মঙ্গলবার, ১৯ অক্টোবর, ২০২১ ০০:০০ টা

আর্থিক ও স্বাস্থ্যের চেয়ে করোনায় বড় ক্ষতি মানবসম্পদে

ড. হোসেন জিল্লুর রহমান

নিজস্ব প্রতিবেদক

করোনাভাইরাস মহামারীতে আর্থিক ও স্বাস্থ্যগত ক্ষতির চেয়ে বড় ক্ষতি হয়েছে মানবসম্পদে। এটার ঝুঁকি এখনো কমেনি। মানবসম্পদ খাতের ক্ষতি কাটাতে সরকারের উদ্যোগ নেওয়া জরুরি। এ ছাড়া দীর্ঘ বিরতির পর যে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা হয়েছে তাতে শিক্ষা খাতের ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়া যাবে কি না- তা নিয়েও সংশয় রয়েছে বলে মনে করেন পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টারের (পিপিআরসি) নির্বাহী চেয়ারম্যান ড. হোসেন জিল্লুর রহমান।

গতকাল ভার্চুয়ালি অনুষ্ঠিত পিপিআরসি ও ব্র্যাক বিআইজিডির এক     ওয়েবিনারে এসব কথা বলেন তিনি। এতে আরও বক্তব্য রাখেন বিআইজিডির নির্বাহী পরিচালক ড. ইমরান মতিন। কভিড-১৯ লিভলিহুড অ্যান্ড রিকভারি প্যানেল সার্ভের ফলাফল প্রকাশ উপলক্ষে ওয়েবিনারে এক সংবাদ সম্মেলন আয়োজন করা হয়। জরিপের তথ্যে উল্লেখ করা হয়, করোনা মহামারীর কারণে দেশব্যাপী দীর্ঘদিন স্কুল বন্ধ ছিল। এর প্রভাবে গত ছয় মাসে শিক্ষাক্ষেত্রে আরও অবনতি হয়েছে। সম্প্রতি দেশের গ্রামে এবং শহরের বস্তি এলাকায় করা একটি জরিপে দেখা গেছে, কমপক্ষে ২২ শতাংশ প্রাথমিক এবং ৩০ শতাংশ মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষার্থী স্কুল বন্ধ থাকায় লার্নিং লস বা শিক্ষণ ঘাটতির ঝুঁকিতে আছে। এই জরিপের উদ্দেশ ছিল ২০২১ সালের মার্চ থেকে আগস্ট পর্যন্ত শিশুদের শিক্ষাজীবনে কী কী পরিবর্তন এসেছে তা জানা। এরপর একটি শিক্ষণ মডিউল তৈরি করা হয়। প্রথমটি করা হয় ২০২১ এর মার্চে, পরেরটি একই বছরের আগস্টে। গবেষণার এই সময়কালটুকু পুনরায় স্কুল খোলার যে বাস্তবতা, সে ব্যাপারে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিয়েছে। জরিপে উঠে এসেছে, অনেক শিক্ষার্থী নিজে নিজেই পড়াশোনা করে, কেউ কেউ অনিয়মিতভাবে পড়াশোনা করে, অথবা একেবারেই পড়াশোনা করে না। গবেষকদের মতে, এমন শিক্ষার্থীরাই আছে শিক্ষণ ঘাটতি বা লার্নিং লসের ঝুঁকিতে।

গ্রাম এবং শহুরে বস্তি এলাকায় চলতি বছরের মার্চ থেকে আগস্ট মাস পর্যন্ত প্রাথমিক এবং মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মাঝে শিক্ষণ ঘাটতি বা লার্নিং লসের ঝুঁকি বৃদ্ধি পেয়েছে। লার্নিং লস বা শিক্ষণ ঘাটতির এই প্রবণতা আবার মাধ্যমিকে পড়ুয়া কিশোরদের মধ্যে বেশি দেখা গেছে।

তাদের মধ্যে এই ঝুঁকি ২৬ শতাংশে থাকলেও আগস্টে তা বেড়ে ৩৪ শতাংশে দাঁড়ায়। দূরশিক্ষণের মূল উপায় হলো টেলিভিশনে রেকর্ড করা ক্লাস এবং অনলাইন ও সরাসরি অনলাইন ক্লাস। তবে এসব ক্লাসে থাকার সুযোগ খুব কম শিক্ষার্থীরই হয়েছে। প্রাথমিকে পড়ুয়া ৫৬ শতাংশ এবং মাধ্যমিকে পড়ুয়া ৬৫ শতাংশ শিক্ষার্থী মার্চে গৃহশিক্ষকের কাছে পড়লেও কিংবা কোচিং করলেও আগস্টে সেই হার কমে দাঁড়ায় যথাক্রমে ৪৮ শতাংশ এবং ৪৩ শতাংশ। আগের মতো সবকিছু চালু হওয়ায় ও জীবিকার তাগিদে কাজে যোগ দেওয়ার কারণে মার্চের তুলনায় পরবর্তীতে শিক্ষা খাতে পরিবার থেকে সহায়তার হারও কমেছে। বিশেষত, মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষার্থীরাই এর ভুক্তভোগী। অবশ্য আগস্টে সরাসরি যোগাযোগ করে বা সরাসরি যোগাযোগ না করে- এই দুই পদ্ধতির মিশ্রণে অ্যাসাইনমেন্ট করার ব্যাপারটি গ্রহণযোগ্যতা পায়। আগস্টে ১৮ শতাংশ প্রাথমিক এবং ৩৮ শতাংশ মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষার্থী এ সুবিধা পেয়েছে। স্কুল বন্ধ থাকার কারণে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে শিক্ষকদের যোগাযোগ তেমন না থাকলেও অ্যাসাইনমেন্ট জমা দেওয়ার সময় যোগাযোগ হতো। পিপিআরসি-বিআইজিডির গবেষণায় দেখা গেছে, শিক্ষণ ঘাটতি বা লার্নিং লসের এই সমস্যার পেছনে আর্থ-সামাজিক অসমতার একটি ভূমিকা রয়েছে। গবেষণায় প্রথমে একজন শিক্ষার্থীর লার্নিং লসের সঙ্গে তার মায়ের শিক্ষাগত যোগ্যতার সম্পর্ক দেখা হয়। যেমন যে মায়েরা কখনো স্কুলে যাননি, তাদের সন্তানরা শিক্ষিত মায়েদের সন্তানদের তুলনায় বেশি ঝুঁকিতে রয়েছেন। দ্বিতীয়ত, গৃহশিক্ষক কিংবা কোচিং সুবিধা করোনা মহামারীর আগেও পেয়েছে এমন শিক্ষার্থীদের অধিকাংশই মহামারী চলাকালীনও সেই সুযোগ পেয়েছে। তৃতীয়ত, গ্রামে ৪৪ শতাংশ পরিবারে এবং শহরের বস্তিতে ৩৬ শতাংশ পরিবারে অনলাইন শিক্ষা গ্রহণের জন্য যে উপকরণ দরকার, তার ব্যবস্থা নেই। চতুর্থত, ৮ শতাংশের বেশি স্কুলগামী শিক্ষার্থী উভয় সময়েই উপার্জনের জন্য কাজ করেছে। দেখা যাচ্ছে, মহামারী দেশের শিক্ষায় যে বৈষম্য তা আরও বাড়িয়ে তুলেছে। যদিও এ দেশে ব্যাপারটি আগে থেকেই একটি বড় উদ্বেগের বিষয় ছিল। মহামারী এবং এর ফলে স্কুল বন্ধ থাকায় শিশুদের মানসিক স্বাস্থ্যেও পড়েছে বিরূপ প্রভাব। ২০২১ সালের আগস্ট মাসে ১৫ শতাংশেরও বেশি পরিবার জানিয়েছে, মহামারীর শুরু থেকেই স্কুল এবং কলেজগামী শিক্ষার্থীরা মানসিক চাপে ভুগছে। বাবা-মায়েরা জানিয়েছেন, স্কুল বন্ধ থাকাকালীন সন্তানদের আচরণ তুলনামূলক বেশি অসহনশীল, খিটমিটে এবং রাগান্বিত ছিল। এ হার মার্চে ৩৬ শতাংশ থাকলেও আগস্টে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৪২ শতাংশে।

সর্বশেষ খবর