রবিবার, ৩০ মে, ২০২১ ০০:০০ টা

বিশ্বের যে কোনো প্রান্তে শান্তি প্রতিষ্ঠায় প্রস্তুত বাংলাদেশ : প্রধানমন্ত্রী

নিজস্ব প্রতিবেদক

বিশ্বের যে কোনো প্রান্তে শান্তি প্রতিষ্ঠায় প্রস্তুত বাংলাদেশ : প্রধানমন্ত্রী

বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে সহযোগিতায় বাংলাদেশের দৃঢ় অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের অধীনে বাংলাদেশ বিশ্বের যে কোনো প্রান্তে শান্তি প্রতিষ্ঠায় সদাপ্রস্তুত রয়েছে। গতকাল গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে ঢাকা সেনানিবাসের সেনাকুঞ্জে ‘আন্তর্জাতিক জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী দিবস’-এর মূল অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির ভাষণে তিনি এ কথা বলেন।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমি বিশ্বাস করি আমাদের সশস্ত্র বাহিনী এবং পুলিশ বাহিনীর তরুণ সদস্যরা একুশ শতকের বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠার চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় প্রস্তুত রয়েছে। আগামীতেও যারা আসবে তাদের আমরা সেভাবেই তৈরি করতে চাই। তিনি বলেন, আমরা তরুণ এবং যুবশক্তিকে বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠার অন্যতম নিয়ামক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে চাই। কারণ, আমাদের তরুণসমাজ তারাও যেন এটা শিক্ষা গ্রহণ করে যে শান্তি একমাত্র উন্নয়ন ও নিরাপত্তার পথ। শান্তিই মানুষের কল্যাণের পথ এবং সে পথে যেন সবাই যেতে পারে এবং সেভাবেই যেন নিজেরা তৈরি হয়।

পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আবদুল মোমেন, সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল আজিজ আহমেদ, বাংলাদেশে জাতিসংঘের আবাসিক প্রতিনিধি মিয়া সেপ্পো অনুষ্ঠানে বক্তৃতা করেন। মিয়া সেপ্পো অনুষ্ঠানে জাতিসংঘ মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেসের একটি বার্তাও পড়ে শোনান। প্রধানমন্ত্রী অনুষ্ঠান থেকে দক্ষিণ সুদান, কঙ্গো, সেন্ট্রাল আফ্রিকা রিপাবলিক এবং লেবাননে বাংলাদেশের শান্তিরক্ষী কন্টিনজেন্টের সঙ্গে ভিডিও কনফারেন্সে মতবিনিময় করেন এবং দেশের কেবল প্রধানমন্ত্রী নন, জাতির পিতার কন্যা হিসেবে তাদের সব সময় সবরকম সহযোগিতা প্রদানের আশ্বাস দেন। অনুষ্ঠানে তিনি জাতির পিতার জন্মশতবার্ষিকী উদ্যাপন উপলক্ষে একটি স্যুভেনির এবং ইউএন পিস কিপার্স জার্নালের একটি সংখ্যার মোড়ক উন্মোচন করেন।

বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠায় আত্মত্যাগকারী বাংলাদেশি শান্তিরক্ষীদের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে অনুষ্ঠানের শুরুতে সবাই দাঁড়িয়ে এক মিনিট নীরবতা পালন করেন। জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে বাংলাদেশের অংশগ্রহণ নিয়ে ‘বাংলাদেশ ইন গ্লোবাল পিস’ শীর্ষক একটি ভিডিও ডকুমেন্টারিও অনুষ্ঠানে প্রচারিত হয়। গত এক বছরে বিশ্বশান্তি স্থাপনে শহীদ এবং আহত সদস্য ও তাদের পরিবারের সদস্যদের মাঝে প্রধানমন্ত্রীর পক্ষে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আবদুল মোমেন পুরস্কার বিতরণ করে অনুষ্ঠানে তাদের সম্মানিত করেন।

প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তাবিষয়ক উপদেষ্টা মেজর জেনারেল (অব.) তারিক আহমেদ সিদ্দিক ও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সচিব তোফাজ্জল হোসেন মিয়া গণভবন প্রান্তে এবং পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মো. শাহরিয়ার আলম, নৌবাহিনী ও বিমান বাহিনী প্রধান, পুলিশের আইজিসহ ঊর্ধ্বতন সামরিক ও বেসামরিক কর্মকর্তা এবং সাবেক সশস্ত্র বাহিনী ও পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা এবং আমন্ত্রিত দেশি ও বিদেশি অতিথিরা সেনাকুঞ্জে উপস্থিত ছিলেন।

শেখ হাসিনা বলেন, এ মুহূর্তে বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠায় নিয়োজিত ১২২ দেশের ৮০ হাজার ১৮৪ জন শান্তিরক্ষীর মধ্যে ৬ হাজার ৭৪২ জন বাংলাদেশের। এ সংখ্যা বিশ্বে নিয়োজিত মোট শান্তিরক্ষীর ৮ দশমিক ৪০ শতাংশ যা আমাদের জন্য অত্যন্ত গৌরবের। এ ছাড়া বর্তমানে বাংলাদেশের ২৮৪ জন নারী শান্তিরক্ষী বিশ্বশান্তি রক্ষা কার্যক্রমে নিয়োজিত আছেন। বিশেষ করে আমার নারী পাইলটদের নিয়ে আমি খুব গর্ববোধ করি। কারণ আগে আমাদের সেনা, নৌ ও বিমান বাহিনীতে নারীদের কোনো স্থান ছিল না। পুলিশ বাহিনীতে জাতির পিতাই নারী অফিসার নিয়োগ করে গিয়েছিলেন। সব জায়গাতেই এখন নারীদের একটা ভালো সুযোগ রয়েছে এবং তারা সাফল্য দেখাচ্ছে। কাজেই আমি আমাদের মেয়েদেরও অভিনন্দন জানাই। তিনি বলেন, আমাদের শান্তিরক্ষীরা ৪০টি দেশে ৫৫টি ইউএন মিশন সফলতার সঙ্গে সম্পন্ন করেছে। বর্তমানে আটটি মিশনে আমাদের শান্তিরক্ষীরা নিয়োজিত আছে। এ ছাড়া দক্ষিণ সুদানে ডেপুটি ফোর্স কমান্ডার হিসেবে মেজর জেনারেল পদবির কর্মকর্তা এবং কঙ্গো, সেন্ট্রাল আফ্রিকান রিপাবলিক ও দক্ষিণ সুদানে সেক্টর কমান্ডার হিসেবে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল পদবির কর্মকর্তা নিযুক্ত রয়েছেন। তাদের দক্ষতার কারণেই তারা এ পদ পেয়েছেন।

কভিড-১৯ মানুষকে ভীষণ কষ্ট দিচ্ছে উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, আমাদের যারা শান্তিরক্ষী রয়েছে, সবাইকে আমি বলব এই সময় খুব শান্ত ও ধীরস্থিরভাবে পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে হবে। কারণ সব দেশেই একটা অসহিষ্ণুতা, অনিশ্চয়তা দেখা দিচ্ছে। আল্লাহর ওপর বিশ্বাস রাখতে হবে। আর আমরা যে শান্তির সংস্কৃতিতে বিশ্বাস করি সে কথা সব সময় মনে রাখতে হবে।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমার সব থেকে ভালো লাগে যেখানে যেখানে আমাদের শান্তিরক্ষীরা কাজ করেছে, সে দেশের সরকার ও রাষ্ট্র প্রধানদের সঙ্গে যখনই কোনো আন্তর্জাতিক ফোরামে দেখা হয়েছে, আমাদের শান্তিরক্ষীদের তারা ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। গর্বে বুক আমার ভরে গেছে। তিনি বলেন, যে সম্মানটা আমরা পেয়েছি তা ধরে রেখেই আমাদের এগিয়ে যেতে হবে। জাতির পিতা যে আদর্শ নিয়ে এ দেশ স্বাধীন করে গেছেন সে আদর্শ নিয়েই আমরা দেশ পরিচালনা করছি।

বাংলাদেশ সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী, বিমান বাহিনী এবং পুলিশ বাহিনীর সব শান্তিরক্ষীকে বিশ্বব্যাপী শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে তাদের বর্তমান পেশাদারি, সততা, নিষ্ঠা ও আন্তরিকতা বজায় রাখার জন্য আহ্বান জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, প্রয়োজনীয় সব সরঞ্জামসহ বাংলাদেশের সব শান্তিরক্ষী যাতে আরও আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে জাতিসংঘের আহ্বানে সাড়া দিতে পারে, সেজন্য আমাদের সরকারের সব প্রয়াস অব্যাহত থাকবে। বিশ্ববাসীর পাশাপাশি বাংলাদেশের জনগণ বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠায় আপনাদের এ ভূমিকা চিরকাল স্মরণ করবে। শান্তিরক্ষা মিশনে ১৯৮৮ সাল থেকে এ পর্যন্ত অংশগ্রহণ করে বাংলাদেশের ১৫৯ জন শান্তিরক্ষী শহীদ এবং ২৪০ জন আহত হয়েছেন। সম্প্রতি শান্তিরক্ষা মিশনে কর্তব্যরত অবস্থায় আত্মোৎসর্গকারী আট বাংলাদেশিকে জাতিসংঘের হ্যামারশোল্ড পদকে ভূষিত করা হয়, যা একক দেশ হিসেবে সর্বোচ্চ। প্রধানমন্ত্রী কভিড-১৯ পরিস্থিতি সম্পর্কে বলেন, বিশ্বের অনেক উন্নত দেশ যেখানে হিমশিম খাচ্ছে, কিন্তু বাংলাদেশে সবাই যাতে নিরাপদ থাকতে পারে এবং করোনাভাইরাসের কারণে যাতে বেশি প্রাণহানি না হয় বা প্রাদুর্ভাব বেশি না ছড়ায় তার জন্য যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি আর্থসামাজিক কর্মকান্ড যেন স্থবির না হয়ে যায় সেদিকে লক্ষ্য রেখেই বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে এবং সফলতার সঙ্গে তা এগিয়ে যাচ্ছে। ইতিমধ্যে বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে উন্নীত হয়েছে। উন্নয়নের এ ধারাবাহিকতা অব্যাহত রাখার ওপর গুরুত্বারোপ করে তিনি বলেন, জনগণের মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি পেয়েছে, খাদ্যের সঙ্গে জনগণের পুষ্টি চাহিদা মেটানোর চেষ্টা চলছে। করোনার কারণে শিক্ষা ক্ষেত্রে যে সমস্যা চলছে তা দূর করতেও তাঁর সরকার পদক্ষেপ নেবে।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে যারা নিয়োজিত তারা যেন নিজ পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে পারে ইতিমধ্যে সে পদক্ষেপ সরকার নিয়েছে। দুর্গম এলাকায়ও ভি-স্যাটের মাধ্যমে ব্যয়বহুল ইন্টারনেট সংযোগ প্রদান করা হয়েছে। বাংলাদেশি শান্তিরক্ষীদের অধিকতর নিরাপত্তা প্রদানের জন্য কন্টিনজেন্টসমূহে এলএভি অ্যাম্বুলেন্স, আইইডি জ্যামারসহ মাইন রেজিস্ট্যান্ট অ্যাম্বুশ প্রটেকটেড ভেহিক্যাল (এমআরএপি) সংযোজন করা হয়েছে।

শান্তিরক্ষী দিবস-২০২১ উদ্যাপন : বাংলাদেশি শান্তিরক্ষীদের শান্তির রাষ্ট্রদূত আখ্যা দিয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আবদুল মোমেন বলেছেন, বাংলাদেশকে শান্তিকামী দেশ হিসেবে বিদেশে ব্র্যান্ডিং এবং বিশ্বব্যাপী শান্তিপূর্ণ শৃঙ্খলা গঠনে অবদান রাখছে আমাদের শান্তিরক্ষীরা। গতকাল জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী দিবস উপলক্ষে রাজধানীর তেজগাঁও বিএএফ সেন্ট্রাল মসজিদের সামনে শান্তিরক্ষী র‌্যালির উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এসব কথা বলেন।

আইএসপিআর জানায়, বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও গতকাল ২৯ মে যথাযোগ্য মর্যাদায় আন্তর্জাতিক জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী দিবস উদ্যাপিত হয়। জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে অংশগ্রহণকারী বিশ্বের সব দেশের শান্তিরক্ষীদের অসামান্য অবদানকে এদিন গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করা হয়। শান্তিরক্ষী দিবসের কর্মসূচির অংশ হিসেবে বেলা ১১টায় সেনাকুঞ্জে শহীদ শান্তিরক্ষীদের নিকটাত্মীয় এবং আহত শান্তিরক্ষীদের সংবর্ধনা দেওয়া হয়। অনুষ্ঠানে মন্ত্রিপরিষদের সদস্য, সেনাবাহিনী প্রধান, ভারপ্রাপ্ত নৌবাহিনী প্রধান, বিমানবাহিনী প্রধান, সশস্ত্র বাহিনী বিভাগের প্রিন্সিপ্যাল স্টাফ অফিসার (পিএসও), পুলিশের মহাপরিদর্শকসহ ঊর্ধ্বতন সামরিক-বেসামরিক ব্যক্তিবর্গ উপস্থিত ছিলেন।

আইএসপিআর জানায়, সিলেট ও রংপুর সেনানিবাসে উৎসাহ-উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে আন্তর্জাতিক শান্তিরক্ষী দিবস উদ্যাপিত হয়। দিবসটি উপলক্ষে সিলেট— রংপুর সেনানিবাসে পিসকিপারস রান, আলোচনা সভা এবং বাংলাদেশি শান্তিরক্ষীদের বিভিন্ন কার্যক্রমের ওপর নির্মিত বিশেষ প্রামাণ্যচিত্র প্রদর্শন করা হয়।

নিজস্ব প্রতিবেদক, খুলনা জানান, নৌবাহিনীর ব্যবস্থাপনায় বিভিন্ন কর্মসূচির মধ্য দিয়ে গতকাল খুলনায় আন্তর্জাতিক শান্তিরক্ষী দিবস উদ্যাপিত হয়েছে। দিবসটি উপলক্ষে খুলনা সার্কিট হাউস প্রাঙ্গণে আয়োজিত অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তৃতা করেন কমান্ডার খুলনা নেভাল এরিয়া রিয়ার অ্যাডমিরাল আশরাফুল হক চৌধুরী। এতে প্রধান অতিথি ছিলেন সিটি মেয়র তালুকদার আবদুল খালেক। সকালে খুলনার শিববাড়ী মোড় থেকে সার্কিট হাউস পর্যন্ত বর্ণাঢ্য র‌্যালির আয়োজন করা হয়।

নিজস্ব প্রতিবেদক, রাজশাহী জানান, গতকাল সকালে রাজশাহী কলেজে বেলুন ও ফেন্টুন উড়িয়ে, সংক্ষিপ্ত সমাবেশ করে শান্তিরক্ষী দিবস পালিত হয়েছে। এতে রাজশাহী মেট্রোপলিটন পুলিশ, রাজশাহী জেলা পুলিশ, সেনাবাহিনী ও আরআরএফ অংশ নেয়।

নিজস্ব প্রতিবেদক, বরিশাল জানান, বরিশালে বর্ণাঢ্য র‌্যালি এবং আলোচনা সভার মধ্য দিয়ে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী দিবস পালিত হয়েছে। বরিশাল মেট্রোপলিটন পুলিশের (বিএমপি) উদ্যোগে সকালে মহানগরের কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের সামনে থেকে একটি বর্ণাঢ্য র‌্যালি বের হয়। এর আগে বিএমপি কমিশনার মো. শাহাবুদ্দিন খান বেলুন উড়িয়ে দিবসের কর্মসূচির উদ্বোধন করেন।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর