সোমবার, ২১ জুন, ২০২১ ০০:০০ টা

ভয়ংকর রূপে পারিবারিক সামাজিক অপরাধ

সাখাওয়াত কাওসার

ভয়ংকর রূপে পারিবারিক সামাজিক অপরাধ

বেড়েই চলেছে পারিবারিক সহিংসতার ঘটনা। আশঙ্কাজনকভাবে অস্থির হয়ে উঠছে সমাজের পরিবেশ। মাঝেমধ্যেই ঘটছে নৃশংস হত্যার মতো ঘটনা। বাবার হাতে সন্তান কিংবা ভাইয়ের কাছে বোনও নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। চরমভাবে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে শিশুদের স্বাভাবিক বিকাশ। হুমকির মুখে পড়ছে দেশের ভবিষ্যৎ নেতৃত্ব। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গবেষণা চালিয়ে পারিবারিক ও সামাজিক অস্থিরতার সুনির্দিষ্ট কারণ খুঁজে বের করা অপরিহার্য হয়ে উঠেছে। নয় তো চরম মূল্য দিতে হবে খোদ রাষ্ট্রকে। তবে বিদ্যমান আইনের যথাযথ প্রয়োগ নিশ্চিত করা অতীব জরুরি। অনেক সমাজবিজ্ঞানীর মতে, অযাচিত আকাশ সংস্কৃতি এবং ইন্টারনেটের অপব্যবহারের কারণেই বাড়ছে সামাজিক অস্থিরতা। যৌথ পরিবারের মানসিকতা থেকে বেরিয়ে আসা, সামাজিক মূল্যবোধের অভাব এবং নৈতিকতার অবক্ষয়ও এ জন্য অনেকাংশে দায়ী।

মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) পরিসংখ্যান বলছে, চলতি বছরের শুরু থেকে ৩০ মে পর্যন্ত সারা দেশে ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে ৫০২টি। এর মধ্যে গ্যাং রেপ ৯৯টি। ধর্ষণের পর হত্যাকান্ড ২২টি এবং ধর্ষণচেষ্টা হয়েছে ১০৪টি। স্বামীর হাতে স্ত্রীর মৃত্যুর সংখ্যা ৯৫টি। স্বামীর পরিবারের দ্বারা হত্যার ঘটনা ২৯টি। স্বামী কর্তৃক নির্যাতন ২৩টি এবং স্বামীর পরিবারের সদস্যদের দ্বারা নির্যাতনের সংখ্যা ৬টি। পারিবারিক অশান্তির জন্য আত্মহত্যার ঘটনা ৫৬টি। শ্লীলতাহানির শিকার হয়েছেন ৫২ জন নারী।

জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক আবদুল হামিদ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, অতিমাত্রায় দুশ্চিন্তা, মানসিক চাপ, আস্থার অভাব, অবিশ্বাস থেকেই মানসিক সমস্যার সৃষ্টি হয়। তবে ইন্টারনেটের অযাচিত ব্যবহার এ ক্ষেত্রে বিরূপ ভূমিকা পালন করছে। শিশুদের ইন্টারনেট ব্যবহারের ক্ষেত্রে অভিভাবকদের আরও সতর্ক হওয়া উচিত। অভিভাবকদেরও তাদের দায়িত্ববোধ সম্পর্কে আরও সচেতন হওয়া দরকার। একই সঙ্গে কর্তৃপক্ষের উচিত হবে ধর্মীয় ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকেন্দ্রিক সচেতনতামূলক এবং নৈতিক শিক্ষার ওপর বিভিন্ন প্রশিক্ষণের উদ্যোগ নেওয়া। ধর্মীয় অনুশাসন বাড়ানোর দিকে দৃষ্টি দেওয়ারও পরামর্শ তার।

সাম্প্রতিক সময়ের কয়েকটি ঘটনা বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, রাজধানীর কদমতলীতে বাবা-মা এবং বোনকে খুন করে ট্রিপল নাইনে (৯৯৯) ফোন করেন মেহজাবিন নামের এক তরুণী। বলেন, ‘বাবা, মা ও বোনকে খুন করেছি, তাদের উদ্ধার করুন। আপনাদের আসতে দেরি হলে আমার স্বামী এবং মেয়েকেও খুন করব।’ ৩০ মে রাজধানীর মহাখালীতে ময়না মিয়া নামের এক অটোরিকশাচালককে তার দ্বিতীয় স্ত্রী ফাতেমা ছয় টুকরো করে রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে ফেলে যান। পুলিশ মরদেহের বিভিন্ন অংশ উদ্ধার করে পরিচয় শনাক্ত করে জানতে পারে, পারিবারিক কলহের জেরে ফাতেমা তার স্বামীকে নির্মমভাবে হত্যার পর একেক টুকরা একেক জায়গায় ফেলে দিয়েছেন। এর পরদিন ৩১ মে কলাবাগানে ডাক্তার সাবিরা নামের এক নারী চিকিৎসককে হত্যা করে তোশকে আগুন ধরিয়ে দেওয়ার ঘটনা ঘটে। ধারালো অস্ত্র দিয়ে সাবিরার শ্বাসনালি কেটে ফেলে হত্যা করা হয়েছে। এ ঘটনায় দায়ের করা মামলার তদন্ত-সংশ্লিষ্টদের ধারণা, পারিবারিক বিরোধের কারণেই খুন হতে পারেন এই চিকিৎসক। একই দিন রাজধানীর অদূরে গাজীপুরে পরকীয়ার জেরে সুমন মোল্লা নামের এক যুবককে খুন করে লাশ ছয় টুকরো করার দায়ে তার স্ত্রী আরিফা ও স্ত্রীর পরকীয়া প্রেমিক তনয়কে আটক করে পুলিশ।

১৯ মে দিবাগত রাতে রাজধানীর দক্ষিণখানের সরদারবাড়ী জামে মসজিদের ইমাম আবদুর রহমান নিজ কক্ষেই পোশাকশ্রমিক আজাহারকে (৩০) হত্যার পর কোরবানির পশু জবাইয়ের ছুরি দিয়ে মরদেহ ছয় টুকরো করেন। পরে টুকরোগুলো গুম করতে মসজিদের নির্মাণাধীন সেপটিক ট্যাঙ্কে ফেলে দেওয়া হয়। নিহতের স্ত্রী আসমা বেগমের (২৪) সঙ্গে পরকীয়ার জেরেই ইমাম আবদুর রহমান এ হত্যার ঘটনা ঘটান বলে আদালতে স্বীকারোক্তি দিয়েছেন। এর আগে ১১ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর ওয়ারীতে সজীব হাসান নামে ৩৪ বছর বয়সী এক যুবকের পাঁচ টুকরো লাশ উদ্ধার করা হয়। মা ও মেয়ে দুজনের সঙ্গেই পরকীয়া প্রেমের জেরে খুন হন সজীব। পুলিশ এ ঘটনায় শাহানাজ পারভীন নামের এক নারীকে রক্তমাখা ছুরি ও বঁটিসহ ঘটনাস্থল থেকে গ্রেফতার করে। শুধু ঢাকা নয়, পুরো দেশেই পারিবারিক কলহ আর দ্বন্দ্বের কারণে হত্যা বাড়ছে। মে মাসে সারা দেশে ১২৯ জন হত্যার শিকার হয়েছেন।

এদিকে পারিবারিক সহিংসতা ঠেকাতে কিংবা সামাজিক অস্থিরতার ওপর আইন প্রয়োগকারী সংস্থার খুব একটা ভূমিকা রাখার সুযোগ নেই বলে দাবি করেছেন ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনার মোহা. শফিকুল ইসলাম। গতকাল সন্ধ্যায় তিনি বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, পরিবারের বিষয়ে কীভাবে পুলিশ হস্তক্ষেপ করবে? তবে ইন্টারনেটের ডিভাইস ব্যবহারের ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা উচিত পরিবার থেকেই। কারণ বর্তমান সময়ে শুধু শিশু কেন, তার অভিভাবকরাই ইন্টারনেটে বুঁদ হয়ে থাকছেন। এতে বাবা-ছেলে, ভাই-বোন কিংবা মা-ছেলের সম্পর্কও চাপা পড়ে যাচ্ছে প্রযুক্তির কাছে। তবে মাদকাসক্তদের মানুষ হিসেবে মানতেই তিনি নারাজ। তিনি বলেন, ‘মাদকের বিরুদ্ধে আমাদের জিরো টলারেন্স অব্যাহত থাকবে।’

বিবাহবহির্ভূত সম্পর্ককে পারিবারিক কলহের অন্যতম নিয়ামক বলছেন বিশেষজ্ঞরা। এর কারণ হিসেবে তারা বলছেন, ধর্মীয় অনুশাসন থেকে দূরে সরে যাওয়া এবং পারস্পরিক অবিশ্বাস ও আস্থাহীনতা। আকাশ সংস্কৃতির কারণে বিভিন্ন চ্যানেলের সিরিয়ালগুলোও নৈতিক স্খলনের ক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা রাখছে। দিচ্ছে হত্যার উসকানি। আর তখনই নরকে রূপান্তরিত হচ্ছে পরিবার। বিরূপ প্রভাব পড়ছে সমাজেও।

বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য এবং সমাজবিজ্ঞানী অধ্যাপক সাদেকুল আরেফিন মতিন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, সামগ্রিক অসহিষ্ণুতার কারণেই পারিবারিক অসহিষ্ণুতা বাড়ছে। এ ক্ষেত্রে আকাশ সংস্কৃতি এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের অযাচিত ব্যবহারও অন্যতম একটি কারণ। যৌথ পরিবার থেকে নিউক্লিয়ার পরিবারের দিকে ঝুঁকে পড়াও এমন অস্থিরতার ক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা রাখছে।

তিনি বলেন, এর থেকে উত্তরণের জন্য দৃষ্টান্তমূলকভাবে শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। স্কুল-কলেজ এবং বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানকেন্দ্রিক মোটিভেশনাল প্রোগ্রাম হাতে নিতে হবে। এসব ক্ষেত্রে এনজিওগুলোকেও চাইলে সরকার কাজে লাগাতে পারে। পারিবারিক অস্থিরতা বিরাজ করলে তা শিশুদের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলে। ক্রমান্বয়ে তা ছড়িয়ে পড়ে সমাজের প্রতিটি স্তরে।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর