে বেথেস্ডায় ৪ হাইবরো কোর্টে অবস্থিত বাড়িটিকে ব্যবহার করা হচ্ছে ‘রান্নাঘর’ হিসেবে। ফলে নিজস্ব ভবন থাকার পরও রাষ্ট্রদূতের বাসা ভাড়া বাবদ প্রতি মাসে বাংলাদেশ সরকারকে গুনতে হচ্ছে ৮ হাজার ডলার। গত পাঁচ বছরে এ বাবদ সরকারের ব্যয় হয়েছে ৪ লাখ ৮০ হাজার ডলার (প্রায় ৪ কোটি টাকা)। অপরদিকে, রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন বাড়িটি পরিত্যক্ত থাকায় ক্রমান্বয়ে তা জরাজীর্ণ হয়ে পড়ছে। এ ধরনের অপচয় আর অনিয়ম ওয়াশিংটনে বাংলাদেশ দূতাবাসে যেন ‘নিয়মে’ পরিণত হয়েছে। রীতি অনুযায়ী, অর্ধ ডজন কর্মকর্তা সেখানে রয়েছেন পাঁচ বছরের অধিক সময় ধরে। তবে অভিযোগ রয়েছে, অর্পিত দায়িত্ব পালনে অনেক কর্মকর্তারই অনীহা। কোনো কাজ না হওয়া বা না করার পেছনে তারা দোহাই দেন সরকারের উচ্চ মহলের। এ অবস্থায় যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক উন্নয়নের প্রত্যাশা কতটা পূরণ হচ্ছে সে প্রশ্নও রয়েছে বিদগ্ধ প্রবাসীদের মধ্যে। অনুসন্ধানকালে জানা গেছে, শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর তারই আগ্রহে নিজস্ব ভবন ক্রয় করা হয় মেরিল্যান্ডে। সেটি ‘বাংলাদেশ হাউস’ হিসেবে পরিচিত। রাষ্টদূতরা সেখানে বসবাস করেছেন। তবে ২০১৪ সালের জুলাইয়ে যোগদানের সময়েই বর্তমান রাষ্ট্রদূত মোহাম্মদ জিয়াউদ্দিন ভাড়া বাড়িতে ওঠেন। কারণ হিসেবে দেখানো হয়, নিজস্ব বাড়িটি বসবাসের যোগ্য নয়, সেটি মেরামত অথবা পুনর্নির্মাণ করতে হবে। সেই প্রস্তাব অনুযায়ী ৩ মিলিয়ন ডলারের প্রাক্কলন তৈরি করা হয়। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পথ পেরিয়ে অর্থ মন্ত্রণালয় সে অর্থ মঞ্জুর করে যথাসময়েই। এরপর বাড়িটি পুনর্নির্মাণের জন্য ঠিকাদার নিয়োগের বিজ্ঞাপন দেওয়া হয় গণমাধ্যমে। তবে আজ অবধি বাড়িটি সংস্কারের কোনো উদ্যোগ দৃশ্যমান হয়নি। দূতাবাসে অথবা রাষ্ট্রদূতের বাসায় বড় কোনো পার্টি হলে রান্না করা হয় ওই বাড়িতে। ভাড়া বাড়ি হিসেবে বর্তমানে রাষ্ট্রদূত বসবাস করছেন মেরিল্যান্ডেই পটোম্যাকে ৯ অ্যালাওয়ে কোর্টে। প্রবাসীরা বলছেন, নিজস্ব বাড়িটি মেরামত বা পুনর্নির্মাণ করা হলে মাসে এতগুলো ডলার ভাড়া গুনতে হতো না। বছরের পর বছর রাষ্ট্রীয় অর্থ অপচয় হতো না।

এ ছাড়া নিউইয়র্কে নিজস্ব ভবনে বাংলাদেশ কনস্যুলেট অফিস স্থাপনের একটি নির্দেশ গত এক দশকেও বাস্তবায়িত করতে সংশ্লিষ্টদের মধ্যে কোনো উদ্যোগ দেখা যায়নি। প্রধানমন্ত্রী নিউইয়র্কে গেলেই তাকে জানানো হয়, বাড়ি খোঁজা হচ্ছে। সর্বশেষ নতুন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে এ মোমেনের আন্তরিক আগ্রহে জাতিসংঘের শহর ম্যানহাটনে কয়েকটি বাড়ির সন্ধান মিললেও ‘মূল্য অস্বাভাবিক বেশি’ বলে কোনো কোনো আমলার পরামর্শে সে উদ্যোগে ভাটা পড়েছে। জানা গেছে, ভাড়া বাড়িতে কনস্যুলেট থাকলে ঢাকার অনেক আমলার পকেট ভারি হওয়ার পথ সুগম থাকে। স্থায়ী ভবন হলে সে সুবিধা চিরতরে বন্ধ হয়ে যায়। তাই আমলারা নিজস্ব ভবন ক্রয়ে নানা প্রসঙ্গ টেনে আপত্তি দেখান। প্রবাসীরা বলছেন, নিউইয়র্ক সবচেয়ে বেশি বাংলাদেশি অধ্যুষিত একটি এলাকা। কনস্যুলেট সার্ভিস প্রদানের মাধ্যমে প্রতি বছরই মোটা অঙ্কের অর্থ রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা হচ্ছে। এখানে নিজস্ব একটি ভবন থাকলে সেখানে কনসাল জেনারেলের অফিসের পাশাপাশি মিলনায়তন, লাইব্রেরি এবং মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর হতে পারে। সঙ্গে থাকতে পারে সোনালি এক্সচেঞ্জ এবং বিমানের কান্ট্রি ম্যানেজারের অফিসসহ প্রবাসীদের প্রয়োজনীয় সব কাজের দফতর। এ ধরনের বাড়ির মূল্য যত বেশিই হোক, তা উঠে আসতে সময় লাগবে না। উল্টো তা এক সময় লাভজনক ভবনে পরিণত হবে। প্রসঙ্গত, বিএনপির আমলে জাতিসংঘের প্রবেশ মুখে টার্কিশ ভবনে বাংলাদেশ মিশন ছিল। সেই ভবন ক্রয়ের একটি উদ্যোগ নিয়েছিলেন সে সময়ের স্থায়ী প্রতিনিধি ড. ইফতেখার চৌধুরী। মূল্য বেশি অজুহাত দেখিয়ে বিএনপির অর্থমন্ত্রী সাইফুর রহমান সে প্রস্তাব নাকচ করে দেন। এর কয়েক মাস পরই ভবনটি বিক্রি হয়ে যায় ৫ মিলিয়ন ডলার বেশি দামে। এ ছাড়া বাংলাদেশ মিশনের অফিসের জন্য যে ফ্লোর ক্রয় করা হয়েছে তাতে প্রতি মাসে বাংলাদেশের সাশ্রয় হচ্ছে ১২ হাজার ডলার। সম্প্রতি লসএঞ্জেলেসে কনস্যুলেটের নিজস্ব ভবন এবং কনসাল জেনারেলের জন্য নিজস্ব ভবন ক্রয়ের একটি প্রক্রিয়া চূড়ান্ত হয়েছে বলে জানা গেছে। সেই ভবন ক্রয়ের ব্যাপারে ঢাকা থেকে দলে দলে লোক সেখানে পৌঁছায় মূল্য যাচাইসহ অন্যান্য বিষয় দেখতে। গত মাসের শেষ দিকে রাষ্ট্রদূত জিয়াউদ্দিনের নেতৃত্বে তিন কর্মকর্তাও লসএঞ্জেলেস সফর করেন। তবে শেষ পর্যন্ত ভবনটি কেনা হবে কিনা তা জানা যায়নি। এদিকে দূতাবাস ভবনে বঙ্গবন্ধু মিলনায়তনের প্রবেশমুখেই নির্মাণ করা হয়েছে বঙ্গবন্ধুর আবক্ষ মূর্তি। সেটির নির্মাণ ব্যয় নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে দূতাবাসের কর্মকর্তাদের মধ্যে। এসব প্রসঙ্গে রাষ্ট্রদূত মোহাম্মদ জিয়াউদ্দিনের বক্তব্য জানতে চেষ্টা করা হলেও টেলিফোনে তাকে পাওয়া যায়নি। মেসেজ দেওয়া হয় ডিসিএম মাহবুব হাসান সালেহর কাছে। তিনিও কলব্যাক করেননি।

জানা গেছে, ওয়াশিংটন ডিসিতে রাষ্ট্রদূত হিসেবে তিন বছরের জন্য নিয়োগ করা হয় মোহাম্মদ জিয়াউদ্দিনকে। পরে দুই বছর বাড়ানো হয় মেয়াদ। তা সমাপ্ত হবে আসছে জুলাইয়ে। মেয়াদ বৃদ্ধির কোনো সম্ভাবনা নেই বলে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নির্ভরযোগ্য একাধিক সূত্রে জানা গেছে। তবে রাষ্ট্রদূতের মেয়াদ শেষ হলেও মোহাম্মদ জিয়াউদ্দিন যুক্তরাষ্ট্রেই স্থায়ীভাবে বসবাস করবেন বলে তার ঘনিষ্ঠজনরা ইঙ্গিত দিয়েছেন। কারণ, তার পুত্র-কন্যারা সেখানেই বসবাস করছেন।

এদিকে বিদেশে কর্মরত রাষ্ট্রদূত, কর্মকর্তাদের নিয়োগ-বদলি নিয়ে ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগ পুরনো। নিয়মনীতি অনুসরণ না করেই কর্মকর্তাদের পোস্টিং ও চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেওয়া হয়। জেনেভা, বার্লিন ও কুয়ালালামপুরে কর্মরত তিনজন রাষ্ট্রদূতই চুক্তিভিত্তিক নিয়োগে আছেন। মস্কোতে রাষ্ট্রদূত চুক্তিতে আছেন নয় বছর ধরে। এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্র, জর্ডান, অস্ট্রিয়া, পোল্যান্ড, ডেনমার্ক, মেক্সিকো, নেপাল, কাতার, বেলজিয়াম, সংযুক্ত আরব আমিরাতে দায়িত্বরত রাষ্ট্রদূতগণ পাঁচ বছর বা বেশি সময় ধরে আছেন। অথচ সরকারি নিয়মানুযায়ী কোনো কর্মকর্তাকে একই কর্মস্থলে তিন বছরের বেশি রাখা যাবে না। এমনও রাষ্ট্রদূত আছেন যারা একই সঙ্গে চারটি দেশে কাজ করেছেন। ১০ থেকে ১৫ বছর ধরে বিদেশে আছেন এমন কর্মকর্তার সংখ্যা অনেক। জানা গেছে, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের প্রায় ৬০ জন রাষ্ট্রদূত ও হাইকমিশনারের মধ্যে অর্ধেকই মেয়াদোত্তীর্ণ। তিন বছরের বেশি সময় ধরে রাষ্ট্রদূতের দায়িত্বে আছেন প্রায় ৩০ জন কর্মকর্তা। কেউ আবার নয়-দশ বছর ধরে একই দেশে রাষ্ট্রদূতের দায়িত্ব পালন করছেন। এ নিয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে এ মোমেন গত সোমবার এক প্রেস ব্রিফিংয়ে তিন বছরের বেশি সময় ধরে দায়িত্বরত রাষ্ট্রদূতদের বদলির ঘোষণা দিয়ে বলেন, এখনো আমরা রাষ্ট্রদূত পর্যায়ে বড় ধরনের রদবদল করিনি। এখন থেকে তিন বছরের বেশি সময়ের কর্মকর্তাদের বদলি করা হবে। অনেকে বহু বছর ধরে এক জায়গায় আছেন। সেপ্টেম্বর মাসের আগেই তাদের বদলির প্রক্রিয়া গতিশীল করা হবে। দুর্নীতি, অনিয়ম বা শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগ রয়েছে এমন কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। সম্প্রতি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ইরান ও লেবাননে কর্মরত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতকে প্রত্যাহার করে দেশে ফেরার নির্দেশ দিয়েছে। ইরানে রাষ্ট্রদূত এ কে এম মজিবুর রহমান ভূঁইয়া ও লেবাননে রাষ্ট্রদূত আবদুল মোতালেব সরকারের বিরুদ্ধে নৈতিক স্খলন ও আর্থিক অনিয়মের অভিযোগ ওঠে বেশ আগে। সিনিয়র দুই কর্মকর্তা তদন্ত করে এসব অভিযোগের সত্যতা পান।

সর্বশেষ খবর