শুক্রবার, ৫ আগস্ট, ২০২২ ০০:০০ টা

চালের দামে সংকটে অর্থনীতি

বাড়িয়ে দিচ্ছে মূল্যস্ফীতি, আমদানি শুল্ক প্রত্যাহারের চিন্তা

রুকনুজ্জামান অঞ্জন

চালের দামে সংকটে অর্থনীতি

চালের উচ্চমূল্য অর্থনীতিতে সংকট সৃষ্টি করেছে। মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাওয়ার পেছনে এই মুহূর্তে চালের দামকেই প্রধান কারণ বলে মনে করছে অর্থবিভাগ। এ থেকে পরিত্রাণের উপায়ও খোঁজা হচ্ছে। এ মুহূর্তে চাল আমদানির ওপর আরোপিত সব ধরনের শুল্ক প্রত্যাহারকেই কৌশল মানছেন তারা। তবে খাদ্য মন্ত্রণালয় বলছে, তারা চাল আমদানিতে শুল্ক প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত নেওয়ার বিষয়ে আরও কিছুটা সময় নিতে চান। অর্থ মন্ত্রণালয় ও খাদ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে। অর্থ বিভাগের এক কর্মকর্তা বলেন, এই মুহূর্তে অর্থনীতিতে মূল্যস্ফীতি এবং ‘চলতি হিসাবের ভারসাম্য’ এই দুটো বিষয়কেই চ্যালেঞ্জ মনে করা হচ্ছে। আর মূল্যস্ফীতি বাড়ার পেছনে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রাখছে চালের দাম। দেশের প্রধান এই খাদ্যপণ্যটির দাম কীভাবে কমানো যায়- সেটিই এখন সরকারের বিবেচ্য বিষয়। চাল আমদানিতে শুল্ক প্রত্যাহারের বিষয়ে খাদ্য মন্ত্রণালয় থেকে এনবিআর-এ সুপারিশ যেতে পারে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে গতকাল সন্ধ্যায় খাদ্য সচিব মো. ইসমাইল হোসেন এনডিসি বাংলাদেশ প্রতিদিনকে জানান, চাল আমদানিতে শূন্য শুল্কের প্রস্তাব দেওয়ার বিষয়ে এখনো তারা সিদ্ধান্ত নেননি। এ ধরনের সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে তারা আমদানি পরিস্থিতি আরও কিছুটা পর্যালোচনা করতে চান। খাদ্য সচিব বলেন, চাল আমদানির যে সুযোগ দেওয়া হয়েছিল, তার প্রকৃত তথ্য পেতে আরও কিছুটা সময় লাগবে। তথ্য পেলে চালের বিষয়ে পরবর্তী করণীয় ঠিক করা হবে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, আগাম বন্যায় আবাদ ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় এবং বোরো মৌসুমেও চালের দাম বেশি থাকায় গত জুনে ৪ লাখ মেট্রিক টন চাল আমদানির অনুমোদন দেয় খাদ্য মন্ত্রণালয়। ২১ জুলাইয়ের মধ্যে চাল আমদানির এলসি এবং ১১ আগস্টের মধ্যে আমদানি করা চাল বাজারজাত করার শর্ত দেওয়া হয়। এ ছাড়া আমদানি বাড়াতে গত ২৫ জুন বিদ্যমান ৬২ দশমিক ৫ শতাংশ শুল্ক কমিয়ে ২৫ শতাংশে নামিয়ে আনা হয়। জানা গেছে, চালের দাম কমাতে প্রায় ৩৭ দশমিক ৫ শতাংশ শুল্ক কমানোর পরও কাক্সিক্ষত আমদানি বাড়েনি। কারণ ডলারের দাম বেড়ে গেছে। এ কারণে ব্যবসায়ীরা এলসি খুলছেন না। সূত্র জানায়, কয়েক মাস আগেও ডলারের দাম ছিল ৮৪ টাকা। সেটি বেড়ে ৯৪ টাকায় উঠে গেছে। আমদানি এলসি খুলতে আরও বেশি মূল্য দিতে হচ্ছে। ফলে শুল্ক কমানোর কারণে ব্যবসায়ীরা চাল আমদানিতে যে সুবিধা পেয়েছিল, ডলারের দাম বাড়ায় সেই সুবিধা নষ্ট হয়ে গেছে। এখন চাল আমদানি করে দেখা গেছে, সেটি দেশের বাজারের প্রায় সমান বা কোনোক্ষেত্রে বেশি হচ্ছে। এ কারণে ব্যবসায়ীরা সুযোগ থাকা সত্ত্বেও চাল আমদানি করছেন না। অর্থ বিভাগের কর্মকর্তারা জানান, চালের দাম কমাতে হলে এ পরিস্থিতিতে চালের ওপর আরোপিত সব ধরনের শুল্ক প্রত্যাহার ছড়া কোনো উপায় নাই। কারণ ডলারের দাম কমানোর বিষয়টি এখন সরকারের হাতে নাই। সরকার যেটি পারে চাল আমদানিতে সব ধরনের শুল্ক প্রত্যাহার করে শূন্য শুল্ক করে দিতে পারে। আর এটি করেই চালের দাম কমানো যেতে পারে।

চালের দাম যেভাবে মূল্যস্ফীতি বাড়ায় : অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রগুলো জানায়, মূল্যস্ফীতির ঝুড়িতে যেসব পণ্য বা সেবা রয়েছে তার মধ্যে তিন ধরনের পণ্য ও সেবা ৭০ ভাগ দখল করে আছে। এগুলো হচ্ছে খাদ্য, বাসস্থান ও পরিবহন। দেশে যেহেতু বেশির ভাগ মানুষের প্রধান খাবার চাল, তাই প্রধান এই খাদ্যমূল্যটির দাম বাড়লে যেমন মূল্যস্ফীতি বাড়ে, তেমনি দাম কমলে মূল্যস্ফীতিও কমে যায়। সূত্র জানায়, গত কয়েক বছর ধরেই মূল্যস্ফীতি ৫ থেকে ৬ শতাংশের মধ্যে থাকছে। বাজেটের আগেও মূল্যস্ফীতি ৬ শতাংশের কাছাকাছি ছিল। গত ২ মাসে এটি বেড়ে প্রায় ৮ শতাংশে উঠে গেছে। পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, খাদ্য পণ্য, মূলত চালের দাম বাড়ার কারণেই মূল্যস্ফীতির এমন ঊর্ধ্বগতি। গত তিন মাসে নাজিরশাইল চালের দাম ৬৫ টাকা থেকে বেড়ে ৮০ টাকায় উঠেছে, আর ৫০ টাকা কেজির সাধারণ মানের চাল ৬০ থেকে ৬৫ টাকায় উঠে গেছে। কেজিপ্রতি চালের দাম ১০ থেকে ১৫ টাকা বৃদ্ধি পাওয়ার বিষয়টি মূল্যস্ফীতি বাড়াতে বড় প্রভাব রেখেছে। সংশ্লিষ্টরা জানান, জুনে চাল আমদানির ঘোষণা দেওয়ায় দাম কিছুটা কমেছিল। এর প্রভাব পড়েছে জুলাইয়ের মূল্যস্ফীতিতে। গত মাসে মূল্যস্ফীতি কিছুটা কমেছে। জুনে খাদ্য মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৮ দশমিক ৩৭ শতাংশ। এটি কমে জুলাইয়ে হয়েছে ৮ দশমিক ১৯ শতাংশ। অপরদিকে জুন মাসে সাধারণ মূল্যস্ফীতি ছিল ৭ দশমিক ৫৬ শতাংশ, এটি জুলাইয়ে ৭ দশমিক ৪৮ শতাংশে নেমে এসেছে। আগামী তিন মাসে মূল্যস্ফীতির মধ্যে সাড়ে ৬ শতাংশে নামিয়ে আনার লক্ষ্য রয়েছে সরকারের। সূত্র জানায়, সামষ্টিক অর্থনীতির সূচকগুলো স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে নিয়ে আসার জন্য বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করা হচ্ছে। এরই মধ্যে অর্থবছরের প্রথম মাসে রেমিট্যান্স ও রপ্তানি খাতে ইতিবাচক প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়েছে। অপরদিকে বিলাসী পণ্যে শুল্ক বৃদ্ধি এবং এলসি মার্জিন বাড়ানোসহ বাংলাদেশ ব্যাংক ও এনবিআর-এর বিভিন্ন উদ্যোগের পর অপ্রয়োজনীয় পণ্য আমদানি কিছুটা কমেছে। এটি অব্যাহত থাকলে বাণিজ্য ঘাটতি কমে আসবে। চলতি হিসাবের ভারসাম্যও স্বাভাবিক হবে। বাকি থাকবে শুধু মূল্যস্ফীতি। আর অর্থনীতির মূল্যস্ফীতিজনিত চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় চাল আমদানি ও সরবরাহ বাড়িয়ে খাদ্যপণ্যের দাম কমানোর দিকেই এখন সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে।

সর্বশেষ খবর