রবিবার, ২৮ নভেম্বর, ২০২১ ০০:০০ টা

দালালনির্ভর শ্রমবাজার

বাজার চালুর আগেই নেওয়া হচ্ছে টাকা, বাধ্য করছে মানব পাচারে

জুলকার নাইন

দালালনির্ভর শ্রমবাজার

মালয়েশিয়ার শ্রমবাজারে এখনো কর্মী পাঠানোর পদ্ধতিই ঠিক হয়নি। কবে সমঝোতা স্মারক হবে তারই ঠিক নেই। কিন্তু মানিকগঞ্জের রুবেল ও শরীফুলের কাছ থেকে মালয়েশিয়া পাঠানোর টাকা নিয়েছে দালাল। অগ্রিম হিসেব নেওয়া হয়েছে অর্ধেক টাকা। নিয়ে রেখেছে পাসপোর্টও। শুধু এ দুজনই নন, আরও কর্মী সংগ্রহের কাজ করছে দালাল চক্র। রুবেল বলেন, ‘টাকা দিছি দুই মাস আগে। দালালের নাম বলতে নিষেধ আছে। বললে যাওয়ার সমস্যা হতে পারে।’

গত মাসে বগুড়ার ফরিদও সৌদি আরব গেছেন দালালের মাধ্যমেই। তিনি জানান, ‘এজেন্সির নামও জানি না, চিনিও না। টাকা দিছি এলাকার দালালের কাছেই। সে-ই আরও কিছু দালাল ধরে পাসপোর্ট, মেডিকেল টেস্ট সব করে দিছে।’ ফরিদের ভাষায়- ‘এতগুলো টাকা দিব, সেটা অপরিচিত মানুষের কাছে কেন দিব? দালালকেই চিনি তাই তাকেই দিছি।’

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘যারা বিদেশে যান তাদের শতভাগকে দালালির ওপর নির্ভর করে যেতে হয়। তাই অন্য দেশের নাগরিকের তুলনায় বাংলাদেশিদের ৪ থেকে ৫ গুণ অর্থ খরচ করতে হয় বিদেশে যেতে।’

সংশ্লিষ্টরা জানান, শুধু বাংলাদেশেই নয়, বিদেশেও বড় ধরনের ফাঁদ পেতে রেখেছে দালাল চক্র। সম্প্রতি ট্যুরিস্ট ভিসায় দুবাই গিয়ে কাজের সুযোগ থাকায় দালালদের দৌরাত্ম্য বেড়েছে কয়েক গুণ। লিখিত কোনো অনুমোদন না থাকলেও দুবাই কর্তৃপক্ষ ভিজিট ভিসায় বাংলাদেশ থেকে কর্মী নিচ্ছেন। এর মধ্যে জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর বহির্গমন ছাড়পত্র নিয়ে যাওয়ার পাশাপাশি ভিজিট ভিসায় বিমানবন্দর দিয়ে বডি কন্টাক্টেও অনেকে দুবাই যাচ্ছেন। দালালদের দৌরাত্ম্যের এ বডি কন্টাক্টে যাওয়াদের তেমন কোনো রেকর্ডই থাকছে না। তাদের না আছে কোনো বিএমইটি ক্লিয়ারেন্স, না আছে দুবাইর কোনো কোম্পানির অনুমতি। তারা পাচারের শিকার কি না তা-ও বোঝা যাচ্ছে না। আবার সৌদি আরবের ফ্রি ভিসার নামে ভিসা বিক্রেতাদের দালালরা প্রতারিত করছেন বিদেশ গমনেচ্ছুদের। ভুয়া কোম্পানির নামে ভিসা দিয়ে কর্মীদের সৌদি পাঠিয়ে তাদের থেকে টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন দুই দেশের দালালরা। জনশক্তি খাতের এ অনিয়ম অজানা না হলেও বন্ধে কোনো উদ্যোগ নেই। অবশ্য জানলেও অনেক সময় দালালদের কাছে অসহায় হয়ে পড়ছেন কর্মকর্তারা।

