শিরোনাম
সোমবার, ১৬ আগস্ট, ২০২১ ০০:০০ টা

তালেবান নিয়ে উদ্বেগ নয়, প্রয়োজন সতর্কতার

জিন্নাতুন নূর

তালেবান নিয়ে উদ্বেগ নয়, প্রয়োজন সতর্কতার

হুমায়ুন কবির

তালেবানদের কাছে আফগান সরকারের ক্ষমতা হস্তান্তরে উদ্বেগের কোনো কারণ না থাকলেও সতর্কতার প্রয়োজন আছে। যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন কবির এমনটিই মনে করেন। গতকাল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে দেওয়া এক টেলিফোন সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, আমরা তালেবানদের আগে যেভাবে দেখতাম তা এখন বদলেছে। আগের চেয়ে তারা একটু কৌশলী হয়েছে। তবে তারা কতটা বদলেছে তা বোঝা যাবে যখন তারা ক্ষমতায় আসবে। আফগানিস্তান সম্পর্কে আমাদের আগের অভিজ্ঞতা হয়তো তালেবানদের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করবে, কিন্তু আমরা অবস্থার বস্তুনিষ্ঠ বিচার বিশ্লেষণের মাধ্যমেই সিদ্ধান্তে যাওয়াকে উপযুক্ত মনে করি।

হুমায়ুন কবির বলেন, তালেবানদের নিয়ে আমাদের উদ্বেগের কারণ দেখছি না। শুধু আতঙ্কিত বা শুধু আশাবাদী না হওয়ার চেয়ে আফগানিস্তানের অবস্থাকে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করে বস্তুনিষ্ঠভাবে জিনিসগুলো বিশ্লেষণ করে তবেই তালেবানদের বিষয়ে সিদ্ধান্তে পৌঁছানো সমীচীন হবে। তবে এটি ঠিক যে, তালেবানরা অসাধারণ সামরিক কার্যক্রম পরিচালনা করেছে। কাবুল সরকার ও আফগান সেনাবাহিনী একেবারে ধসে গেছে। তালেবানরাও হয়তো ভাবেনি যে তারা এত দ্রুত কাবুল পৌঁছে যাবে। ফলে একদিকে তালেবানরা যেমন তাদের কৌশল সফলভাবে দেখিয়েছে, অন্যদিকে আফগান সরকারের ধসে পড়াটাও লক্ষ্যণীয়। আফগানিস্তান সম্পর্কে বস্তুনিষ্ঠ সিদ্ধান্ত নিতে হলে আগামী দিনে এটি বিশ্লেষণ করতে হবে, কেন এত  সম্পদ ও প্রতিষ্ঠান থাকা সত্ত্বেও আফগান সরকার ধসে পড়ল। 

তিনি বলেন, তালেবানরা অসাধারণ দ্রুতগতিতে গোটা আফগানিস্তান দখলে নিয়েছে। আমি মনে করি, জনগণের সম্পৃক্ততা না থাকলে একটি দেশের এতগুলো প্রদেশ এত স্বল্প সময়ে কোনো গোষ্ঠীর পক্ষে দখল করা সম্ভব নয়। এটা বুঝতে হবে, এর পেছনে জনগণেরও সমর্থন আছে। এখন প্রশ্ন উঠতেই পারে, কী কারণে এই সমর্থন থাকতে পারে। এ জন্য বেশ কয়েকটি কারণ থাকতে পারে। মার্কিনিরা বা ন্যাটো শক্তি এবং কাবুলে যে সরকার ছিল তারা সামরিকীকরণের দিকেই বেশি মনোযোগী ছিল। সেখানে সাধারণ মানুষের যে চাহিদা বা প্রয়োজন তারচেয়ে তারা সামরিকীকরণের দিকে বেশি মনোযোগী ছিল। আফগান সেনাবাহিনীর পেছনেই তারা বেশি অর্থ ব্যয় করেছে। ফলে জনগণের সঙ্গে সরকারের বড় দূরত্ব তৈরি হয়। আবার সামরিক বাহিনী তৈরির জন্য মার্কিনিরা এত অর্থ দিয়েছে কিন্তু বিভিন্ন তথ্য উপাত্তে দেখা যাচ্ছে আসলেই এই খরচ কাগজেকলমে হয়েছে। এর বেশির ভাগ অর্থই হয়তো যারা সুবিধাভোগী তাদের পকেটে চলে গেছে। ফলে ব্যাপক জনগণ এর সুফল থেকে বঞ্চিত হয়েছে।

সাবেক এই রাষ্ট্রদূত বলেন, একটি জিনিস স্পষ্ট হলো যে, বাইরে থেকে এসে যতই একটি ব্যবস্থা চালু করার চেষ্টা করা হোক না কেন স্থানীয় সংস্কৃতি, স্থানীয় মানুষের ইতিহাস ও জীবনযাত্রা এর সঙ্গে যদি সংগতিপূর্ণ না হয় তাহলে সেই ব্যবস্থাকে টেকসই করা খুব কঠিন হয়ে পড়ে। আফগানিস্তানে ঠিকই সরকারি উপরি কাঠামোগত ব্যবস্থা এবং প্রশাসন ছিল, কিন্তু এখন মনে হচ্ছে এর কোনোটিই কার্যকর হয়নি যখন তারা তালেবান চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে।

হুমায়ুন কবির বলেন, তালেবানরা যদি সামরিক শক্তি দমাতে পারে তাহলে যারা তালেবান আদর্শে বিশ্বাসী তারা উৎসাহিত হতেই পারে। যারা এ ধরনের রাজনীতি করে বা যারা এ ধরনের চিন্তা-চেতনার মানুষ তারা উৎসাহিত বোধ করবে। তবে একটি জিনিস খেয়াল রাখতে হবে, তালেবানরা বিগত কয়েক বছর ধরে তাদের বাইরের যোগাযোগ অনেক বাড়িয়েছে। তারা অনেকটা কূটনৈতিক যুদ্ধের মাধ্যমে আফগান সরকারকে হারিয়ে দিয়েছে। ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে দোহাতে যে চুক্তি হয় সেখানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কিন্তু তালেবানদের সঙ্গে চুক্তি করেছিল। সেখানে আফগান সরকার ছিল না। এর অর্থ দাঁড়াচ্ছে তালেবানরা যথেষ্ট পরিমাণ কূটনৈতিক বুৎপত্তি দেখিয়েছে। আর এই কূটনৈতিক বুৎপত্তিকে একেবারে ফেলে দেওয়া যাবে না। কারণ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটোর মতো শক্তিকে মোকাবিলা করে এবং আফগান সরকারকে বিচ্ছিন্ন করে তারা এই চুক্তি করেছে। আর সেই চুক্তির ধারাবাহিকতায় আজ তালেবানরা এই জায়গায় এসেছে। আবার অভ্যন্তরীণভাবেও তালেবানরা আফগান জনগণের কাছে প্রমাণ করতে পেরেছে যে, আফগান সরকার দ্বিজাতীয় সরকার। এ সরকার জনগণের কোনো প্রতিনিধিত্ব করে না। তালেবানরা পশ্চিম ও উত্তর দিক থেকে আক্রমণ করেছে। যার মাধ্যমে যুদ্ধে তারা চমৎকার কৌশলও দেখিয়েছে। এখন তারা আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির জন্য চীন, রাশিয়া, ইরান ও পাকিস্তানের সঙ্গে কাজ করছে। অর্থাৎ এবার তালেবানরা বাইরের পৃথিবী কী ভাবছে সেটিও চিন্তা করছে। এমনকি কাবুলের দরজায় দাঁড়িয়ে থেকেই তারা বলছে যে, আমরা জোর করে ঢুকব না বরং আলোচনার মধ্য দিয়ে অবস্থা সৃষ্টি করে তবেই কাবুলে প্রবেশ করব। এটাও এক ধরনের কৌশল। তারা মানবাধিকার, নারীর অধিকার, সেখানকার ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠাীর অধিকার কতটা সুনিশ্চিত করতে পারে, জীবনযাত্রাকে কতটা স্বাভাবিক রেখে আফগানিস্তানে পরিবর্তন আনতে পারে এর ওপর নির্ভর করবে তালেবানরা কি আগের মতো আছে নাকি বদলেছে। যদি তারা বদলে গিয়ে থাকে তাহলে তালেবানদের নিয়ে যে আশঙ্কা করা হচ্ছে সেটি বাস্তবে নাও হতে পারে। তখন তালেবানরা ক্ষমতায় থাকলেও আফগানিস্তান স্বাভাবিক রাষ্ট্র থাকবে। তখন বাংলাদেশেরও তেমন উদ্বেগের কোনো কারণ থাকবে না। আবার যারা তালেবানদের আদর্শে উৎসাহী তাদেরও উৎসাহিত হওয়ার কারণ থাকবে না। বিষয়গুলো বস্তুনিষ্ঠভাবে বিচার-বিশ্লেষণ করে তবেই এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। 

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর