প্রতারণার এমন কোনো শাখা নেই, যেখানে সাহেদের পদচারণা ছিল না। কখনো তিনি দানবীর, কখনো রাজনীতিক, মিডিয়া ব্যক্তিত্ব বা ক্ষমতাধর কর্মকর্তা। তার প্রতারণার বিস্তার ছিল দেশব্যাপী, তৃণমূলের খেটে খাওয়া মানুষ থেকে শুরু করে ধনাঢ্য ব্যবসায়ী- সব ধরনের মানুষ পড়েছেন তার খপ্পরে। প্রতারণা দিয়েই উত্থান ঘটে সাহেদের। এক দশক ধরে নানা পরিচয়ে প্রতারণার জগতে রাজত্ব করেছেন।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রতারণা আর ভন্ডামিতে যা মানুষের কল্পনার অতীত, অবলীলায় উতরে গেছেন সাহেদ বারবার। সর্বসাকল্যে স্কুলের গন্ডি পেরোনো এই ব্যক্তি কখনো নিজেকে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের কর্মকর্তা বলে পরিচয় দেন। কখনো নিজেকে সচিব, মেজর বা কর্নেল বলেও দাবি করেন। মোবাইল ফোনের ফটো গ্যালারিতে সংরক্ষিত ছবিতে প্রভাবশালী ও বিশিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে নিজেকে দেখিয়ে নিজের প্রভাব জানান দেন কখনো কখনো। তার মালিকানাধীন হাসপাতালের গেটেও সেসব ছবি টাঙানো থাকত বড় করে।
সূত্র জানায়, ২০১০ সালে মাত্র মাধ্যমিক উতরানো সাহেদের উত্থান ঘটে মাল্টি লেভেল মার্কেটিং বা এমএলএম কোম্পানির মাধ্যমে। ধানমন্ডি এলাকায় বিডিএস ক্লিক ওয়ান ও কেকেএস নামে দুটি এমএলএম কোম্পানি খুলে গ্রাহকদের কাছ থেকে হাতিয়ে নেন শত কোটি টাকা। ২০১১ সালে প্রতারণার মামলায় তাকে একদফা গ্রেফতারও করা হয়। তবে অর্থের বিনিময়ে জামিন নিয়ে রিজেন্ট গ্রুপ করে শুরু করেন নতুন প্রতারণা ব্যবসা। খোলেন রিজেন্ট হাসপাতাল।সূত্র জানায়, তার এই হাসপাতালে রোগীকে জিম্মি করে মুক্তিপণ আদায়ের ঘটনা ছিল নিয়মিত। সংকটাপন্ন না হওয়ার পরও আইসিইউতে রেখে অর্থ আদায়, টাকা দিতে না পারলে ক্যাডার বাহিনী দিয়ে নির্যাতনের মতো ঘটনা ঘটেছে অসংখ্যবার। র্যাবের অভিযানের পর এমন নানা কর্মকান্ডের খবর বের হয় এ হাসপাতাল ঘিরে। উত্তরা ও মিরপুরের দুটি হাসপাতাল ব্যবসার আড়ালে তিনি তৈরি করেছিলেন নিজস্ব টর্চার সেল। পাওনাদার কিংবা ভুক্তভোগী কেউ বিচার চাইতে এলে চলত নির্মম নির্যাতন। এতদিন মানুষ তাকে সমাজের প্রভাবশালী আর সম্মানিত ব্যক্তি হিসেবে জানলেও রিজেন্ট হাসপাতালে র্যাবের অভিযানের পর বেরিয়ে আসছে সাহেদের নানা কুকীর্তির কাহিনি। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় অধিদফতরের উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তার যোগসাজশে লাইসেন্সবিহীন এ হাসপাতাল কভিড সেবার জন্য চুক্তিবদ্ধ হয়ে ৬০ এর বেশি মামলার আসামি বনে যান তিনি।
সূত্র জানায়, সেনাবাহিনীর কর্নেল কিংবা মেজর পরিচয়ে ঠকিয়েছেন অসংখ্য অংশীদার ও ব্যবসায়ীকেও। চেক জালিয়াতি, ঋণ নিয়ে পরিশোধ না করা, চাকরি তদবির এসবের কিছুই বাদ রাখেননি শাহেদ করিম। এর মধ্যেই তিনি বনে গেছেন মিডিয়া ব্যক্তিত্ব। সরকারদলীয় মুখাপত্র হিসেবে জোরালো বক্তব্য দিয়ে জাহির করতেন নিজেকে। ক্ষমতাধর ও পদস্থ ব্যক্তিদের সঙ্গে ছবি তুলে প্রতারণার কাজে ব্যবহার করতেন সাহেদ। রিজেন্ট হাসপাতালের অভিযানের পর বিভিন্ন অভিযোগে সারা দেশে সাহেদের বিরুদ্ধে ষাটেরও বেশি মামলা দায়ের করা হয়। রিজেন্ট গ্রুপের চেয়ারম্যান সাহেদ নিজেকে আওয়ামী লীগ নেতা হিসেবে দাবি করতেন। আওয়ামী লীগের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ক কমিটির সদস্য হিসেবে পরিচয় দিতেন তিনি। দায়িত্বশীল সূত্র বলছে, তিনি বীরদর্পে সচিবালয়ে ঘুরে বেড়াতেন। সচিব থেকে শুরু করে বড় কর্তাদের অফিসে দাপটের সঙ্গে কথা বলতেন। পুলিশ সদর দফতরের একাধিক সূত্র বলছে, ওই ব্যক্তি কয়েক বছর আগে পুলিশ সদর দফতরে নানা পরিচয়ে নিয়মিত ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের কক্ষে ঘোরাঘুরি করতেন।
এরপর একে একে রিজেন্ট হসপিটাল লিমিটেড (মিরপুর), রিজেন্ট হসপিটাল লিমিটেড (উত্তরা), ঢাকা সেন্ট্রাল কলেজ, রিজেন্ট ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি ও হোটেল মিলিনার মালিক হন সাহেদ। সবশেষে দেশে চলমান করোনা দুর্যোগে আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসা আর টেস্ট নিয়ে প্রতারণার ফাঁদ পেতে বসেন।
সাহেদের মালিকানাধীন রিজেন্ট কেসিএস পূর্বাচল প্রজেক্টে বালু সরবরাহের কাজ পেয়েছিলেন ফেনীর জুলফিকার আলী। তিনি জানান, সিলেট থেকে বালু সরবরাহের পর তার পাওনা ৪২ লাখ ৫৭ হাজার ৫৫৯ টাকা সাহেদ পরিশোধ করেননি। টাকা চাইলে তাকে মেরে ফেলার হুমকি দেওয়া হয়। এ ঘটনায় উত্তরা পশ্চিম থানায় জিডি করেন তিনি। মৃত্যুর ভয়ে এখনো পালিয়ে থাকেন জুলফিকার।
আরও ৪ ব্যাংকে সাহেদের তথ্য চেয়ে দুদকের চিঠি : রিজেন্ট গ্রুপের আটটি প্রতিষ্ঠান ও চেয়ারম্যান মো. সাহেদের হিসাবের তথ্য চেয়ে আরও চারটি ব্যাংকে চিঠি পাঠিয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। গতকাল দুদক উপ-পরিচালক ও অনুসন্ধান কর্মকর্তা মো. আবুবকর সিদ্দিকের স্বাক্ষরিত চিঠি ওইসব ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের (এমডি) কাছে পাঠানো হয়েছে। কমিশনের জনসংযোগ কার্যালয় বিষয়টি জানিয়েছে। অভিযোগের সুষ্ঠু অনুসন্ধানের স্বার্থে ওইসব তথ্য চাওয়া হয় বলে চিঠিগুলোতে উল্লেখ করা হয়। জানা গেছে, এসব চিঠিতে আগামী ২০ জুলাইয়ের মধ্যে দুদকের প্রধান কার্যালয়ে অনুসন্ধান টিমের প্রধানের কাছে নথিগুলো পাঠাতে বলা হয়েছে। ব্যাংক এশিয়ার কাজী নজরুল ইসলাম এভিনিউয়ের করপোরেট শাখা, ডাচ-বাংলা ব্যাংকের মতিঝিল প্রধান কার্যালয়, গুলশান-১ এ এনআরবি ব্যাংকের প্রধান কার্যালয় ও পদ্মা ব্যাংকের গুলশান করপোরেট শাখায় এই চিঠি দিয়েছে দুদক। এসব ব্যাংকে সাহেদ ও তার মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানগুলোর নামে হিসাব রয়েছে বলে দুদক সূত্র জানিয়েছে। ওইসব ব্যাংক থেকে সাহেদ ও তার প্রতিষ্ঠানের হিসাব খোলার আবেদনপত্র (সংযুক্তিসহ), কোম্পানির মেমোরেন্ডাম অব অ্যাসোসিয়েশন অ্যান্ড আর্টিক্যালস অব অ্যাসোসিয়েশন, ট্রেড লাইসেন্স, হিসাব বিবরণী, ঋণ গ্রহণের আবেদন, মঞ্জুরিপত্র, বন্ধকী দলিল, বন্ধকী সম্পত্তির টাইটেল ডিড, মামলার আর্জি ও আনুষঙ্গিক অন্যান্য রেকর্ডপত্রের সত্যায়িত কপি চেয়েছে কমিশন।
এর আগে মঙ্গলবার সাহেদের প্রতিষ্ঠানের হিসাবের নথি চেয়ে ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংকের উত্তরা শাখার ম্যানেজার, দ্য ঢাকা মার্কেন্টাইল কো-অপারেটিভ ব্যাংকের বিমানবন্দর শাখা ম্যানেজারের কাছেও চিঠি দেয় দুদক।
দুদকের অনুসন্ধানে সাহেদের মালিকানাধীন রিজেন্ট গ্রুপের আটটি সহযোগী প্রতিষ্ঠানের সন্ধান পাওয়া গেছে। এগুলো হলো রিজেন্ট হাসপাতাল লিমিটেড, রিজেন্ট কেসিএস লিমিটেড, মুনলাইট রিসোর্ট, ফোর স্টার ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেড, মুনলাইট বিল্ডার্স, রিজেন্ট ইউনিভার্সিটি অব সাইন্স অ্যান্ড টেকনলজি, ঢাকা সেন্ট্রাল কলেজ, দ্য ডেইলি অন্য দিগন্ত ও কর্মমুখী কর্মসংস্থান সোসাইটি।
চিঠিগুলোতে সাহেদের বিরুদ্ধে অভিযোগ সম্পর্কে বলা হয়, মাইক্রোক্রেডিট ও এমএলএম ব্যবসার নামে জনসাধারণের সঙ্গে প্রতারণা করে কোটি কোটি টাকা সংগ্রহ, বহুমাত্রিক জাল-জালিয়াতি ও প্রতারণার মাধ্যমে পরস্পর যোগসাজশে সরকারি অর্থ আত্মসাৎ, আয়কর ফাঁকি, ভুয়া নাম ও পরিচয়ে ব্যাংক ঋণ গ্রহণ করে কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎ করে অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। এর আগে সোমবার সাহেদের বিরুদ্ধে অনুসন্ধানে তিন সদস্যের একটি টিম গঠন করে দুদক।
চিকিৎসার নামে প্রতারণা ও জালিয়াতির অভিযোগে সম্প্রতি এক অভিযানে রিজেন্টের দুটি হাসপাতাল বন্ধ করে র্যাব। এ ঘটনায় করা মামলায় গতকাল সকালে সাতক্ষীরা দেবহাটা সীমান্ত থেকে সাহেদকে গ্রেফতার করে র্যাব।