শিরোনাম
শুক্রবার, ৩ ডিসেম্বর, ২০২১ ০০:০০ টা

ঘরে বাইরে চাপে সরকার

নিজস্ব প্রতিবেদক

ঘরে বাইরে চাপে সরকার

ঘরে বাইরে চাপে পড়েছে সরকার। জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধিকে কেন্দ্র করে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, পরিবহন ভাড়া বৃদ্ধি এবং এ ঘটনা ঘিরে ছাত্রদের মাঠে নামা সরকারের জন্য বিব্রতকর পরিস্থিতি তৈরি করেছে। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) নির্বাচনে সারা দেশে হানাহানি ও সংঘাত।

ইউপি নির্বাচনে এ পর্যন্ত ৭৪ জন নিহত হয়েছেন। এর অধিকাংশ সরকারি দলের। অভ্যন্তরীণ বিদ্রোহ ঘিরেই এ পরিস্থিতির সৃষ্টি। অন্যদিকে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে বিদেশ পাঠানো নিয়ে সরকার কিছুটা চাপে পড়েছে। বিএনপি দেশ-বিদেশে খালেদা জিয়ার অসুস্থতা ঘিরে সামনে নিয়ে আসছে মানবিকতার বিষয়টি। এর বিপরীতে সরকারি দল যুক্তিসংগত কোনো জবাব দাঁড় করাতে পারেনি। সরকারের এ অবস্থা নিয়ে জানতে চাইলে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক ড. মীজানুর রহমান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘ইউপি নির্বাচন নিয়ে হানাহানি ঘটছেই। দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা তা বন্ধ করতে পারছেন না। ইউপি নির্বাচনে প্রার্থী বাছাইয়ে মনোনয়ন বাণিজ্যের অভিযোগও শোনা যায়। ফলে কারও কারও নৌকা নিয়েও জামানত বাজেয়াপ্ত হয়েছে। আবার কিছু এলাকায় এমপিরা এতই প্রভাবশালী ও দলকে নিয়ন্ত্রণ করছেন যে নৌকা প্রতীক পাওয়ার পরও নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়াতে বাধ্য হচ্ছেন দীর্ঘদিনের ত্যাগী ও পরীক্ষিত নেতারা। এমন পরিস্থিতি সব সময় থাকবে তা কিন্তু ভাবার সুযোগ নেই।’ বাজার পরিস্থিতি নিয়ে তিনি বলেন, ‘জ্বালানি তেলের দাম বাড়লে এর প্রভাব সব জায়গায় পড়ে। এতে নির্দিষ্ট আয়ের মানুষের সমস্যা বেশি। সঠিকভাবে বাজার মনিটরিং করা হয় না। ফলে মানুষের ভোগান্তি বাড়ছে। যে কারণে সরকারের ওপর চাপ পড়ছে।’

ছাত্রদের আন্দোলন প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই অধ্যাপক বলেন, ‘বাসে হাফ ভাড়া নিয়ে ছাত্ররা আন্দোলনে নেমেছে। রাজধানীতে সরকার ও বেসরকারি বাস মালিকরা ভাড়া কম নেওয়ার সিদ্ধান্তও নিয়েছে। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে ঢাকার বাইরে ভাড়া কমানো হয়নি। সরকার ও মালিকপক্ষ একটা ঘোষণা দিলেই এটা সমাধান হয়ে যায়। কিন্তু সে লক্ষণ নেই। সবকিছু প্রধানমন্ত্রীকেই দেখতে হচ্ছে।’ বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার চিকিৎসা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘এটা নিয়ে দুই রাজনৈতিক দলেরই কথার বাহাস দেখছি। প্রকৃত অর্থে খালেদা জিয়ার স্বাস্থ্যের অবস্থা কী? এভারকেয়ার হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ এ বিষয়ে ব্যাখ্যা দিলে ভালো হতো। কারণ এখন খালেদা জিয়ার চিকিৎসা নিয়ে যারা কথা বলছেন তারা কেউ এভারকেয়ার হাসপাতালের চিকিৎসক নন। তারা বিএনপিপন্থি চিকিৎসকদের সংগঠন ড্যাবের নেতা।’

সরকারের ঘরে বাইরে চাপ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান  অধ্যাপক নুরুল আমিন বেপারী বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘ঘরে বাইরে চাপের বিষয়টি সরকার যতই অস্বীকার করুক না কেন ধীরে ধীরে তা কঠিন পর্যায়ে চলে আসবে। এ সরকার প্রকৃতপক্ষে জনগণের রায় নিয়ে আসা নির্বাচিত সরকার নয়। আমরা অতীতে দেখেছি আইয়ুব খান, হুসেইন মুহম্মদ এরশাদসহ অনির্বাচিত সরকার শুরুর দিকে জনগণের ওপর কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করে। কিন্তু ধীরে ধীরে সে নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখা সম্ভব হয়নি। ২০১৪-এর পর ২০১৮ সালে রাতের আঁধারে যে নির্বাচন হলো তাকে কোনোভাবেই বৈধ নির্বাচন বলা যায় না। যেহেতু সরকার জনগণের ভোটে নির্বাচিত হয়নি তাই তারা জনগণের প্রকৃত বার্তা বুঝতে পারে না। কারণ তাদের জনসম্পৃক্ততা নেই। জনসম্পৃক্ততা না থাকায় তারা ভুল সিদ্ধান্ত নেয়।’ তিনি আরও বলেন, ‘ছাত্ররা বর্তমানে হাফ ভাড়ার যে আন্দোলন করছে অভিভাবকরা তা বৈধ আন্দোলন মনে করে সমর্থন দিচ্ছেন। সরকার ছাত্র আন্দোলন প্রশমিত করতে যে সিদ্ধান্ত নিল তা-ও যৌক্তিক হয়নি। তারা বলেছে ঢাকায় স্কুল খোলার দিন হাফ ভাড়া কার্যকর করবে। ঢাকার বাইরে করবে না। এ বার্তা যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে চট্টগ্রাম, সিলেটসহ বিভিন্ন স্থানে আন্দোলন ছড়িয়ে পড়েছে। কিছু ক্ষেত্রে সরকার বিএনপি-জামায়াত বা প্রতিবেশী দেশের ষড়যন্ত্রও বলতে চাইছে। সরকারের দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা যে বক্তব্য দিচ্ছেন সাধারণ মানুষ তা বিশ্বাস করছে না। ভাড়া বৃদ্ধি, দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধিসহ বিভিন্ন বিষয়ে সরকার যে সিদ্ধান্ত নিচ্ছে সেগুলো যৌক্তিক হচ্ছে না।’

অধ্যাপক নুরুল আমিন বেপারী আরও বলেন, ‘খালেদা জিয়াকে যে মামলায় আদালতে দন্ডিত করা হয়েছে সেখানে কোনো দুর্নীতি হয়েছে বলে সাধারণ মানুষ বিশ্বাস করে না। বরং তারা মনে করে দেশ থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা পাচার হয়েছে। সেগুলোর কোনো বিচার হচ্ছে না। সরকার তিনবারের প্রধানমন্ত্রী ও একজন বয়োজ্যেষ্ঠ নাগরিককে বিদেশে চিকিৎসার জন্য পাঠাতে নানা টালবাহানা করছে।’ তিনি বলেন, ‘বিদেশি চিকিৎসকদেরও খালেদা জিয়াকে বাংলাদেশে চিকিৎসা দেওয়া সম্ভব নয়। বিদেশে অর্থাৎ যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য বা জার্মানিতে উন্নত হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে বলেছে। কিন্তু সরকার আইনের দোহাই দিয়ে তা মানছে না। সাধারণ মানুষ বিষয়টি ভালোভাবে নেয়নি।’ জ্বালানি তেলের দাম ও দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘দ্রব্যমূল্য পাগলা ঘোড়ার মতো বাড়ছে। এর আগে কয়েক দফায় বিদ্যুৎ ও গ্যাসের দাম বেড়েছে। জ্বালানি তেলের দাম বাড়ার সঙ্গে দ্রব্যমূল্য লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। জ্বালানি তেলের দাম বাড়ায় দ্রব্যমূল্য যৌক্তিকভাবে যতটুকু বাড়ত তার চাইতে অনেক বেশি বেড়েছে। এ ক্ষেত্রে যারা মধ্যস্বত্বভোগী আছে তারা সরকারের কথা শুনছে না। কারণ তারা প্রায় সবাই সরকারি দলের লোক। অবাধে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি সরকারের ওপর বাড়তি চাপ তৈরি করছে।’

ঘরে বাইরে সরকারে চাপ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক ড. আসিফ নজরুল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘এ সরকার বরাবরই চাপের মধ্যে আছে। কিন্তু সরকারের দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা তা কখনো স্বীকার করতে চান না। সাধারণ মানুষের চাপ ও আন্দোলনকে তারা কখনো কখনো দমন করে, অগ্রাহ্য করে, কখনো আবার তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে। আবার সবকিছুতেই তারা ষড়যন্ত্রের গন্ধ খোঁজে। মূল কথা হচ্ছে দেশে প্রকৃত বিরোধী দল নেই। এ সরকার যেহেতু গণমানুষের প্রকৃত ভোটে ক্ষমতায় আসেনি তাই তারা মানুষের আশা-আকাক্সক্ষা জানতে চায় না। কিন্তু যারা ভুক্তভোগী তাদের মধ্যে ধিকিধিকি করে আগুন জ্বলতেই থাকে। সরকার এসব বার্তা জানতে চায় না। জনগণের প্রতি দায়বদ্ধতা না থাকায় সরকার নিজেদের দায়িত্ববোধ থেকে দূরে সরে আছে। সরকারের উচিত জনগণের প্রকৃত বার্তা জানা। সাধারণ মানুষ কী চায় তা উপলব্ধি করা এবং মানুষের সমস্যাগুলো সমাধানে যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়া।’

ঘরে বাইরে সরকার কী ধরনের চাপে আছে জানতে চাইলে জাতীয় পার্টির (জাপা) মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘ইউপি নির্বাচন অবাধ ও নিরপেক্ষ করতে নির্বাচন কমিশন পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সামনে অস্ত্রের মহড়া দেখে সাধারণ মানুষ ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়ছে। প্রতিদিনই খুনোখুনি হচ্ছে। এ থেকে সরকার বড় ধরনের চাপে পড়ছে। সরকার ও নির্বাচন কমিশনকে আগামী নির্বাচনগুলো যাতে অবাধ, নিরপেক্ষ ও উৎসবমুখর হয় সেজন্য কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে।’

জাপা মহাসচিব আরও বলেন, ‘আমরা বিরোধী দল হিসেবে সরকারকে চাপে রাখার জন্য সংসদে কথা বলছি। বাইরে সভা-সমাবেশে সরকারের কঠোর সমালোচনা করছি। সরকারের নানা অনিয়মের বিরুদ্ধে সোচ্চার আছি। আমাদের দল জনগণের স্বার্থে সরকারকে আরও বেশি চাপে রাখার জন্য রাজপথে কঠোর কর্মসূচি দিচ্ছে এবং আরও দেব।’ তিনি আরও বলেন, ‘দ্রব্যমূল্য, জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধি, স্থানীয় সরকার নির্বাচনে অনিয়ম, পরিবহনে অরাজকতাসহ প্রতিটি বিষয়ে আমরা গঠনমূলক সমালোচনা করছি। কিন্তু এতে সরকারের টনক নড়ছে না। মনে হয় সরকারের কোনো কিছুতেই নিয়ন্ত্রণ নেই।’

শিক্ষার্থীদের আন্দোলন যৌক্তিক উল্লেখ করে চুন্নু বলেন, ‘ছাত্রদের হাফ ভাড়ার দাবি মানার ক্ষেত্রে কোনো শর্ত গ্রহণযোগ্য নয়। সড়কে নৈরাজ্য বন্ধ করতে হবে। এ সরকার জনগণের পক্ষে কাজ করছে না। কাজের মাধ্যমে সরকারকেই প্রমাণ দিতে হবে যে তারা জনবান্ধব ও জনগণের সরকার।’

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর