শুক্রবার, ২১ জুন, ২০১৯ ০০:০০ টা
পিছনে ফেলে আসি

প্রিয় হেমন্ত মুখোপাধ্যায়

ইমদাদুল হক মিলন

প্রিয় হেমন্ত মুখোপাধ্যায়

আমি বড়ই হয়েছি হেমন্তের গান শুনে। সেই মেদেনীম-লের গ্রামজীবনে বিয়ে-শাদির অনুষ্ঠানে মাইকে বাজত হেমন্তের গান। ‘ও নদীরে একটি কথা সুধাই শুধু তোমারে’। দূর থেকে হাওয়ার টানে ভেসে আসে হেমন্তের মাধুর্যমাখা গান। কাছে আসে আবার দূরে চলে যায়। গ্রামের বড়দের মুখে মুখে ফিরত তাঁর গানগুলো। ‘ও আকাশ প্রদীপ জ্বেলো না’, ‘আমি দূর হতে তোমারেই দেখেছি’, ‘অলির কথা শুনে বকুল হাসে’, ‘মেঘ কালো আঁধার কালো’, ‘এই পথ যদি না শেষ হয়’। হেমন্তের গানের পথ কখনো শেষ হয়নি। আধুনিক বাংলা গানের জগৎ স্নিগ্ধ কণ্ঠের জাদুতে বহু বহু বছর মাতিয়ে রেখেছেন। আমার বয়সী এবং আমার আগের প্রজন্মের অনেকেই এখনো হেমন্তের গানে মজে আছেন। আমাদের পরবর্তী প্রজন্মও শুনছে তাঁর গান। অসাধারণ এক মন্ত্রে প্রজন্মের পর প্রজন্মকে ধরে রেখেছেন হেমন্ত। তিনি চলে গেছেন, রয়ে গেছে তাঁর অবিস্মরণীয় গানগুলো।

ছেলেবেলায় ‘উল্টোরথ’ বা এ ধরনের পত্রিকায় হেমন্তের ছবি দেখেছি। প্রথম তাঁকে দেখলাম স্বাধীনতার পর। ঢাকায় এলেন। বাংলাদেশ টেলিভিশন তাঁর একক গানের অনুষ্ঠান করল। আমার ছাত্র কামালদের বাসায় বহু মানুষ আমরা জড়ো হয়েছি সেই অনুষ্ঠান দেখতে। হেমন্ত প্রথম গান গাইলেন রবীন্দ্রনাথের ‘যৌবনসরসীনীরে...’। তারপর একের পর এক গাইলেন। একপর্যায়ে ঘোষক জানালেন, অনুষ্ঠানটি একটু এলোমেলো হয়েছে। সব শেষের গানটি চলে এসেছে সবার আগে। তাতেই বা দর্শক-শ্রোতাদের কী যায় আসে। তারা তো দেখছেন হেমন্তকে, শুনছেন হেমন্তের সুললিত কণ্ঠের গান। তারও পরে হেমন্ত সম্পর্কে অনেক কিছু জেনেছি।

১৯২০ সালে বেনারসে মামাবাড়িতে জন্মেছিলেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। ছেলেবেলা কেটেছে জয়নগরের বহেডু গ্রামে। তার পর থেকে কলকাতা। বাবা ছোট চাকরি করতেন। মা হাসিমুখে চার ছেলেকে নিয়ে সামলাতেন সংসার। হেমন্ত মেজো। বড় ভাই ছাড়া বাকি দুই ভাই তারাজ্যোতি ও অমল মুখোপাধ্যায়। অমল মুখোপাধ্যায়ও গানবাজনার লাইনে এসেছিলেন। সুবিধা করতে পারেননি। অমলের দুটো গান একসময় জনপ্রিয় হয়েছিল। ‘চুপ চুপ লক্ষ্মীটি, শুনবে যদি গল্পটি’ এবং ‘এই পৃথিবীতে সারাটি জীবন কি পেলাম বল হায়’।

ছয় ফুট দেড়ইঞ্চি লম্বা হেমন্ত কখনো ওস্তাদের কাছে গান শেখেননি। লোকমুখে শুনে শুনে গান তুলে নিতেন গলায়। টিফিন পিরিয়ডে স্কুলের ক্লাসরুমে বসে গান গাইতেন। একবার সেই গান শুনে ফেলেন অ্যাসিস্ট্যান্ট হেডমাস্টার। স্কুল থেকে প্রায় বিতাড়িত করে দিয়েছিলেন। পরে বাবা গিয়ে অনেক অনুরোধ করে সামাল দিয়েছিলেন। স্কুলজীবনের বন্ধু সুভাষ মুখোপাধ্যায়, বাংলা ভাষার এক প্রধান কবি, প্রচুর বিখ্যাত কবিতা লিখেছেন, যেমন ‘প্রিয় ফুল খেলবার দিন নয় অদ্য’। হেমন্তকে রেডিওতে নিয়ে গিয়েছিলেন সুভাষ মুখোপাধ্যায়। ১৪ বছর বয়সে রেডিওতে প্রথম গান গাইলেন হেমন্ত। কমল দাশগুপ্তর সুর। লেখা সুভাষ মুখোপাধ্যায়। ‘আমার গানেতে এলে, নবরূপ চিরন্তনী’। বাড়িতে রেডিও ছিল না। পাশের বাড়ির রেডিওতে গানটা যখন বাজে, হেমন্তের মা ছাদে দাঁড়িয়ে মুগ্ধ হয়ে সেই গান শুনেছিলেন। ডায়েরিতে লিখে রেখেছিলেন, একদিন নিশ্চয় আমার হেমন্তের নাম শচীন দেববর্মণ এবং পঙ্কজ মল্লিকের পাশাপাশি থাকবে। ১৯৩৭ সালে ম্যাট্রিক পাস করেন হেমন্ত। সে বছরই তাঁর প্রথম রেকর্ড বেরোল। ম্যাট্রিক পরীক্ষার পর বেশ কিছুদিন আগ্রায় এক মামার ওখানে ছিলেন। রোজ বিকালে সাইকেল চালিয়ে চলে যেতেন তাজমহলে। তাজমহলের সামনের চত্বরে বসে জ্যোৎস্না রাতে খোলা গলায় গান গাইতেন। তাজমহল দেখতে গিয়ে, জ্যোৎস্না রাতে আমি একবার সেই চত্বরে বসেছিলাম। তাজমহলের পিছন দিয়ে বয়ে যাওয়া যমুনা থেকে উড়ে আসছিল শাহজাহানের দীর্ঘশ্বাসের মতো উদাসী হাওয়া, আকাশ থেকে ঝরে পড়ছিল মমতাজের মতো জ্যোৎস্না, সেই পরিবেশে কোন অচিনলোক থেকে আমার কানে ভেসে এসেছিল ‘লিখিনু যে লিপিখানি প্রিয়তমারে’। মনে হলো প্রেমিক শাহজাহান তাঁর প্রিয়তমার উদ্দেশে হেমন্তর মাধ্যমে পৌঁছে দিচ্ছেন এক অনির্বচনীয় প্রেমপত্র। সেই পত্রের প্রেমগন্ধে মুগ্ধ হচ্ছেন মমতাজ। দিব্য চোখে মমতাজের মুখখানি আমি দেখতে পেয়েছিলাম।

বাবা চেয়েছিলেন হেমন্ত ইঞ্জিনিয়ার হোক। কিন্তু ইঞ্জিনিয়ারিং পড়া ছেড়ে দিয়ে হেমন্ত আঁকড়ে ধরেছিলেন হারমোনিয়াম। সাহিত্যচর্চাও করেছেন। ‘দেশ’ পত্রিকায় গল্প বেরিয়েছিল ‘একটি দিন’ নামে। ঝুল পকেটওয়ালা লম্বা সাদা শার্ট, কনুই অব্দি হাতা গুটানো, সাদা ধুতি আর চপ্পল পরা, ট্রামে বাসে চড়া এক সাধারণ বাঙালি, কিন্তু অত্যন্ত সুদর্শন, সুপুরুষ হেমন্ত একাকী বাঙালি কালচারের অনেকখানি দখল করে আছেন। স্ত্রী বেলা মুখোপাধ্যায় একসময় গান গাইতেন। পুত্র বাবু কলকাতা ও বোম্বের বিখ্যাত নায়িকা মৌসুমীর বর। কন্যা রানু বেশ কয়েকটি পপ গান গেয়ে হিট হয়েছিলেন। ‘পুষিবর পুষিবর’ রানুর গলায় বেশ মানিয়েছিল। হেমন্ত মুখোপাধ্যায় মানে আধুনিক বাংলা গানের রবীন্দ্রনাথ। রবীন্দ্রনাথকে বাদ দিয়ে যেমন বাংলা সাহিত্যের কথা ভাবা যায় না, হেমন্তকে বাদ দিয়ে আধুনিক বাংলা গানের কথা ভাবা যায় না। এমনকি রবীন্দ্রসংগীতের কথাও নয়।

হেমন্তর প্রথম রবীন্দ্রসংগীতের রেকর্ড ‘কেন পান্থ এ চঞ্চলতা’। সেভেনটি এইট আর পি এম রেকর্ডটির অন্য পিঠে ছিল ‘আমার আর হবে না দেরি’। লতা মঙ্গেশকরের মতো শিল্পীকে দিয়েও রবীন্দ্রসংগীত গাইয়েছিলেন হেমন্ত। সঙ্গে নিজে ডুয়েট গেয়েছিলেন ‘তোমার হলো শুরু আমার হলো সারা’। রবীন্দ্রনাথের ‘দিনের শেষে ঘুমের দেশে’ কবিতা সুরে বেঁধেছিলেন পঙ্কজ কুমার মল্লিক। সেই গানটি কী অসাধারণ গাইলেন হেমন্ত। কিছু রবীন্দ্রসংগীত তো হেমন্ত ছাড়া ভাবাই যায় না। ‘প্রাঙ্গণে মোর শিরিষ শাখায়’, ‘ওগো নদী আপন বেগে’, ‘যখন পড়বে না মোর পায়ের চিহ্ন’, কিংবা তরুণ মজুমদারের মিষ্টিপ্রেমের ছবি, শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের মৃত্যুর পরে প্রকাশিত উপন্যাস ‘দাদার কীর্তি’র সেই জনপ্রিয় রবীন্দ্রসংগীত ‘চরণ ধরিতে দিও গো আমারে নিয়ো না নিয়ো না সরায়ে’।

১৯৫৪ সালে ‘শাপমোচন’ ছবির মিউজিক করলেন হেমন্ত। ছবি সুপারহিট। উত্তমকুমারের সঙ্গে গলা যে কী অদ্ভুতভাবে মিলেমিশে গেল তাঁর। শাপমোচনের সেই বিখ্যাত গান ‘শোনো বন্ধু শোনো প্রাণহীন এই শহরের ইতিকথা’ কিংবা ‘ঝড় উঠেছে বাউল বাতাস’ কোন বাঙালি কবে ভুলে যাবে! তারপর বাংলা ছবিতে উত্তমকুমারের কণ্ঠে গান মানেই হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। কত বাংলা ছবির মিউজিক হেমন্তর, কত ছবির গান। বাংলা চলচ্চিত্র যে হেমন্তর কাছে কতখানি ঋণী সে কথা কে বলে শেষ করবে! শুধু বাংলা ছবি কেন, বোম্বের ছবি! হিন্দি ছবি। সম্ভবত, ৫৪ সালেই বোম্বেতে মুক্তি পেয়েছিল ‘নাগিন’। কলকাতায় ‘শাপমোচন’ বোম্বেতে ‘নাগিন’ দুটোরই মিউজিক হেমন্তর।

হিন্দিতে হেমন্ত মুখোপাধ্যায় ছিলেন হেমন্তকুমার। হিন্দি গানের গায়ক হিসেবেও বিখ্যাত এবং জনপ্রিয় হলেন। ‘নাগিনের’ গান ‘কাশি দেখা মথুরা দেখা’ লোকের মুখে মুখে ফিরত একসময়। বাংলায় হেমন্তর গলা নিয়েছিলেন উত্তমকুমার, হিন্দিতে দেবানন্দ। ‘ষোলয়া সাল’ ছবিতে দেবানন্দের গলায় হেমন্তর গান ‘আয় আপনা দিল তো আওয়ারা’ ষাট সালের শুরুতে এ উপমহাদেশের যাবতীয় বালকবৃদ্ধ এবং যুবকের কণ্ঠ আক্রান্ত করেছিল।

হিন্দিতে বেশকিছু ছবি প্রযোজনা করেছিলেন হেমন্ত। তাঁর প্রথম প্রযোজিত ছবি ‘বিশ সাল বাদ’ সুপারহিট করেছিল। বিশ সাল বাদের বাংলা সংস্করণ হয়েছিল কলকাতায়। নাম ‘কুহক’। লতার গান ছিল ‘আসছে সে আসছে’। সলিল চৌধুরীদের সঙ্গে আইপিটিএ করেছেন হেমন্ত। সুকান্তের বিখ্যাত কবিতা ‘রানার’ সুর করেছেন সলিল চৌধুরী, হেমন্ত সেই গান পৌঁছে দিয়েছিলেন বাংলার ঘরে ঘরে। গানের কথায় বাংলার দুর্ভিক্ষকে ধরেছিলেন সলিল চৌধুরী। তিনি নিজে মাঝারি সাইজের কবি, লিখে সুর করেছিলেন, ‘কোনও এক গাঁয়ের বধূর কথা তোমায় শোনায় শোনো’। হেমন্তর গলায় সেই গান বাংলার চিরকালের সম্পদ হয়ে রইল। কি বিশাল বর্ণাঢ্য জীবন হেমন্তর। ’৬২ সালে চীন ভারত আক্রমণ করেছিল। হেমন্ত অসাধারণ দুটো দেশাত্মবোধক গান গাইলেন তখন। ‘এ দেশের মাটির পরে অনেক জাতির অনেক দিনের লোভ আছে’ আর ‘মাগো ভাবনা কেন, আমরা তোমার শান্তিপ্রিয় শান্ত ছেলে তবু শত্র“ এলে অস্ত্র হাতে ধরতে জানি, আমরা প্রতিবাদ করতে জানি।’

জগদ্বিখ্যাত জার্মান লেখক হারমান হেসের ভারতের পটভূমিতে লেখা উপন্যাস ‘সিদ্ধার্থ’র চলচ্চিত্রায়ন করেছিলেন কনরার্ড রুস্ক। ‘সিদ্ধার্থ’র মিউজিক করেছিলেন হেমন্ত। ইংরেজি ভাষার ছবিটিতে নিজের গলার দুটো গান ব্যবহার করেছিলেন। ‘ও নদীরে’ এবং ‘পথের ক্লান্তি ভুলে’।

লোক দেখানো নয়, জীবনচর্চায় হেমন্ত ছিলেন সত্যিকার রবীন্দ্রানুসারী এক সম্পূর্ণ বাঙালি। ইংরেজিতে ‘গীতাঞ্জলি’ পড়ে উর্দুভাষী আবু সয়ীদ আইয়ুব রবীন্দ্রনাথের প্রেমে পড়েন এবং রবীন্দ্র রচনার সম্পূর্ণ স্বাদ পাওয়ার লোভে বাংলা ভাষা শেখেন। পরবর্তীকালে রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে তিনটি বই লেখেন। ‘আধুনিকতা ও রবীন্দ্রনাথ’, ‘পান্থজনের সখা’, ‘পথের শেষ কোথায়’। সম্ভবত তাঁর তৃতীয় বই ‘পথের শেষ কোথায়’-এর এক জায়গায় আধুনিক বাংলা গান সম্পর্কে আইয়ুব বলেছেন, ‘আধুনিক বাংলা গান নামের ওই স্যাঁতসেঁতে ন্যাকামোপূর্ণ বিষয়টিকে ললিতকলার অন্তর্ভুক্ত করা যায় না।’ আইয়ুবের এ মন্তব্য পড়ে আমার মন খারাপ হয়েছিল।

হেমন্তর ‘এই বালুকা বেলায় আমি লিখেছিনু’ গানটি শুনে এক মস্কো সুন্দরী হেমন্তকে বলেছিলেন, ‘আপনার গান সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো হৃদয়ে আঘাত করে’। স্ত্রী বেলা মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে হেমন্ত গেয়েছিলেন, ‘নীড় ছোট ক্ষতি নেই, আকাশ তো বড়’। বাংলা গানের জগৎটাকে হেমন্ত একাই অনেকখানি বড় করে দিয়ে গেছেন।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর