শুক্রবার, ২২ জুলাই, ২০২২ ০০:০০ টা

শিক্ষিতরা কেন বেশি আত্মহননে

বিষণ্নতা, ভবিষ্যৎ নিয়ে অনিশ্চয়তা, সম্পর্কে ব্যর্থতা, অর্থনৈতিক ও পারিবারিক চাপসহ নানা কারণ

জিন্নাতুন নূর

মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা বেড়ে যাওয়ায় অতীতের যে কোনো সময়ের তুলনায় দেশের শিক্ষিত মানুষের এখন আত্মহত্যার হার সবচেয়ে বেশি। প্রতি বছর বাংলাদেশে গড়ে ১০ হাজারের বেশি মানুষ আত্মহত্যা করছে। গত বছর মহামারিতেই ১৪ হাজার মানুষ আত্মহত্যা করে। এর উল্লেখযোগ্যসংখ্যক তরুণ ও বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী। গবেষণা বলছে, শিক্ষিত বিভিন্ন পেশাজীবী মানুষও আগের তুলনায় বেশি আত্মহত্যায় ঝুঁকছে। পারিবারিক কলহের জেরে স্বামী-স্ত্রী, ঋণগ্রস্ত ব্যবসায়ীরা আত্মহত্যা করছে। সম্প্রতি লাইভে এসে বেশ কয়েকজন শিক্ষিত মানুষের আত্মহত্যার ঘটনা ভাইরাল হওয়ায় মনোরোগ বিশেষজ্ঞরাও উদ্বেগ প্রকাশ করছেন।

করোনা-পরবর্তী পৃথিবীতে শিশু থেকে বয়স্কসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ আগের চেয়ে বেশি মানসিক রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। এদের কেউ চিকিৎসা নিচ্ছে তো কেউ বিষয়টিকে গুরুত্ব দিচ্ছে না। ফলে মানসিক বিষাদগ্রস্ত হয়ে এ রোগীরা একপর্যায়ে আত্মহত্যায় প্ররোচিত হচ্ছে। সরকারি হিসাব বলছে, পাবনা মানসিক হাসপাতাল ও ঢাকার জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের বহির্বিভাগে মহামারি শুরুর আগে যে-সংখ্যক রোগী ভর্তি হতো তার চেয়ে এখন মাসে গড়ে প্রায় ১ হাজার বেশি রোগী চিকিৎসা নিতে আসছে। মনোচিকিৎসকদের মতে, মহামারিতে চাকরি হারানো, জীবিকা ও ব্যবসায় ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া, প্রিয়জনের মৃত্যু, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় সব বয়সী মানুষই মানসিকভাবে আগের চেয়ে বিপর্যস্ত। বাংলাদেশে করোনা সংক্রমণ শুরুর পর এক জরিপে দেখা যায়, ২০১৯ থেকে ২০২০-এ এসে আত্মহত্যার ঘটনা ৪০ শতাংশ বেড়েছে। এটা খুবই উদ্বেগজনক। এতে দেখা যায়, আত্মহত্যার অন্যতম কারণ বিষণ্নতা। করোনার সময় যে পরিমাণ মানুষ এ ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছে তার চেয়ে বেশি পরিমাণ মানুষ আত্মহত্যা করেছে। আত্মহত্যা নিয়ে বাংলাদেশে যে গবেষণাগুলো প্রকাশিত হয়েছে দেখা যায় এর বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই পারিবারিক চাপে মানুষ আত্মহত্যা করছে। ক্ষোভের বা লজ্জার প্রকাশ হিসেবে অনেক মেয়ে শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করছে।

মহামারিকালে ২০২১ সালে সারা দেশে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ১০১ জন শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছেন। মহামারির মধ্যে সামাজিক, আর্থিক ও পারিবারিক চাপ বেড়ে যাওয়ায় হতাশা থেকে মানুষ আত্মহত্যা করছে বলে গবেষকরা মনে করছেন। সামাজিক ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন আঁচল ফাউন্ডেশনের ‘বিশ্ববিদ্যালয়ে বেড়েছে আত্মহত্যা : হতাশায় নিমজ্জিত শিক্ষার্থীরা’ শীর্ষক সমীক্ষার তথ্য প্রকাশ করে। এ সমীক্ষা থেকে জানা যায়, আত্মহত্যাকারী শিক্ষার্থীর ৬৫ জন পুরুষ, ৩৬ জন নারী। এক বছরে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীর আত্মহত্যার ঘটনা এবারই বেশি বলেও জানানো হয়। আত্মহননকারীদের বয়সভিত্তিক তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, ২২-২৫ বছর বয়সীর মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা তুলনামূলক বেশি। ধারণা করা যায়, এ শিক্ষার্থীদের ক্যারিয়ারকেন্দ্রিক সামাজিক চাপ বেশি থাকে এবং ভবিষ্যৎ অনিশ্চয়তার কারণে তাদের মধ্যে হতাশার ছাপ বেশি দেখা যায়। সমীক্ষা অনুযায়ী, সম্পর্কগত কারণে আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছেন ২৪.৭৫ শতাংশ শিক্ষার্থী এবং পারিবারিক সমস্যার কারণে এ পথে ধাবিত হয়েছেন ১৯.৮০ শতাংশ শিক্ষার্থী। অন্যদিকে মানসিক যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেতে ১৫.৮৪ শতাংশ শিক্ষার্থী বেছে নিয়েছেন আত্মহননের পথ। প্রতিবেদনে বলা হয়, পড়াশোনাসংক্রান্ত কারণে আত্মহত্যা করেছেন ১০.৮৯ শতাংশ শিক্ষার্থী এবং আর্থিক সমস্যাকবলিত হয়ে আত্মহত্যা করতে বাধ্য হয়েছেন ৪.৯৫ শতাংশ শিক্ষার্থী।

আঁচল ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা ও সভাপতি তানসেন রোজ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘শিক্ষার্থীর মধ্যে ৮৪ দশমিক ৬ শতাংশই বিষণ্নতায় ভুগছেন। এটা আমাদের জন্য অশনিসংকেত। একজন শিক্ষার্থী যখন বিষণ্নতায় ভোগেন তখন তিনি কোনো কিছুতেই মনোযোগ দিতে পারেন না। বিষণ্নতা হচ্ছে আত্মহত্যার প্রাথমিক ধাপ। বিষণ্নতায় আক্রান্ত শিক্ষার্থীর বড় একটি অংশ পরবর্তীতে আত্মহত্যা করেন। আগে শিক্ষার্থীরা এত বেশি বিষণ্নতায় আক্রান্ত হতো না, কিন্তু এখন হচ্ছে। এটি উদ্বেগজনক। এ সমস্যা উত্তরণে একপক্ষীয় কোনো সমাধান নেই। যে বিষয়গুলো আমাদের মানসিক সমস্যা বৃদ্ধি করে ব্যক্তিগত উদ্যোগে সেসব বিষয় থেকে আমাদের দূরে থাকতে হবে।’ মনোরোগ বিশেষজ্ঞরা বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, সামজিক ও সাংস্কৃতিক পরিবর্তনে এখন মানুষের মধ্যে বিচ্ছিন্নতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। মানুষ আত্মকেন্দ্রিক হয়ে উঠছে। তাই আত্মহত্যার ঝুঁকিও বাড়ছে। মানুষ যখনই বেশি আত্মকেন্দ্রিক হয়ে ওঠে এবং অন্য মানুষের সঙ্গে তার বন্ধন কমতে থাকে তখন তার পক্ষে আত্মহত্যা করা অনেক সহজ। আমাদের এখন এক ধরনের সামাজিক-সাংস্কৃতিক পরিবর্তন হচ্ছে। আর এ অবস্থার মধ্যে আমাদের তরুণ প্রজন্ম যে বড় হয়ে উঠছে সেখানে এক ধরনের সমস্যা হচ্ছে। বিশেষ করে যে কিশোর ও তরুণরা একক পরিবারে বড় হয়ে উঠছে কিংবা পারিবারিক বন্ধন আগের তুলনায় শিথিল হয়ে পড়ায় সমস্যা বাড়ছে। আবার দিন যত যাচ্ছে মানুষের মধ্যে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য বৃদ্ধি পাচ্ছে। লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, আগে সন্তানের ওপর অভিভাবকের যে নিয়ন্ত্রণ ছিল তা এখন কমে এসেছে। আর এ পরিবেশে শিশু-কিশোরদের যে ব্যক্তিত্ব গঠিত হচ্ছে এতে তাদের মানসিক চাপ সহ্য করার যে ক্ষমতা তা কমে যাচ্ছে। এটি আত্মহত্যা করার একটি কারণ হতে পারে। শিক্ষিত মানুষের মধ্যে যারা বিচ্ছিন্ন এবং বিয়ে করেনি তাদের মধ্যে আত্মহত্যা করার হার বেশি। সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের নিউরোডেভেলপমেন্টাল প্রতিবন্ধী সুরক্ষা ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারপারসন ও ন্যাশনাল ফাউন্ডেশন অব মেন্টাল হেলথের প্রেসিডেন্ট অধ্যাপক মো. গোলাম রাব্বানী বলেন, ‘এনজাইটি, ডিপ্রেশন, আবেগীয় বিষয় এবং স্ট্রেস ডিজঅর্ডারের সমস্যাগুলো বর্তমানে বেশি। হঠাৎ করে মহামারি শুরু হওয়ায় মানুষের ওপর মানসিক আঘাত আসে। এর ফলে মানুষের এক ধরনের প্যানিক অ্যাটাক হয়। মানুষের ভিতরে পোস্টমোটিক স্ট্রেস ডিজঅর্ডার হয়। এগুলো হচ্ছে মানুষের আবেগের বিভিন্ন অবস্থা। এ থেকে তাদের আত্মহত্যা করার প্রবণতাও আগের থেকে বৃদ্ধি পেয়েছে।’ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. মাহফুজা খান বলেন, ‘করোনার সময় যাদের চাকরি চলে যায় তাদের অনেকেই কাজ খুঁজে পাননি। এতে শিক্ষিত এই যুবক-যুবতীদের মধ্যে হতাশা তৈরি হয়। আর এ মানসিক চাপ যখন তারা নিতে পারে না তখন আত্মহত্যার মতো ঘটনা ঘটায়। যদিও পরিস্থিতি এখন আগের চেয়ে অনেক ভালো। করোনার প্রকোপও আগের চেয়ে কমেছে। এর পরও সেই মানুষগুলো এখনো স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারেনি। এখানে অর্থনৈতিক কারণেই এ মানসিক চাপ তৈরি হচ্ছে।’ বিশেষজ্ঞরা বলেন, বর্তমানে দেশের প্রেক্ষাপটে সবকিছুতেই জীবন খুব ‘স্ট্রেসফুল’। বিশেষ করে ঢাকায় মানুষের স্বাস্থ্য সমস্যা দেশের অন্যান্য জায়গার চেয়ে বেশি। ঢাকায় রাস্তায় বেরোলেই মানসিক চাপ শুরু হয়। আবার যেসব শিক্ষার্থী পাস করে বেরোচ্ছে বা এখনো আটকে আছে তারা সবাই এক ধরনের অনিশ্চয়তার মধ্যে আছে। তারা সবাই জানে মহামারির কারণে পরিবর্তিত পৃথিবীতে চাকরির ক্ষেত্র কিছুটা কমে এসেছে। আর এ চিন্তায় তরুণ প্রজন্ম এখন খুব মানসিক চাপের মধ্যে আছে। তারা অপেক্ষায় আছে পরিস্থিতি কবে ঠিক হবে। আবার পাস করার পর তারা আদৌ চাকরি পাবে কি না এ দুশ্চিন্তার মধ্যে আছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে যাওয়ায় নতুন করে এই শিক্ষার্থীরা আবার চাকরির জন্য দুশ্চিন্তা করছে। অর্থাৎ এই শিক্ষার্থীরা আগে থেকেই চাপের মধ্যে ছিল এবার নতুন করে আরও মানসিক চাপ এসে যুক্ত হয়েছে। সমাজবিজ্ঞানীদের মতে, আমাদের অভিভাবক, সন্তান ও আত্মীয়স্বজনদের নিয়ে একসঙ্গে বেঁচে থাকতে হবে। অথচ দেশে এখন ‘ফ্ল্যাট সংস্কৃতি’ চলছে। শহরে সবাই যার যার ফ্ল্যাটে থাকে কিন্তু এ সংস্কৃতিতে কেউ তার প্রতিবেশীর খোঁজ নেয় না। এত কাছে থেকেও একজন প্রতিবেশী আরেকজনের খোঁজ নিচ্ছেন না। এটা পাশ্চাত্য সংস্কৃতির একটি অংশ। এত কাছে থেকেও সবাই এত দূরে! অতি আধুনিকতার নামে ক্রমান্বয়ে আমরা কোন দিকে চলেছি তা আসছে দিনগুলোয় আমাদের কাছে বিরাট এক প্রশ্ন। এখন দেশের শহুরে সমাজব্যবস্থায় দেখা যাচ্ছে, ছেলেমেয়েরা দেশের বাইরে কোনো একটি দেশে অবস্থান করছে কিন্তু মা-বাবা দেশে অবস্থান করছেন। কখনো কখনো মা অথবা বাবা দেশে একাই থাকছেন। এ ধরনের পরিবারগুলোকে এখন আমরা নাম দিয়েছি ‘শূন্য বাসা’। শেষ বয়সে এসে যখন মা-বাবাকে এভাবে জীবন কাটাতে হয় তা অনেকটা বিভীষিকাময়। এটি শহুরে জীবনের নতুন একটি ধারা। শহুরে জীবনের বিশাল একটি চ্যালেঞ্জ যে ছেলেমেয়েদের বিদেশে পাঠিয়ে বয়স্ক অভিভাবকরা দেশে একা থেকে যাচ্ছেন। এমনও কেস স্টাডি দেখা যায় যেখানে মা-বাবা তাঁদের সারা জীবনের সব সঞ্চয় তাদের সন্তানের বিদেশে যাওয়ার পেছনে ব্যয় করছেন। এ থেকে শিক্ষণীয় এই যে, যেভাবে আমাদের সন্তান ও অভিভাবকদের বাইরে যাওয়ার নেশায় পেয়ে বসেছে এটা ব্যক্তিজীবনকে ক্ষতবিক্ষত করে তুলছে। আবার সম্প্রতি লাইভে এসে যে আত্মহত্যার ঘটনাগুলো ঘটছে তারও নেতিবাচক প্রভাব শিক্ষিত সমাজের ওপর পড়ছে। এ আত্মহত্যার ঘটনাগুলো বিশ্লেষণ করে দেখা যাচ্ছে, যারা আত্মহত্যা করছে তাদের সবাই শিক্ষিত। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগে অধ্যাপক ড. জিনাত হুদা বলেন, ‘আত্মহত্যা মানুষ তখনই করে যখন সে মনে করে তার আর বাঁচার কোনো জায়গা নেই। একজন যখন দেখে সে একা হয়ে গেছে, জীবনের চাহিদা পূরণ হচ্ছে না এবং তার সংগ্রামের যে ধারাবাহিকতা তা আর সে নিতে পারছে না তখনই আত্মহত্যা করে। আমরা ভীষণ যান্ত্রিক জীবনে চলে যাচ্ছি। মানুষ কোন পরিস্থিতির শিকার হলে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের লাইভে এসে আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত নেয় তা বুঝতে হবে। একজন মানুষের সঙ্গে যখন তার প্রিয় মানুষটির ভালোবাসার সম্পর্ক ক্রমেই ছিন্ন হতে হতে ক্ষীণ হয়ে শেষ পর্যায়ে চলে যায় তখন মানুষটি আত্মহত্যা করে।’ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্লিনিক্যাল সাইকোলজি বিভাগের অধ্যাপক কামাল উদ্দিন আহমেদ চৌধুরী বলেন, ‘যারা মানসিকভাবে অসুস্থ এবং যাদের সেবা দরকার তাদের বাসায় বসে থাকলে হবে না। অনেকেই আছে যারা মানসিক সমস্যা নিয়ে বাসায় বসে আছেন। তাদের জন্য বিভিন্ন অনলাইনভিত্তিক মানসিক স্বাস্থ্যসেবা আছে। তারা যদি সশরীরে এ সেবা নিতে চান তাহলে সরকারি-বেসরকারি ব্যবস্থাও আছে। মানসিক রোগীরা কোথায় গেলে সেবা পাবেন তা জানানোর জন্য সরকারকে উদ্যোগ নিতে হবে। এতে আত্মহত্যা অনেকাংশে কমে যাবে।’

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর