১৯৮৭ সাল। নভেম্বরের শুরু থেকেই সরকারবিরোধী আন্দোলনে দেশ উত্তাল। ১০ নভেম্বরের অবস্থান কর্মসূচি ঘিরে রাজনৈতিক দলগুলো তখন মাঠে। আওয়ামী লীগ, বিএনপিসহ অন্য রাজনৈতিক দলগুলো তখন অলআউট আন্দোলনে। রাজনৈতিক দলগুলোর পাশাপাশি বঙ্গবন্ধুর খুনি ফারুক-রশীদের ফ্রীডম পার্টিও সেই আন্দোলনে। তবে আন্দোলনের নাম করে এরা সশস্ত্র অবস্থায় দাপিয়ে বেড়াচ্ছিল সারা শহরে। সেই সময়ে দেশের পেশাদার খুনি, সন্ত্রাসী ও সর্বহারাদের নিয়ে গঠিত ফ্রীডম পার্টির নামেই ছিল আতঙ্ক। নেতা-কর্মীরা অত্যাধুনিক অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে বিভিন্ন সভা-সমাবেশ করতেন। সমাবেশের চারপাশে প্রকাশ্যে অস্ত্রহাতে দেখা যেত ঢাকার পেশাদার কিলারদের। তবে ফ্রীডম পার্টির মূল টার্গেট ছিল আওয়ামী লীগ। সরকারবিরোধী আন্দোলনের নামে ফ্রীডম পার্টি রাস্তায় সভা-সমাবেশ করলেও আওয়ামী লীগের মিছিল দেখলেই তারা সশস্ত্র হামলা চালাত। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সামনেই চলত হামলা।
ফ্রীডম পার্টি গঠনের পর প্রথম বড় ধরনের হামলার ঘটনা ঘটে ১৯৮৭ সালের ৭ নভেম্বর। বঙ্গবন্ধুর খুনি খন্দকার রশীদ-হুদার নেতৃত্বে হয় সেই ‘অপারেশন প্রেস ক্লাব’। সেদিন খন্দকার রশীদ আর বজলুল হুদা নিজেরাই এলোপাতাড়ি গুলি চালিয়েছিলেন জাতীয় প্রেস ক্লাব চত্বরে। গুলি আর বোমা ফাটিয়েছিল দেশের শীর্ষ সন্ত্রাসীরা। ফিল্মিস্টাইলে রশীদের চলন্ত পাজেরো জিপ থেকে রাইফেল দ্বারা গুলি করা হয়। অসংখ্য মানুষ সেদিন গুলিবিদ্ধ হয়ে লুটিয়ে পড়েছিল। নিহত হয়েছিলেন একজন যুবলীগ কর্মী।
বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, ৭ নভেম্বর সকাল থেকেই রাজধানীর সড়কগুলো দখলে নেয় সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো। বিভিন্ন স্থানে মিছিল-মিটিং চলছে। জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনেও সভা হওয়ার কথা আওয়ামী লীগের। এ সুযোগটি নেয় ফ্রীডম পার্টি। তারাও প্রেস ক্লাবের সামনে সভার আয়োজন করে। একটি মঞ্চও তৈরি করে তারা। বেলা ১১টা থেকেই বঙ্গবন্ধুর খুনি রশীদ, বজলুল হুদাসহ নেতারা অবস্থান নেন। সেখানে আসে ২০-২২ বছরের অন্তত ৩০০ যুবক। এর অধিকাংশ দেশের চিহ্নিত সন্ত্রাসী। এদের নেতৃত্বে ছিলেন রাজধানীর প্রতিটি থানার ফ্রীডম পার্টির কো-অর্ডিনেটর। এর অনেকেই লিবিয়া-ফেরত দুর্ধর্ষ অপরাধী। সেদিন যাদের সশস্ত্র অবস্থায় দেখা যায় তারা হলো বাহার, মিহির, মজিদ। ছাত্রলীগ নেতা চুন্নু হত্যার আসামি রনি ও পিচ্চি আমানকেও স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রহাতে দেখা গেছে রশীদ-হুদার সঙ্গে। আরও ছিল শাহজাহানপুরের মানিক-মুরাদ, ধানমন্ডি ১৯ নম্বরের টিপন, হারুন, তপু, রায়েরবাজারের বর্তমানে ডিশ ব্যবসায়ী মামুন, মোহন, রামপুরার রইস, মিজান, তেজগাঁওয়ের সাইফুল, আলাউদ্দিন, ধানমন্ডির বিপ্লব, এম এ কামাল, বর্তমানে ওয়াসার ঠিকাদার মিন্টু, মোহাম্মদপুরের বেহারি জাবেদ। তবে এর মধ্যে অনেকেই পরে বিভিন্নভাবে মারা গেছেন। সেদিন এরা মঞ্চের চারপাশ ঘিরে ছিল সশস্ত্র অবস্থায়। সূত্র জানায়, বেলা ১২টার দিকে রশীদ বক্তব্য দিচ্ছিলেন। অন্যদিকে সিরডাপ মিলনায়তনের সামনে দিয়ে আওয়ামী লীগের মিছিল আসছিল। ফ্রীডম পার্টির জনসভা থেকেই হামলার নির্দেশনা দেওয়া হয়। কেউ কিছু বুঝে ওঠার আগেই প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ক্যাডাররা অস্ত্র উঁচিয়ে গুলি করতে থাকে আওয়ামী লীগের মিছিল লক্ষ্য করে। মুহুর্মুহু বোমা ও গুলির শব্দে পুরো এলাকায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। ফ্রীডম পার্টির সশস্ত্র ক্যাডারদের সঙ্গে সংঘর্ষ বেধে যায়। রণক্ষেত্রে পরিণত হয় প্রেস ক্লাব চত্বর। রশীদ ও তার দেহরক্ষীরা এ সময় এলোপাতাড়ি গুলি করতে থাকেন। একপর্যায়ে দেহরক্ষীবেষ্টিত রশীদ নিজের জিপ গাড়িতে উঠে বসেন। সেই জিপ থেকে প্রেস ক্লাবের ভিতরে গুলি চালানো হয়। প্রেস ক্লাবের দরজা-জানালা তখন ঝাঁজরা হয়ে যায়। গুলিবিদ্ধ হয়ে লুটিয়ে পড়েন মিছিলকারীরা। এর একজন আ হ ম নাদের আলী ঘটনাস্থলেই মারা যান। এদিকে সভামঞ্চের ওপর বসা মেজর (অব.) বজলুল হুদা, আজরা আলীসহ অন্যরা অস্ত্রধারীদের সহায়তায় গাড়িতে উঠে চলে যান। ফ্রীডম পার্টির সেই হামলার পর জাতীয় প্রেস ক্লাবে সভা-সমাবেশ সাময়িক নিষিদ্ধ ছিল।(প্রতিবেদনটি তৈরিতে সহায়তা করেছেন : মির্জা মেহেদী তমাল, সাখাওয়াত কাওসার, গোলাম রাব্বানী ও মাহবুব মমতাজী।)