আন্দোলনে অনড় সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (শাবি) শিক্ষার্থীরা। অনশনরত ২৪ শিক্ষার্থীর মধ্যে ১২ জন অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। তাদের সিলেটের তিনটি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। অন্যদিকে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলতে তাদের একটি প্রতিনিধি দলকে ঢাকায় আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি। প্রথমে সেই আমন্ত্রণ গ্রহণ করেছিলেন শিক্ষার্থীরা। কিন্তু পরে মত পাল্টে ঢাকায় না যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন তারা। করোনাভাইরাসের সংক্রমণ দ্রুত বাড়তে থাকায় ৬ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করে একটি প্রজ্ঞাপন জারি করেছে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ। তবে গতকাল দুপুরে সংবাদ সম্মেলনে শাবি শিক্ষার্থীরা এই বন্ধের মধ্যেও উপাচার্য অধ্যাপক ফরিদ উদ্দিন আহমেদের পদত্যাগের দাবিতে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেন। আন্দোলনকারীদের মুখপাত্র ইয়াসির সরকার বলেন, ‘স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে ঘোষণা এসেছে, ৬ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত স্কুল-কলেজ বন্ধ থাকবে এবং বিশ্ববিদ্যালয়গুলো অনুরূপ ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। আমাদের উপাচার্য ১৬ জানুয়ারি শিক্ষার্থীদের ওপর প্রশাসনিক হামলার পর শাবি বন্ধের ঘোষণা দেন। হলগুলোও বন্ধ। ১৬ জানুয়ারির পর থেকেই আমাদের ক্যাম্পাস বন্ধ হয়ে গেছে এবং নতুন করে বন্ধ হওয়ার কিছু নেই।’ তিনি বলেন, ‘কার্যত বন্ধ ক্যাম্পাসেই শিক্ষার্থীরা আন্দোলন করে আসছে। বোমাবাজ উপাচার্য অপসারণ করে একটি সুন্দর শিক্ষাজীবন উন্মোচনের লক্ষ্যে আমাদের আন্দোলন চলছে এবং যতক্ষণ পর্যন্ত এই উপাচার্যের পতন না হচ্ছে ততক্ষণ পর্যন্ত আন্দোলন চালিয়ে যাব।’ আন্দোলনরতরা জানান, অনশনরত ২৪ শিক্ষার্থীর মধ্যে ১২ জন অসুস্থ হয়ে পড়ায় তাদের সিলেটের তিনটি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। এ ছাড়া অনশনরত বাকিদের স্যালাইন প্রদান করা হয়েছে। এদিকে গতকাল দুপুরে শাবি ছাত্রলীগের সাবেক কয়েকজন নেতা-কর্মী ক্যাম্পাসে গিয়ে আন্দোলনকারীদের সঙ্গে একাত্মতা পোষণ করেন। এ সময় সাবেক ছাত্রলীগ নেতা মকাদ্দুস আলী, মাসুম বিল্লাহ চৌধুরী, মলয় সরকার, আবু সায়েম, সৌমিত্র সিংহ দাশ, প্রদীপ চন্দ্র দাশ, আবদুর রশিদ রাশেদ, জ্যোতিলাল দাস, নবকুমার রায়, বিজিত লাল দাস, সাইফুল আলম রিজভী, সুপ্রাজিৎ চৌধুরী প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন। আন্দোলনে সমর্থন জানিয়ে গতকাল সন্ধ্যার পর ক্যাম্পাসে শাবির বর্তমান ও সাবেক শিক্ষার্থীদের একটি মিছিল অনুষ্ঠিত হয়। এদিকে শিক্ষামন্ত্রী আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলতে তাদের একটি প্রতিনিধি দলকে ঢাকায় আমন্ত্রণ জানানোর প্রেক্ষিতে শিক্ষার্থীরা বলেছেন- শিক্ষামন্ত্রীকে সিলেটে এসে তাদের সঙ্গে কথা বলতে হবে অথবা ভার্চুয়াল মাধ্যমে বৈঠক করতে হবে। সরেজমিন জানা যায়, গতকাল দুপুর দেড়টার দিকে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক শফিউল আলম নাদেলের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধি দল শাবি ক্যাম্পাসে যায়। প্রতিনিধি দলে ছিলেন জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি আশফাক আহমদও। প্রতিনিধি দলটি শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে। তারা জানান, উপাচার্য শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলতে চান। এ সময় শিক্ষার্থীরা বলেন, ‘উপাচার্যকে ক্ষমা চেয়ে সসম্মানে পদত্যাগ করতে হবে। উপাচার্য পদত্যাগ না করলে আমরা আন্দোলন থেকে সরব না। উপাচার্যকে বাইরে যেতে হলে আমাদের লাশের ওপর দিয়ে যেতে হবে।’ পরে উপাচার্য অধ্যাপক ফরিদ উদ্দিন আহমেদের সঙ্গে দেখা করতে তার বাসভবনে যায় প্রতিনিধি দল। সেখান থেকে বেরিয়ে বিকাল ৩টার দিকে আওয়ামী লীগ নেতা শফিউল আলম নাদেল মোবাইল ফোনে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলিয়ে দেন শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনিকে। এ সময় শিক্ষামন্ত্রী আন্দোলনরতদের সঙ্গে কথা বলতে তাদের একটি প্রতিনিধি দলকে ঢাকায় আমন্ত্রণ জানান। শিক্ষামন্ত্রী বলেন, ‘আমরা আপনাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান পরিস্থিতি এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের সব বিষয় নিয়ে কথা বলতে চাই। আপনারা আপনাদের মধ্যে কথা বলে ঠিক করেন যে কারা আসবেন। আপনাদের যারাই আসবেন আমি তাদের সঙ্গেই কথা বলব।’ দীপু মনি বলেন, ‘আমি চাই না যে আমাদের ছেলে-মেয়েরা কষ্ট পাক। আপনারা যদি আজকে (গতকাল) সন্ধ্যায়ই আসতে পারেন, তাহলে আজকেই আমি আপনাদের সময় দেব। আমি চাই দ্রুত এই সমস্যার সমাধান হোক।’ তখন শিক্ষার্থীরা ঢাকায় যাওয়ার আমন্ত্রণ গ্রহণ করেন। তারা নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে প্রতিনিধি দলে কারা থাকবেন, সেটা ঠিক করে জানানোর সিদ্ধান্ত নেন। পরে শিক্ষার্থীরা নিজেদের মধ্যে আলোচনায় বসেন। সে আলোচনা শেষে সন্ধ্যা সাড়ে ৫টার দিকে শিক্ষার্থীরা জানান, তারা আলোচনার জন্য ঢাকায় যেতে চান না। আলোচনা করতে চাইলে শিক্ষামন্ত্রীকে সিলেটে আসতে হবে অথবা ভার্চুয়াল মাধ্যমে কথা বলতে হবে। শিক্ষার্থীরা তাদের এ সিদ্ধান্ত আওয়ামী লীগ নেতা শফিউল আলম নাদেলকে জানিয়ে দেন। এরপর সন্ধ্যায় ফের ক্যাম্পাসে যান নাদেল। তিনি শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলার পর সন্ধ্যা ৭টার দিকে সাংবাদিকদের সামনে আনুষ্ঠানিক বক্তব্য দেন। নাদেল বলেন, ‘মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী শিক্ষার্থীদের সঙ্গে ফোনে কথা বলে তাদের ঢাকায় আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা সবার সামনে জানিয়েছিলেন, তারা একটি প্রতিনিধি দল নিয়ে ঢাকায় যাবেন। কিন্তু পরে তারা আমাকে ফোন করে জানান, তারা ভার্চুয়ালি কথা বলতে চান, তাদের পক্ষে ঢাকায় যাওয়া সম্ভব নয়। যারা অনশনে আছেন, তারা এই আলোচনায় অংশ নিতে চান। এই কারণে ঢাকায় যাওয়া সম্ভব নয়।’ তিনি বলেন, ‘আমি এই বিষয়টি শিক্ষামন্ত্রীকে জানাই। তিনি আমাকে আরেকবার ক্যাম্পাসে গিয়ে শিক্ষার্থীদের অনুরোধ করতে বলেন। শিক্ষামন্ত্রী প্রস্তাব দেন, অনশনকারীরা ভার্চুয়াল মাধ্যমে কথা বলতে পারেন এবং একটি প্রতিনিধি দল শনিবার (আজ) ঢাকায় গিয়ে আলোচনা করতে পারেন।’ নাদেল জানান, শিক্ষামন্ত্রীর পরিবারের একজন অসুস্থ। যে কারণে তাঁর পক্ষে সিলেটে আসতে দু-একদিন সময় লাগতে পারে। এতে শিক্ষার্থীদের বিড়ম্বনা বাড়বে। এক প্রশ্নের জবাবে আওয়ামী লীগ নেতা নাদেল বলেন, ‘শিক্ষামন্ত্রী বিমানযোগে প্রতিনিধি দলকে ঢাকায় নেওয়ার ব্যবস্থা করতে চেয়েছেন। শিক্ষার্থীদের প্রাথমিক যেসব দাবি ছিল, তা যুক্তিসংগত। পরবর্তীতে হয়তো বাইরের কেউ যুক্ত হয়েছে। অনেকেই আশঙ্কা করছেন, এই আন্দোলনকে কেউ হয়তো অন্যদিকে নিয়ে যেতে চায়। তবে আমি বিশ্বাস করতে চাই, সে রকম কিছু নয়।’ এরপর সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার দিকে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলেন। সেখানে অনশনকারী শাহরিয়ার আবেদিন বলেন, ‘শিক্ষামন্ত্রী আমাদের আলোচনার জন্য ঢাকায় যেতে প্রস্তাব দিয়েছেন। আমরা তাঁর প্রস্তাবকে স্বাগত জানাই। কিন্তু আমরা যারা অনশনকারী ও আন্দোলনকারী আছি, আমরা মনে করছি, আমাদেরকে ফেলে প্রতিনিধি দলকে ঢাকায় যাওয়া সম্ভব না। মাননীয় মন্ত্রীর কাছে আমাদের প্রস্তাব ছিল, কাজের ব্যস্ততার ফাঁকে যদি সম্ভব হয়, তবে এখানে এসে আমাদের সঙ্গে আলাপ করে যেতে পারেন। অথবা শিক্ষামন্ত্রীর সঙ্গে আমাদের মিটিং যদি অনলাইনে হয়, সে ক্ষেত্রেও আমরা কথা বলতে রাজি আছি।’ হয় শিক্ষামন্ত্রীকে সিলেটে এসে কথা বলতে হবে, অথবা ভার্চুয়াল মাধ্যমে বৈঠক করতে হবে বলে জানিয়ে দেন তিনি। এদিকে, চলমান পরিস্থিতি নিয়ে শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনির সঙ্গে বৈঠক করতে ঢাকা এসেছেন পাঁচ শিক্ষকের একটি প্রতিনিধি দল। শুক্রবার রাতে শিক্ষক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক ড তুলসী কুমার দাশ এ তথ্য নিশ্চিত করেন।
ঢাবিতে শাহজালালের সাবেক শিক্ষার্থীদের সমাবেশ সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ফরিদ উদ্দিন আহমেদের পদত্যাগ দাবিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সন্ত্রাসবিরোধী রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশে সমাবেশ করেছেন ঢাকায় অবস্থানরত শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থীরা। গতকাল সন্ধ্যায় এ সমাবেশ করেন তারা।
এ সময় আন্দোলনরতরা ভিসির পদত্যাগের দাবিতে নানা ধরনের স্লোগান দেন। উপাচার্য অধ্যাপক ফরিদ উদ্দিন আহমেদকে অপসারণে রাষ্ট্রপতি ও বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য অ্যাডভোকেট আবদুল হামিদের হস্তক্ষেপ কামনা করেন আন্দোলনকারীরা। শাবিপ্রবির ২০০৩-০৪ সেশনের সমাজকর্ম বিভাগের শিক্ষার্থী মোহাম্মদ জামশেদুল আলম বলেন, ৫২ ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে আমাদের জুনিয়ররা অনশনরত। তাদের মধ্যে অনেকে অসুস্থ। কিন্তু উপাচার্য এখনো পদত্যাগ করেননি। তিনি ফরিদ উদ্দিনকে অপসারণ করে একজন যোগ্য উপাচার্য দিয়ে শাবিপ্রবিকে রক্ষা করার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য অ্যাডভোকেট আবদুল হামিদের হস্তক্ষেপ কামনা করেন।