উচ্চ মূল্যস্ফীতির চাপ থেকে সাধারণ মানুষকে রেহাই দিতে সরকার যে ভর্তুকিনির্ভর বাজেট করছে তার ব্যয় সামাল দিতে এবার রাজস্ব আয়ের বড় টার্গেট করা হয়েছে আমদানি-রপ্তানি খাত। এরই মধ্যে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) ২০২২-২৩ অর্থবছরের রাজস্ব আয়ের যে লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে তাতে শুধু আমদানি-রপ্তানি খাত থেকে শুল্ক ধরা হয়েছে ১ লাখ ১১ হাজার কোটি টাকা। আগামী অর্থবছরের শুল্ক-করের এ টার্গেট সম্পর্কে এরই মধ্যে সরকারের সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোকে অবহিত করা হয়েছে। এনবিআর বলেছে, রাজস্ব আদায়ের সম্ভাবনা, চ্যালেঞ্জ ও যৌক্তিকতা বিবেচনায় খাতভিত্তিক এ টার্গেট নির্ধারণ করা হয়েছে।
তবে আমদানি-রপ্তানি খাতে অতিরিক্ত করভার নিয়ে দুশ্চিন্তা রয়েছে উদ্যোক্তাদের মধ্যে। শিল্পোদ্যোক্তারা আশঙ্কা করছেন, শুধু রাজস্ব আয় বাড়ানোর জন্য আমদানি-রপ্তানি থেকে শুল্ক আদায়ের বেশি টার্গেট নির্ধারণ করা হলে এটি দেশি শিল্পে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। সরকারকে এমনভাবে শুল্ক-কর নির্ধারণ করতে হবে যাতে দেশি শিল্প সুরক্ষা পায়, আবার রাজস্বও বাড়ে।
রাজস্ব আয়ের টার্গেট : এনবিআর-সূত্র থেকে জানা গেছে, নতুন অর্থবছরের জন্য মোট রাজস্ব আয়ের লক্ষ্য ধরা হতে পারে প্রায় ৪ লাখ ৩৩ হাজার কোটি টাকা, যা চলতি অর্থবছরের মূল লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় প্রায় ১১ শতাংশ বেশি। এর মধ্যে এনবিআর নিয়ন্ত্রিত কর আদায়ের লক্ষ্য থাকছে ৩ লাখ ৭০ হাজার কোটি টাকা। এনবিআর করের মধ্যে আমদানি-রপ্তানি খাত থেকে আয় ধরা হচ্ছে ১ লাখ ১১ হাজার কোটি টাকা, স্থানীয় পর্যায়ে মূসক থেকে আয় ধরা হচ্ছে ১ লাখ ৩৬ হাজার ৯০০ কোটি টাকা এবং আয়কর ও ভ্রমণ কর থেকে রাজস্ব আয়ের টার্গেট ধরা হচ্ছে ১ লাখ ২২ হাজার ১০০ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরে মোট ৩ লাখ ৮৯ হাজার কোটি টাকার রাজস্ব আয়ের টার্গেট ধরা হয়েছিল, যার মধ্যে এনবিআর করের পরিমাণ ছিল ৩ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা।
আয়কর, মূল্য সংযোজন কর বা ভ্যাট এবং আমদানি-রপ্তানি শুল্ক- এ তিন উৎস থেকে রাজস্ব আহরণ করে সরকার। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি রাজস্ব আসে ভ্যাট থেকে (৩৯ শতাংশের বেশি)। ৩৫ শতাংশ আসে আয়কর বা প্রত্যক্ষ কর থেকে। বাকি রাজস্ব আসে আমদানি-রপ্তানি শুল্ক থেকে। আগামী অর্থবছরের জন্য এনবিআর তার রাজস্ব আয়ের ৩৭ শতাংশ ভ্যাট থেকে, আয়কর ও ভ্রমণ কর থেকে ৩৩ শতাংশ এবং আমদানি-রপ্তানি খাত থেকে ৩০ শতাংশ আয়ের টার্গেট নির্ধারণ করেছে বলে এনবিআর-সূত্রে জানা গেছে। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানান, চলতি অর্থবছরের ১০ মাসে (জুলাই-এপ্রিল) আমদানি ও রপ্তানি শুল্ক খাত থেকে আয় হয়েছে ৭৩ হাজার ৬০ কোটি, স্থানীয় পর্যায়ে মূসক থেকে ৮৪ হাজার ৮৯৫ কোটি এবং আয়কর ও ভ্রমণ কর খাতে ৬৯ হাজার ৬৮৫ কোটি টাকা। প্রাপ্ত তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ১০ মাসে রাজস্ব আয়ের লক্ষ্য ছিল ২ লাখ ৬০ হাজার কোটি টাকা প্রায়। আদায় হয়েছে ২ লাখ ২৭ ৬৪০ কোটি টাকা প্রায়। অর্থাৎ আলোচ্য সময়ে লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় রাজস্ব আয়ে কিছুটা পিছিয়ে আছে এনবিআর। এ অবস্থায় চলতি অর্থবছরের টার্গেটের চেয়ে এ তিন খাতে আগামী অর্থবছরে বাড়তি আরও প্রায় ৪০ হাজার কোটি টাকার শুল্ক আদায় করতে হবে।
যে কৌশলে বাড়বে আমদানি-রপ্তানি কর : সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানান, করোনা মহামারি কেটে যাওয়ায় দেশের আমদানি-রপ্তানি খাতে যে গতি এসেছে এর ফলে এ দুটি খাত থেকে বর্ধিত রাজস্ব আয়ের সুযোগ তৈরি হয়েছে। এ ছাড়া বৈদেশিক মুদ্রার মজুদ ধরে রাখা এবং ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়ন ঠেকাতে নতুন করে ১৩৫টি পণ্যে যে শুল্কারোপ করা হয়েছে, এসব খাত থেকেও অতিরিক্ত আমদানি শুল্ক আদায় করবে এনবিআর। বাজেটেও নতুন করে কিছু পণ্যে আমদানি কর বাড়ানো হতে পারে। এ ছাড়া রপ্তানি খাত থেকে বাড়তি শুল্ক আদায়ের জন্য রপ্তানি আয়ের উৎসে কর বাড়ানো হতে পারে। বর্তমানে রপ্তানি খাত থেকে উৎসে কর দশমিক ৫০ শতাংশ নেওয়া হচ্ছে। এটি বাড়িয়ে ১ শতাংশ করা হতে পারে। আমদানি-রপ্তানি খাতে করফাঁকি বন্ধ করেও এ খাতে আদায় বাড়ানোর পরিকল্পনা রয়েছে এনবিআরের। বাংলাদেশ চেম্বার অব ইন্ডাস্ট্রিজের (বিসিআই) প্রেসিডেন্ট আনোয়ার-উল আলম চৌধুরী পারভেজ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘করোনার পর যেহেতু আমদানি-রপ্তানি খাতে প্রবৃদ্ধি বেশি হচ্ছে, সে কারণে এ আয়ের ওপর আরোপিত শুল্ক থেকেই বাড়তি শুল্ক পাওয়া যেতে পারে। তবে ডলারের বিপরীতে টাকার মান ধরে রাখার জন্য যদি আমদানি শুল্ক বাড়ানো হয়, এতে শুধু ব্যবসা-বাণিজ্য ও অভ্যন্তরীণ শিল্প ক্ষতিগ্রস্ত হবে তাই নয়, বৈধপথে রেমিট্যান্স আসার পরিমাণ কমে যাবে।’ এ ছাড়া আমদানি শুল্ক বাড়ানো হলে আন্ডার ইনভয়েসিং বেড়ে যেতে পারে বলে আশঙ্কা করেন তৈরি পোশাক খাতের এই শিল্পোদ্যোক্তা।
বিজিএমইএর সাবেক এই সভাপতি বলেন, ‘রপ্তানি খাত থেকে ট্যাক্স বাড়ানোর জন্য উৎসে করহার বৃদ্ধি পেলে সেটাও তৈরি পোশাক খাতে কিছুটা চাপ তৈরি করবে। কারণ ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে এখন গ্লোবাল মার্কেটে উচ্চ মূল্যস্ফীতি বিরাজ করছে। এ অবস্থায় উন্নত দেশগুলোয় পোশাকের চাহিদা কিছুটা কম পরিলক্ষিত হচ্ছে। রপ্তানি খাত ক্ষতিগ্রস্ত হলে দেশি শিল্পে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে, যা কর্মসংস্থানে বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে। এ অবস্থায় এনবিআরের করকৌশল এমনভাবে সাজানো উচিত যাতে রাজস্ব আয় বাড়ে, দেশি শিল্পও সুরক্ষা পায়।’