কূটনৈতিক সূত্রের খবর, সর্বশেষ দালাল ধরতে গিয়ে বিপাকে পড়েছেন ব্রুনাইয়ের বাংলাদেশ হাইকমিশনের কর্মকর্তারা। দালাল হিসেবে চিহ্নিত ফেরত পাঠানোদের অভিযোগের কারণে এখন দুদকের তদন্তের মুখে হাইকমিশনের কর্মকর্তারা। আবার ব্রুনাইতে হামলার শিকার হয়েছেন হাইকমিশনের কর্মকর্তা। সে দেশেও করা হয়েছিল মিথ্যা মামলা। সবশেষে এখন দালালরা আবার মাথা চাড়া দিয়ে উঠে ব্রুনাইয়ের শ্রমবাজার ধ্বংসের পাঁয়তারা চালাচ্ছেন।

জানা যায়, ব্যক্তি খাতেই দেশ থেকে বিভিন্ন কাজে বিদেশে যান অধিকাংশ কর্মী। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে যান বাকিরা। তবে দালালরা অভিবাসনের পুরো প্রক্রিয়ায় ধাপে ধাপে কাজ করেন। দালালদের সহায়তা ছাড়া এগোতে পারেন না বিদেশ গমনেচ্ছুরা। পাসপোর্ট করা থেকে শুরু করে পুলিশ ক্লিয়ারেন্সের সময়ও দালালদের অতিরিক্ত অর্থ দিতে হচ্ছে। এ ছাড়া টাকা লেনদেনের ক্ষেত্রেও তেমন কোনো প্রমাণাদি থাকে না। ফলে দালালদের কারণে অনেক পরিবারকে পথে বসতে হয়েছে। অনেকে দালালের প্রলোভনে জমিজমা বিক্রি করে টাকাপয়সা তুলে দিলেও যেতে পারেননি বিদেশ। দালালদের প্রতারণার শিকারে পরিণত হন নারীরাও। নারী কর্মীদের সরলতার সুযোগ নিয়ে দালালরা নানা কৌশলে অতিরিক্ত টাকা হাতিয়ে নেন। বিদেশে গিয়ে হতে হয় নির্যাতিত। বেসরকারি গবেষণা সংস্থা রামরুর গবেষণা বলছে, ১৯ শতাংশ লোক টাকা দিয়েও বিদেশে যেতে পারছেন না। এতে তাঁদের গড়ে আর্থিক ক্ষতি হয় প্রায় ২ লাখ টাকা। ৩২ শতাংশ অভিবাসী বিদেশে গিয়ে চাকরি না পাওয়াসহ নানা হয়রানির মুখে পড়ছেন। আর বাকি ৪৯ শতাংশ চাকরি পাচ্ছেন না। এগুলোর পেছনে রয়েছে দালালের হাত। অভিবাসন বিশেষজ্ঞ আসিফ মুনীরের মতে, দালালদের হয় বৈধ করতে হবে নয় তো থামাতে হবে। দালাল দূর করা সম্ভব নয়। অভিবাসনের প্রতিটি ধাপে দালালের সহায়তা লাগে। তাই তাঁদের নিবন্ধনের ব্যবস্থা করে প্রতিটি কাজের জন্য দালালদের ফি নির্ধারণ করে দেওয়া যেতে পারে। এ ছাড়া নতুন বাজারের চাহিদা বিচার করে দক্ষ কর্মী গড়তে হবে। দূতাবাসগুলোয় অভিবাসনে অভিজ্ঞ জনবল দিতে হবে।

সরকারের কর্মকর্তারা বলছেন, সরকার দালালদের দৌরাত্ম্য বন্ধ করে একটি শৃঙ্খলা আনতে চায়। দালাল ঠেকাতে বেসরকারি রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোকে জেলা পর্যায়ে কার্যালয় খুলতে বলা হয়েছে। বেআইনি পথে বিদেশ যাওয়া ঠেকাতে মন্ত্রণালয় জনসাধারণের মধ্যে সচেতনতা কর্মশালা চালাচ্ছে। বিশেষ টাস্কফোর্স এজেন্সিগুলোর কার্যক্রম তদারকি করছে। ভ্রাম্যমাণ আদালতের সংখ্যাও বাড়ানো হচ্ছে। তবে জনশক্তি খাতবিষয়ক বিশ্লেষকরা বলছেন, বৈদেশিক কর্মসংস্থান ও অভিবাসী আইন, ২০১৩ প্রণয়ন করা হলেও দালালদের তৎপরতা বন্ধ হয়নি। দালালরা আগের মতোই সক্রিয়। একইভাবে রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোর জবাবদিহিও সেভাবে নিশ্চিত হয়নি।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর