শনিবার, ২৩ অক্টোবর, ২০২১ ০০:০০ টা

কক্সবাজার নিয়ে উৎকণ্ঠা

বিশেষজ্ঞরা বলছেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় রোহিঙ্গাদের নিয়ে বাড়াতে হবে আরও সতর্কতা

শামীম আহমেদ

রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে প্রত্যাবাসনের পক্ষে কাজ করা রোহিঙ্গা নেতা মুহিবুল্লাহ হত্যাকান্ডের এক মাস না যেতেই গতকাল রোহিঙ্গা ক্যাম্পে দুই গ্রুপের সংঘর্ষে আবারও ছয় রোহিঙ্গা নিহতের ঘটনায় উদ্বেগ চরমে পৌঁছেছে। নিরাপত্তা বিশ্লেষক ও বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, বারবার রোহিঙ্গা ক্যাম্পে এমন সংঘর্ষ উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনকে বাধাগ্রস্ত করতে দেশি-বিদেশি একাধিক গোষ্ঠী এর পেছনে জড়িত। নানাভাবে তারা ক্যাম্পগুলোতে প্রচুর অস্ত্র ঢুকিয়েছে। বিষয়টি দেশের নিরাপত্তা ও আঞ্চলিক শান্তির জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে, যা ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে।

এ ব্যাপারে নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর জেনারেল (অব.) এ কে মোহাম্মদ আলী শিকদার বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ২০১৭ সাল থেকে রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে গোলাগুলি ও হত্যা দেখছি। এখন বেড়ে গেছে। একটা বিষয় স্পষ্ট যে, রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে প্রচুর অস্ত্র ঢুকে পড়েছে। বহু সন্ত্রাসী সংগঠনের উদ্ভব হয়েছে। প্রশ্ন হচ্ছে- এত অস্ত্র ঢুকল কীভাবে? কোনো অস্ত্রই উদ্ধার হচ্ছে না। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, গোয়েন্দা সংস্থাগুলো কী করছে? রোহিঙ্গা ইস্যুটি অত্যন্ত সংবেদনশীল। শুরু থেকে বলছি, এটা দেশ ও দেশের মানুষের নিরাপত্তার জন্য যেমন হুমকি, তেমনি আঞ্চলিক শান্তির জন্যও হুমকি। সেই উদ্বেগ এখন চরমে পৌঁছেছে। তিনি বলেন, রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনকে বাধাগ্রস্ত করতে দেশি-বিদেশি বিভিন্ন গোষ্ঠী কাজ করছে। আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সন্ত্রাসী সংগঠন, আইএসআই, পাকিস্তানের লস্কর ই তাইয়েবার সঙ্গে দেশি অনেক সন্ত্রাসীর যোগসাজশে এই ঘটনাগুলো ঘটছে। এর প্রমাণও মিলেছে অনেকবার। ২০১৬ সালের ১২ মের আগে আসা রোহিঙ্গাদের নিরাপত্তায় থাকা আনসার  ক্যাম্পে হামলা করে কমান্ডারকে হত্যা করা হয়। ১১টি রাইফেল ও গুলি লুট করে। পরে এ ঘটনায় জড়িত রোহিঙ্গা নেতা ওমর ফারুক ধরা পড়ে, যে কি না পাকিস্তানের নাগরিক ও লস্কর ই তাইয়েবার সদস্য। এসব সন্ত্রাসী কর্মকান্ড ঘটিয়ে মিয়ানমারের হাতে ইস্যু তুলে দেওয়া হচ্ছে, যাতে তারা ফেরত নিতে অস্বীকার করে। একটা আঞ্চলিক অশান্তি জিইয়ে রাখার চেষ্টা চলছে। রোহিঙ্গা নেতা মুহিবুল্লাহ রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন নিয়ে কাজ করছিল। ক্যাম্পে ঢুকে তাকে হত্যা করা হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কী করছে? মুহিবুল্লাহর খুনি কেন গ্রেফতার হচ্ছে না? এই অপরাধীদের দ্রুত গ্রেফতার করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিয়ে বিশ্বকে জানাতে হবে, আমরা কোনো অপরাধীকে ছাড় দেব না। যারাই রোহিঙ্গা ক্যাম্পে সন্ত্রাস বিস্তারে ভূমিকা রাখছে, তারা দেশের শত্রু। রোহিঙ্গাদের দেশের জন্য হুমকিতে পরিণত করছে। এটা দেশের জন্য অশনি সংকেত।

নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর জেনারেল (অব.) মো. আবদুর রশীদ বলেন, রোহিঙ্গা ফেরত পাঠাতে বাংলাদেশ যে কাজ করে যাচ্ছে, অনেক অপশক্তি তা বানচালের চেষ্টা করছে। ক্যাম্পের ভিতরে নিরাপদ অবস্থা বিরাজ করলে তা প্রত্যাবাসনে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে। এই প্রত্যাবাসন বাধাগ্রস্ত করতে মিয়ানমারের সামরিক জান্তা তাদের এজেন্ট দিয়ে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে নিয়ন্ত্রণ আরোপের চেষ্টা করছে। প্রত্যাবাসনে রোহিঙ্গাদের মতামত একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। সেই মতামত ভয় দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করতে চাইছে। এই খেলা বন্ধ করতে হলে আমাদের নিরাপত্তা কৌশল বদলাতে হবে। ক্যাম্পের ভিতরে ও বাইরে সমানভাবে কাজ করে এমন নিরাপত্তা কৌশল নিতে হবে। আমরা বাইরের নিরাপত্তা যতটা সুন্দর দেখছি, ভেতরের নিরাপত্তা সেভাবে দেখছি না। ক্যাম্পের ভেতরের সকল ঝুঁকি বিবেচনায় নিয়ে নিরাপত্তা কৌশল সাজাতে পারলে এই সংঘর্ষ, হত্যা, অস্ত্র ও মাদকের বিস্তার বন্ধ করতে পারব। তিনি বলেন, রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে বিভিন্ন অপশক্তির অস্তিত্ব রয়েছে। বিভিন্ন গ্রুপ বিভিন্ন স্বার্থে কাজ করছে। কেউ কেউ বিদেশি শক্তির দ্বারা প্ররোচিত হয়ে কাজ করছে। এছাড়া মাদক ও অস্ত্র চোরাচালানের মতো অপরাধে জড়িত একাধিক চক্র ক্যাম্পগুলোতে কাজ করছে। তাদের প্রভাব, অস্তিত্ব, তারা কীভাবে কাজ করছে সেগুলোকে যদি আমরা চিহ্নিত করে নিশ্চিহ্ন করতে না পারি, তাহলে বাহ্যিক নিরাপত্তা দিয়ে সার্বিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যাবে না।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. দেলোয়ার হোসেন বলেন, শুরু থেকেই দেখছি রোহিঙ্গাদের মধ্যে এক ধরণের সামাজিক অপরাধের প্রবণতা আছে। তবে এতোদিন বড় ধরণের সমস্যা হয়নি। এখন পর পর দুটি বড় ঘটনা ঘটলো। ফলে নিরাপত্তা নিয়ে একটা উদ্বেগ দেখা দিয়েছে। কী কারণে এটা ঘটছে দ্রুত অনুসন্ধান প্রয়োজন। এটুকু বুঝতে পারছি এখানে একটা গোষ্ঠী ক্যাম্পের ভেতরে এক ধরণের অস্থিরতা তৈরি করতে চায়। রোহিঙ্গা ইস্যুটিকে দুইভাবে তারা সামনে আনতে চাইছে। প্রথমত রোহিঙ্গাদের নিরাপত্তা ইস্যুটা যে খুব গুরুত্বপূর্ণ ও বিশ্বে এই ইস্যুটা ক্রমেই চাপা পড়ে যাচ্ছে, সেটিকে আবার আলোচনায় আনা। আবার মুহিবুল্লাহ হত্যার পেছনে আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি (আরশা), এমনকি মিয়ানমারের সামরিক জান্তা সরকারের সংযোগ থাকার বিষয়টি বিভিন্ন জায়গায় আলোচনায় এসেছে। মুহিবুল্লাহ হত্যার প্রেক্ষাপটে দেখতে পাই, তার বিরুদ্ধে বেশ কয়েক জায়গায় বক্তব্য রাখা হয়েছে। কারণ, রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে তার শক্তিশালী অবস্থান ছিল। যারা প্রত্যাবাসনের পক্ষে আছে তাদের বিরুদ্ধে একটা সশস্ত্র গ্রুপ কাজ করছে। মোটা দাগে বললে, রোহিঙ্গাদের মধ্যে অপরাধ প্রবণতার বিষয়টি বেশ উদ্বেগজনক অবস্থায় সামনে আসছে। প্রধানমন্ত্রী আগেই বলেছিলেন, রোহিঙ্গা ইস্যুটি যে বড় ধরণের আঞ্চলিক সংকট তৈরি করবে, তার আলামত আমরা দেখতে পাচ্ছি।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর