সোমবার, ১০ মে, ২০২১ ০০:০০ টা

স্থলবন্দর ঘিরে বাড়ছে ঝুঁকি

জয়শ্রী ভাদুড়ী

স্থলবন্দর ঘিরে বাড়ছে ঝুঁকি

ভারতে যাত্রী চলাচলে সীমান্ত বন্ধ থাকলেও আমদানি করা পণ্য নিয়ে স্থলবন্দর দিয়ে প্রতিদিন বাংলাদেশে আসছে শত শত ট্রাক। এসব ট্রাকের চালক ও সহকারীদের নেই কোনো স্বাস্থ্যবিধি মানার বালাই। ভারতের বিভিন্ন জায়গা থেকে পণ্য নিয়ে এসে স্থলবন্দর এলাকা ও আশপাশের হাট-বাজারে ঘোরাঘুরি করছেন তারা। এতে বন্দর এলাকা ও আশপাশের মানুষের করোনার ভারতীয় ভেরিয়েন্ট বা ধরন দিয়ে সংক্রমিত হওয়ার ঝুঁকি বাড়ছে।

ভারতীয় ভেরিয়েন্ট যাতে বাংলাদেশে ছড়াতে না পারে সে জন্য ২৬ এপ্রিল থেকে সীমান্ত বন্ধ রেখেছে বাংলাদেশ। এর মধ্যেই শনিবার দেশে ভারতীয় ভেরিয়েন্ট বহনকারী করোনা রোগী শনাক্ত হয়েছে বলে জানিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদফতর। স্বাস্থ্য অধিদফতরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. নাসিমা সুলতানা বলেছেন, ‘আইইডিসিআর ও যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় আটজনের নমুনা পরীক্ষা করে দুটি নিশ্চিত ভারতীয় ভেরিয়েন্ট ও চারটি ভারতীয় ভেরিয়েন্টের কাছাকাছি ভেরিয়েন্ট শনাক্ত করেছে। সম্পূর্ণ জিনোম সিকোয়েন্সিং এখনো শেষ হয়নি। তা না হলে এখনো বলা যাবে না ডাবল নাকি ট্রিপল ভেরিয়েন্ট।’ তিনি বলেন, ‘ভারতীয় ভেরিয়েন্ট শনাক্ত হওয়া সবাই চিকিৎসাধীন আছেন, কারও অবস্থাই খারাপ নয়। এ ভেরিয়েন্ট দেশে ছড়িয়েছে কি না তা পরীক্ষার ওপর নির্ভর করবে। যে কয়েকজনের ওপর পরীক্ষা করা হয়েছে তাদের মধ্যে এ ফলাফল পাওয়া গেছে। এ ভেরিয়েন্টে অনেক বেশি সংক্রামক। নতুন ভেরিয়েন্ট নিয়ে স্বাস্থ্য

অধিদফতর উদ্বিগ্ন ও সারা দেশের মানুষের উদ্বিগ্ন হওয়া উচিত। স্বাস্থ্যবিধি মানার এখন উচিত সময়।’ কিন্তু স্বাস্থ্য অধিদফতরের এই সতর্কতা মানার বালাই নেই স্থলবন্দরগুলোতে।

আমাদের বেনাপোল প্রতিনিধি বকুল মাহবুব জানান, প্রতিদিন গড়ে সাড়ে ৪০০ ভারতীয় পণ্যবাহী ট্রাক বেনাপোল দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে। ট্রাকচালক ও সহকারীদের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা হচ্ছে অনভিজ্ঞ আনসার সদস্য দিয়ে। বন্দরের ভিতরে কোনো সামাজিক দূরত্বের বালাই নেই। বন্দর বা প্রশাসনের নেই তদারকির কোনো ব্যবস্থা। স্থানীয় বাসিন্দারা বলছেন, ভারত থেকে আসা ট্রাকচালকরা যত্রতত্র ঘুরে বেড়াচ্ছেন। বেনাপোল বাজারসহ আশপাশের দোকানে তাদের হরদম দেখা যাচ্ছে। বন্দর কর্তৃপক্ষের যথাযথ তদারকি না থাকায় মাস্ক ছাড়া যত্রতত্র চলাফেরা করছেন চালক ও খালাসিরা। এ ব্যাপারে বন্দরের ভারপ্রাপ্ত পরিচালক আবদুল জলিল বলেন, ‘যেসব শ্রমিকের মুখে মাস্ক নেই, তাদের মাস্ক দেওয়া হচ্ছে। হাত ধোয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে, স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার জন্য মাইকিং করা হচ্ছে। বন্দর থেকে যাতে বের হতে না পারে সে জন্য নিরাপত্তারক্ষীদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।’ বেনাপোল সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মফিজুর রহমান সজন বলেন, ‘যেহেতু ভারতের বিভিন্ন প্রদেশ থেকে ট্রাকচালকেরা বেনাপোল বন্দরে আসছেন, তাই আমরা বন্দর ও কাস্টমসকে বলেছি যাতে ভারতীয় চালক ও হেলপাররা বন্দরের বাইরে বের না হন।’ আমাদের চাঁপাইনবাবগঞ্জ প্রতিনিধি মো. রফিকুল আলম জানান, চাঁপাইনবাবগঞ্জের সোনামসজিদ স্থলবন্দরে ভারতীয় পণ্যবাহী ট্রাকচালক ও হেলপার আসায় করোনাভাইরাসের ভারতীয় ধরন ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। জানা গেছে, প্রতিদিন ভারত থেকে ৩০০ থেকে সাড়ে ৩০০ পণ্যবাহী ট্রাক সোনামসজিদ স্থলবন্দরে প্রবেশ করে। ট্রাকের সঙ্গে আসা চালক ও হেলপাররা মালামাল নিয়ে সোনামসজিদ স্থলবন্দরে পানামা পোর্ট লিঙ্ক লিমিটেডের ইয়ার্ডে অবস্থান করেন। এ সময় তারা পোর্ট এলাকায় অবাধে চালাফেরা করায় তাদের মাধ্যমে করোনাভাইরাসের ভারতীয় ধরন দেশে চলে আসতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। এ ব্যাপারে সোনামসজিদ স্থলবন্দর সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক মো. রুহুল আমিন বলেন, ‘করোনাভাইরাসের ভারতীয় ধরন ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কায় বন্দরে ট্রাক আসার পর মালামাল খালাস করে বন্দরের স্থানীয় ট্রাকে তা আবার লোড করা হয়। হেলপার ছাড়াই শুধু চালককে সোনামসজিদ স্থলবন্দরে পাঠানোর জন্য ভারতীয় রপ্তানিকারকদের অনুরোধ করা হয়েছে।’ পানামা পোর্ট লিঙ্ক লিমিটেডের ম্যানেজার মো. মাইনুল ইসলাম জানান, নো ম্যান্স ল্যান্ডে করোনা সংক্রমণ প্রতিরোধে স্বাস্থ্য বিভাগের বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর ভারতীয় চালক ও হেলপারদের বন্দরে প্রবেশ করতে দেওয়া হয়। পরে তারা মালামাল নিয়ে পানামা পোর্ট লিঙ্ক লিমিটেডে প্রবেশ করার সঙ্গে সঙ্গে পণ্য খালাস করলে দ্রুত তাদের ভারতে ফেরত পাঠানোর ব্যবস্থা করা হয়। এ ব্যাপারে সিভিল সার্জন ডা. জাহিদ নজরুল চৌধুরী জানান, ভারতীয় ট্রাক মালামালসহ স্প্রে করাসহ চালক ও হেলপারের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করে বন্দরে প্রবেশ করতে দেওয়া হচ্ছে। এ সময় কারও শরীরে তাপমাত্রা বেশি পাওয়া গেলে জিরো পয়েন্ট থেকেই তাদের ভারতে ফেরত পাঠিয়ে দেওয়া হয়।

আমাদের দিনাজপুর প্রতিনিধি মো. রিয়াজুল ইসলাম জানান, ভারতে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব বৃদ্ধি পাওয়ায় হিলি স্থলবন্দর দিয়ে আমদানি-রপ্তানি সাময়িক বন্ধের জন্য দিনাজপুর জেলা প্রশাসকের কাছে প্রস্তাব দিয়েছিলেন হাকিমপুর পৌরসভার মেয়র জামিল হোসেন চলন্ত। এর পরিপ্রেক্ষিতে স্বাস্থ্যবিধি মেনে হিলি স্থলবন্দর দিয়ে জরুরি পণ্য সরবরাহ চালু রয়েছে। কিন্তু তেমনভাবে স্বাস্থ্যবিধি মানছেন না বন্দরের ট্রাক চালক, হেলপার ও বন্দরে কর্মরত শ্রমিকরা। ফলে স্থলবন্দরে আসা ভারতীয় চালক ও শ্রমিকদের চলাফেরা করাই করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা করছেন স্থানীয় বাসিন্দারা। জানা যায়, ভারতের সঙ্গে হিলি স্থলবন্দর দিয়ে চালু রয়েছে জরুরি পণ্য সরবরাহ। এখানে স্বাস্থ্য পরীক্ষার জন্য শুধু হ্যান্ড স্ক্যানার রয়েছে। শ্রমিকদের করোনা পরীক্ষার কোনো ব্যবস্থা নেই এই স্থলবন্দরে। ভারত থেকে মালামাল নিয়ে আসা চালকরা স্থলবন্দরের ভিতরে ঘোরাফেরা করছেন মাস্ক ছাড়াই।

হিলি স্থলবন্দর আমদানি-রপ্তানিকারক গ্রুপের সভাপতি হারুন উর রশিদ হারুন জানান, করোনভাইরাস থেকে বাঁচতে হলে সবাইকে সচেতন থাকতে হবে। সংক্রমণ রোধে সরকার আমদানি-রপ্তানি বন্ধ করে দিলে যদি ব্যবসায়িক ক্ষতিও হয়, তবু মেনে নেবেন বন্দরের আমদানিকারকরা।

হাকিমপুর পৌরসভার মেয়র জামিল হোসেন চলন্ত জানান, হিলি স্থলবন্দর দিয়ে সরকারের নির্দেশনা ও স্বাস্থ্যবিধি মেনেই আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রম চালু রয়েছে। এমনকি পোর্টের ভিতরে বারবার মাইক দিয়ে সবাইকে সচেতন করা হচ্ছে। ভারত থেকে আসা চালক ও হেলপারদের আলাদাভাবে রাখার ব্যবস্থা করা হয়েছে।

আমাদের লালমনিরহাট প্রতিনিধি রেজাউল করিম মানিক জানান, লালমনিরহাটের বুড়িমারী স্থলবন্দরে করোনার ভারতীয় ভেরিয়েন্ট ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। বুড়িমারী স্থলবন্দর দিয়ে প্রতিদিন ভারত থেকে প্রবেশ করছেন প্রায় ২০০ পণ্যবাহী ট্রাক। এর সঙ্গে আসছেন প্রায় ২০০ ভারতীয় চালক। এসব ট্রাকচালক বাংলাদেশে অবস্থান করছেন ৯-১০ ঘণ্টা। পণ্য খালাস না হওয়া পর্যন্ত তারা থাকছেন বাংলাদেশেই। মেলামেশা করছেন বাংলাদেশি শ্রমিক ও বন্দর-সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে। বুড়িমারী স্থলবন্দরের সিঅ্যান্ডএফ অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি রুহুল আমিন বাবুল বলেন, ‘আমরা শঙ্কায় রয়েছি। স্থলবন্দর দিয়ে ভারত থেকে প্রতিদিন প্রবেশ করছে ২০০ পণ্যবাহী যানবাহন।’ বুড়িমারী ইমিগ্রেশন পুলিশের ওসি আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘ভারতীয় চালক-হেলপারদের বেপরোয়া চলাফেরায় আমরা আতঙ্কিত। এ কারণেই স্বাস্থ্য বিভাগের নির্দেশনায় সতর্কতা জারি করা হয়েছে। সিভিল সার্জন নির্মলেন্দু রায় জানান, যাতে ভারতীয় নতুন ভাইরাস ছড়িয়ে না পড়ে সে জন্য স্থলবন্দর এলাকায় সতর্কতা জারি করা হয়েছে। ভারতীয় চালক ও হেলপারদের স্বাস্থ্য পরীক্ষার পর বাংলাদেশে ঢোকার অনুমতি দেওয়া হচ্ছে।

সর্বশেষ খবর