রবিবার, ২৩ মে, ২০২১ ০০:০০ টা

সামনে আউয়াল পেছনে কাউন্সিলর

সাখাওয়াত কাওসার

সামনে আউয়াল পেছনে কাউন্সিলর

সামনে সাবেক এমপি এম এ আউয়াল হলেও পেছন থেকে সব কলকাঠি নাড়তেন মিরপুরের স্থানীয় এক ওয়ার্ড কাউন্সিলর। নেপথ্যে থেকেই তিনি আউয়ালের সব অপকর্মের মদদ দিতেন। জমির বায়না ও দখলের জন্য আউয়ালের নিরাপত্তায় সার্বক্ষণিক থাকত সেই তরুণ কাউন্সিলরের ঘনিষ্ঠ সহযোগী বিহারি আড্ডু, সোহাগ, মাসুদ এবং গোয়েন্দা পুলিশের হাতে গ্রেফতার সুমন। বহুল আলোচিত সাহিনুদ্দিন হত্যা মামলায় গ্রেফতার ব্যক্তিদের জবানি ও অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে এসব চাঞ্চল্যকর তথ্য। এরই মধ্যে এ মামলায় গ্রেফতার রকি ও মুরাদ গতকাল আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। রিমান্ডে রয়েছেন আউয়ালসহ পাঁচজন। ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) যুগ্ম-কমিশনার মাহবুব আলম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘এই নৃশংস হত্যাকান্ডের সঙ্গে জড়িত যে-ই হোক না কেন, তাকে আইনের আওতায় নিয়ে আসা হবে। অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে এ বিষয়টি খতিয়ে দেখা হচ্ছে। এরই মধ্যে অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য আমরা পেয়েছি। তবে তদন্তের স্বার্থে এসব নিয়ে আমরা এখনই কোনো মন্তব্য করছি না।’ সূত্র বলছে, ভয়ংকর সব কর্মকান্ডের পরিকল্পনা হয় মিরপুর ইস্টার্ন হাউজিংয়ে ওই কাউন্সিলরের ব্যক্তিগত অফিসে। তার অনেক অপকর্মের সাক্ষী ছিল বন্দুকযুদ্ধে নিহত মানিক, গোয়েন্দা পুলিশের কাছে রিমান্ডে থাকা সুমন, সেকশন-১১-এর শেখ মো. মুগারী আড্ডু। অন্য এলাকার কাউন্সিলর হলেও পল্লবী ৩ ও ৫ নম্বর ওয়ার্ডের ফুটপাথ, চাঁদাবাজি এবং মাদক ব্যবসার একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ নিয়েছেন তিনি। বিভিন্ন অপারেশনে তার অস্ত্রের জোগানদাতা শীর্ষ সন্ত্রাসী কারাবন্দী মামুনের সেকেন্ড ইন কমান্ড মাসুদ। মাসুদের কাছ থেকে ভাড়া করা অস্ত্র নিয়েই সাহিনুদ্দিন হত্যার ঘটনা ঘটাতে গিয়েছিল মানিক ও সুমন গং। অনুসন্ধানে জানা গেছে, বৃহত্তর মিরপুরের সিরামিক এবং কালশী ও আলীনগর এলাকায় কাগজপত্রে কিছুটা দুর্বলতা রয়েছে এমন সব জমির প্লট টার্গেট করতেন আউয়াল। স্থানীয় আড্ডু, সোহাগ, সুমন, পারভেজ, ওমর, জনি, রাসেল, খোকন তাকে এসব কাজে সহায়তা করতেন। আবার অনেক সহজ-সরল জমির মালিককে ব্ল্যাকমেল করে তাদের জমি রেজিস্ট্রির বায়না করেতন। কিছুদিন পরই ভিন্ন রূপে হাজির হতেন তারা। আজীবনের জন্য নিজের কষ্টের টাকায় কেনা জমি থেকে উচ্ছেদ হয়েছেন অনেকে তাদের অত্যাচারে। স্থানীয় থানা-পুলিশও রহস্যজনক কারণে আউয়াল গংদের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ নিতে আগ্রহ দেখাত না। উল্টো দুর্নীতিগ্রস্ত আইন প্রয়োগকারী সদস্যদের দিয়ে ভুক্তভোগীদের ভয়ভীতি দেখাত আউয়াল গং। সর্বশেষ হত্যার শিকার সাহিনুদ্দিনকেও মিথ্যা মামলায় গ্রেফতার করিয়েছিল তারা। তবে মেজর মোস্তফার (অব.) জমির বাউন্ডারি ভাঙলেও তার জমি দখলে নিতে পারেনি আউয়াল গং। কিন্তু এ ঘটনায় ৭ মে একটি মামলা হলেও বীরদর্পে ঘুরে বেড়িয়েছেন আউয়াল এবং সহযোগীরা। আউয়ালের ‘হ্যাভেলী প্রোপার্টি’র স্বত্বাধিকারী কাগজে-কলমে আউয়াল হলেও বড় অংশের অদৃশ্য শেয়ার রয়েছে সেই কাউন্সিলরের।

১৬ মে পল্লবীতে শিশুসন্তানের সামনে সাহিনুদ্দিন নামে এক ব্যবসায়ীকে নৃশংসভাবে কুপিয়ে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। সিসিটিভি ক্যামেরার ফুটেজে দেখা যায়, রবিবার বিকালে রাজধানীর পল্লবীর ডি-ব্লকের ৩১ নম্বর রোডে দুই তরুণ দুই পাশ থেকে এক ব্যক্তিকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে কোপাচ্ছে। একপর্যায়ে ওই ব্যক্তি মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। এরপর হামলাকারীদের একজন চলে যায়। অন্যজন ওই ব্যক্তির ঘাড়ে কোপাতে থাকে মৃত্যু না হওয়া পর্যন্ত। র‌্যাব বুধবার গভীর রাতে নরসিংদীর ভৈরবে অভিযান চালিয়ে সাবেক এমপি আউয়ালকে এবং এর আগের রাতে চাঁদপুরের হাইমচর থেকে নূর মোহাম্মাদ হাসান (১৯) ও পটুয়াখালীর বাউফল থেকে জহিরুল ইসলাম ওরফে বাবুকে (২৭) গ্রেফতার করে। সুমন ব্যাপারীসহ দুজনকে গ্রেফতার করেছে ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগ (ডিবি)। এ নিয়ে ওই হত্যার ঘটনায় সাতজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তবে বৃহস্পতিবার দিবাগত রাতে মিরপুরে ইস্টার্ন হাউজিং এলাকায় র‌্যাবের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হন মো. মানিক (৩২)। নিহত সাহিনুদ্দিনের মা আকলিমা বেগমের অভিযোগ, পল্লবীর ১২ নম্বর সেকশনের বুড়ির টেকে (আলীনগর) তার ও তাদের স্বজনদের ১০ একর জমি রয়েছে। আশপাশের কিছু জমি দখল করে সেখানে হ্যাভেলী প্রোপার্টিজ ডেভেলপার লিমিটেড নামে আবাসন প্রকল্প গড়ে তোলেন আউয়াল। তাদের জমি জবরদখলে ব্যর্থ হয়ে আউয়াল ভাড়াটে সন্ত্রাসী দিয়ে সাহিনুদ্দিনকে খুন করান। গত বছর নভেম্বরেও সন্ত্রাসীরা সাহিনুদ্দিনকে কুপিয়ে জখম করেছিল। সেই ঘটনায় করা মামলায় পুলিশ কাউকে গ্রেফতার করেনি। উল্টো আউয়ালের দেওয়া মিথ্যা মামলায় সাহিনুদ্দিনকে গ্রেফতার করে পুলিশ। সপ্তাহখানেক আগে সাহিনুদ্দিন জামিনে মুক্তি পান।

র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন জানান, শুরু থেকেই নৃশংস এই হত্যাকান্ডের ছায়াতদন্ত করে আসছে র‌্যাব। অনেক কিছুই এরই মধ্যে বেরিয়ে এসেছে। কিলাররা আউয়ালের কলাবাগানের অফিসে বৈঠকও করেছিল।

জানা গেছে, ২০১৪ সালে বাইচান্স এমপি হয়েছিলেন বাংলাদেশ তরিকত ফেডারেশনের সাবেক মহাসচিব এম এ আউয়াল। এর আগে দেশের একজন প্রভাবশালী হাসপাতাল ব্যবসায়ীর তদবিরে বাংলাদেশ তরিকত ফেডারেশনের মহাসচিব হন তিনি। তবে এমপি বনে যাওয়ার পর থেকে ওই ব্যবসায়ীকে এড়িয়ে চলতেন আউয়াল। ২০১৮ সালে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে তরিকত ফেডারেশন তাকে মহাসচিব পদ থেকে অব্যাহতি দিলে তিনি ইসলামী গণতান্ত্রিক পার্টি নামে নতুন রাজনৈতিক দল গঠন করেন। তিনি দলটির চেয়ারম্যান।

সর্বশেষ খবর