রবিবার, ১২ জুলাই, ২০২০ ০০:০০ টা

নতুন উদ্যোক্তাতেই বেকার সমস্যার সমাধান

চাকরি প্রার্থী না হয়ে উদ্যোক্তা হওয়ার ঝোঁক বাড়ছে তরুণ প্রজন্মের, চীন-আমেরিকার মধ্যকার বাণিজ্যযুদ্ধের সুযোগ কাজে লাগাতে পারলে বাড়বে বিদেশি বিনিয়োগ

মানিক মুনতাসির

নতুন উদ্যোক্তাতেই বেকার সমস্যার সমাধান

করোনাকাল উত্তরণ শেষে দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য, শিল্পসহ সামগ্রিক অর্থনৈতিক কর্মকান্ডে স্বাভাবিকতা ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নিতে হবে এখন থেকেই। কেননা বিশ্লেষকরা মনে করেন, চলমান মহামারীতে যে পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে সামনের দিনগুলোতে বাংলাদেশের অর্থনীতি আরও কঠিন সময় পার করবে। করোনা পরিস্থিতির কারণে সংকুচিত হয়ে এসেছে কর্মক্ষেত্র। মানুষের চাহিদার অনুপাতে সম্পদের সরবরাহ কমে গেছে। এরই মধ্যে সব ধরনের শিল্প উৎপাদনে ধস নেমেছে। প্রায় সব ধরনের ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধ রয়েছে। খোদ ব্যাংক ব্যবসায়ও মন্দা পরিস্থিতি বিরাজ করছে। ফলে আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে করোনা মহামারী কেটে গেলেও এ সময়ের মধ্যে বেকার সমস্যা প্রকট আকার ধারণ করবে। মানুষের আয় ইতিমধ্যেই কমে গেছে ৭০ ভাগ। একইভাবে চাকরির বাজার অব্যাহতভাবে সংকুচিত হচ্ছে। ফলে পরিস্থিতি সামলাতে ঘরে ঘরে উদ্যোক্তা সৃষ্টির উদ্যোগ নিয়েছে বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা)। করোনা-পরবর্তী সময়ে মানুষের চাকরি প্রার্থী না হয়ে উদ্যোক্তার প্রতি ঝোঁক বাড়বে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। বিশেষ করে তরুণ প্রজন্ম এখন চাকরিজীবী হওয়ার চেয়ে উদ্যোক্তা হওয়াকে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, করোনাভাইরাস হয়তো কখনোই পৃথিবী থেকে বিদায় নেবে না। এর রেশ অন্তত আরও পাঁচ বছর থাকতে পারে। ফলে অনলাইন ব্যবসা-বাণিজ্য ও ই-কমার্সের আওতা আরও বাড়বে। সামনের দিনগুলোতে লাভজনকের চেয়ে টেকসই ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রতি তরুণ উদ্যোক্তাদের আগ্রহ বাড়বে। এদিকে চীন ও আমেরিকার মধ্যে চলমান বাণিজ্য যুদ্ধের জের ধরে চীন থেকে আমেরিকা, জাপান, রাশিয়াসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ তাদের বিনিয়োগ অন্যত্র সরিয়ে নিচ্ছে। বিষয়টি বাংলাদেশের জন্য বিরাট সম্ভাবনা হিসেবে দেখছেন সংশ্লিষ্টরা। এ জন্য যেসব কোম্পানি চীন থেকে বিনিয়োগ সরিয়ে নিচ্ছে সেসব কোম্পানির সঙ্গে ইতিমধ্যে যোগাযোগও করছেন বাংলাদেশি ব্যবসায়ীরা। ফলে এ সুযোগকে কাজে লাগাতে পারলে সামনের দিনগুলোতে বিদেশি বিনিয়োগ বাড়বে। অন্যদিকে নতুন নতুন উদ্যোক্তার সৃষ্টি হবে। এতে তরুণ উদ্যোক্তারাই এগিয়ে থাকবে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।

জানা গেছে, বাংলাদেশে প্রতি বছর অন্তত ২১ লাখ তরুণ কর্মবাজারে প্রবেশ করছে। এর মধ্যে শুধু বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রি নিয়েই কর্মবাজারে প্রবেশের যোগ্য হন ১৬ লাখ। আর সরকারি ও বেসরকারি উভয় খাতে প্রতিবছর কর্মসংস্থান হয় ৬ থেকে ৭ লাখ লোকের। সে হিসাবে প্রতিবছর অন্তত ১৪ লাখ বেকার তৈরি হয়। বর্তমানে অন্তত দেড় কোটি মানুষ কর্মহীন অবস্থায় রয়েছে। কিন্তু করোনাভাইরাস পরিস্থিতির কারণে প্রায় সব ধরনের নিয়োগ বন্ধ রয়েছে। এ ছাড়া বেসরকারি খাতের বহু শিল্প-কারখানা ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। অনেক শিল্প মালিক তাদের প্রতিষ্ঠান টিকিয়ে রাখতে খরচ কমাচ্ছেন। এ জন্য তারা কর্মী ছাঁটাইও করছেন। তাই, করোনা-পরবর্তীতে দেশে বেকারের তালিকা কতটা লম্বা হবে তা হয়তো এখনই বলা সম্ভব নয় বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা। তবে আশার কথা হচ্ছে, করোনা পরিস্থিতি কেটে গেলে বিশ্ব আবার ব্যস্ত হয়ে উঠবে। নতুন করে শিল্প-কারখানার চাকা ঘুরবে। নতুন নতুন পণ্যের বাজার প্রসারিত হবে। মানুষের নতুন নতুন চাহিদার সৃষ্টি হবে। যা আবার কর্মক্ষেত্রে নতুন মাত্রা যোগ করবে। এতে নতুন নতুন ব্যবসা-বাণিজ্যের নতুন নতুন সম্ভাবনা দেখা দেবে। নতুন করে উদ্যোক্তা তৈরির সুযোগও সৃষ্টি হবে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।

যারা ইতিমধ্যে বিদেশ থেকে ফেরত এসেছেন তাদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে এ প্রশিক্ষণের আওতা আরও বাড়বে। তাদের স্থানীয়ভাবে ব্যাংক ঋণ দিয়ে কাজের সুযোগ করে দেওয়া হবে। প্রত্যেকেই যেন একেকজন উদ্যোক্তা হতে পারেন সে সুযোগ তৈরি করতে পারলে বেকার সমস্যার সমাধানে এটা অনেকটাই কাজে আসবে বলে মনে করা হচ্ছে। এ জন্য প্রবাসীকল্যাণ ব্যাংকের মাধ্যমে নতুন নতুন প্রকল্প হাতে নিয়ে এদের উদ্যোক্তা হিসেবে কাজে লাগানো হবে। এদিকে নতুন বাজেটে বিদেশফেরত শ্রমিক, প্রশিক্ষিত তরুণ ও বেকার যুবকদের ব্যবসা ও কর্মসংস্থান বৃদ্ধির লক্ষ্যে পল্লী সঞ্চয় ব্যাংক, প্রবাসীকল্যাণ ব্যাংক, কর্মসংস্থান ব্যাংক ও পিকেএসএফের মাধ্যমে প্রায় ২ হাজার কোটি টাকা বিতরণ করা হবে। এ লক্ষ্যে প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে ৫০০ কোটি টাকার মূলধন সরকার বিতরণ করবে। যার মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানগুলো নির্দিষ্ট কর্মসূচির আওতায় উপযুক্ত উদ্যোক্তাদের স্বল্প সুদে ঋণ বিতরণ করবে। এ ছাড়া বিভিন্ন জেলায় প্রশিক্ষণ কেন্দ্র স্থাপন করা হবে।

জানা গেছে, বৃহৎ শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোয় বিশেষ তহবিল রয়েছে। করোনার প্রভাবে সাময়িক কর্মহীনতা দূরীকরণের জন্য পোশাক ও রপ্তানিমুখী শিল্পের জন্য ৫ হাজার কোটি টাকার তহবিল গঠন করা হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত শিল্প ও সার্ভিস খাতের জন্য ৩০ হাজার কোটি টাকা এবং এসএমই খাতের জন্য ২০ হাজার কোটি টাকার দুটি স্বল্প সুদে ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল ঋণ সুবিধা চালু হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের এক্সপোর্ট ডেভেলপমেন্ট ফান্ডের পরিমাণ ৩ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার থেকে ৫ বিলিয়নে উন্নীত হয়েছে। এ ছাড়া প্রি-শিপমেন্ট ক্রেডিট রিফাইন্যান্স স্কিম নামে ৫ হাজার কোটি টাকার ঋণ তহবিল গঠিত হয়েছে। এ ছাড়া সারা দেশে ১৭৭টি ক্লাস্টার করে এসএমই খাতের উন্নয়নে কাজ করা হবে।

এ ছাড়া স্কিল ফর এমপ্লয়মেন্ট ডেভেলপমেন্ট প্রকল্পের আওতায় ১৫ লাখ মানুষকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে। ইতিমধ্যে ৪ লাখ ২৮ হাজার প্রশিক্ষিত হয়েছে। যুব অধিদফতরের ‘ন্যাশনাল সার্ভিস কর্মসূচি’র মাধ্যমে ২ লাখ ২৭ হাজার জনের অস্থায়ী কর্মসংস্থান করা হয়েছে করোনা মহামারী শুরুর আগে। দক্ষতা উন্নয়নের জন্য প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের নেতৃত্বে গঠিত জাতীয় দক্ষতা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (এনএসডিএ) নানাভাবে বেকার তরুণদের প্রশিক্ষিত করার কাজ করছে। দক্ষ লোক তৈরির জন্য কয়েকটি প্রকল্পও হাতে নিয়েছে সংস্থাটি। তথ্যপ্রযুক্তি খাতে কর্মসংস্থান বৃদ্ধিতে দেশে আরও ১২টি আইটি পার্ক ও ৮টি শেখ কামাল আইটি ট্রেনিং অ্যান্ড ইনকিউবেশন সেন্টার স্থাপন করা হবে। এদিকে ২০২০ সালের মধ্যে ২৪ হাজার নতুন উদ্যোক্তা তৈরি করবে বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা)। সংস্থাটির এ লক্ষ্যে ‘উদ্যোক্তা সৃষ্টি ও দক্ষতা উন্নয়ন’ শিরোনামের একটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে সরকার।

সর্বশেষ খবর