সোমবার, ১৫ আগস্ট, ২০২২ ০০:০০ টা

বিচার মেলেনি ৪৭ বছরে

১৫ আগস্টের আরও তিন হত্যা মামলা

আরাফাত মুন্না

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার দিন সকালে খুনিদের ছোড়া কামানের গোলা গিয়ে পড়ে মোহাম্মদপুরের শেরশাহ সুরী রোডের বস্তিতে। গোলার আঘাতে নিহত হন ১৩ জন। প্রায় এক যুগ আগে অভিযোগ গঠন করা হলেও শেষ হয়নি এ মামলার বিচারকাজ। সেই কালরাতে বঙ্গবন্ধুর ভগ্নিপতি আবদুর রব সেরনিয়াবাত ও ভাগ্নে শেখ ফজলুল হক মণির বাড়িতেও হামলা চালান বিপথগামী সেনারা। হত্যা করা হয় অন্তত আরও ১০ জনকে। দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার হলেও ৪৭ বছরেও বিচার মেলেনি এ ২৩ হত্যাকান্ডের। এর মধ্যে মোহাম্মদপুর বস্তিতে কামানের গোলা-সংক্রান্ত মামলাটির সাক্ষী হাজির না হওয়ায় দীর্ঘদিন বিলম্ব হলেও চলতি বছরই এ মামলা শেষ করার কথা জানিয়েছে রাষ্ট্রপক্ষ। রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী জানিয়েছেন, সেরনিয়াবাত হত্যা মামলার বিচার আটকে আছে হাই কোর্টের স্থগিতাদেশে। আর শেখ মণি হত্যার ঘটনায় ১৮ জনকে আসামি করে মামলা করা হলেও নথি খুঁজে না পাওয়ায় মামলার বিচার আর এগোয়নি। জানতে চাইলে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘এসব মামলার অধিকাংশ আসামিই বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলায় সাজা পেয়েছেন। অনেকের মৃত্যুদন্ড কার্যকর হয়েছে। এখন যারা বাকি আছেন তাদেরও বিচার হবে। মামলাগুলো নিষ্পত্তিতে কেন এত বিলম্ব হচ্ছে, এ বিষয়ে আমি রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীদের সঙ্গে কথা বলব।’

তিনি বলেন, বর্তমান সরকার আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে বিচারহীনতার সংস্কৃতি দূর করতে বদ্ধপরিকর। কেউ যাতে বলতে না পারে বিচার পাইনি। আদালতে মামলা বিচারাধীন, অর্থাৎ এসব হত্যাকান্ডের বিচারও একদিন হবে।

 

মোহাম্মদপুরে কামানের গোলা হামলা মামলা : ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ভোর সাড়ে ৫টার দিকে ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধুর বাড়ি আক্রমণের সময় সেনারা কামানের গোলা ছুড়লে তা গিয়ে পড়ে মোহাম্মদপুরের শেরশাহ সুরী রোডের ৮, ৯, ১৯৬ ও ১৯৭ নম্বর বাড়ির (টিনশেড বস্তি) ওপর। লে. কর্নেল মুহিউদ্দিন আহমেদের (আর্টিলারি) ছোড়া কামানের গোলার বিকট শব্দে প্রকম্পিত হয়ে ওঠে গোটা এলাকা। মুহূর্তেই লন্ডভন্ড হয়ে যায় বস্তিটি। ওই ঘটনায় নারী ও শিশুসহ ১৩ জন মারা যান। আহত হন ৪০ জন। ওই ঘটনায় ৮ নম্বর বাড়ির মালিক মোহাম্মদ আলী বাদী হয়ে ১৯৯৬ সালের ২৯ নভেম্বর মোহাম্মদপুর থানায় এ মামলাটি করেন। ২০০১ সালের এপ্রিলে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) আদালতে চার্জশিট (অভিযোগপত্র) দেয়। এরপর ২০০৬ সালের ১ নভেম্বর এ মামলায় ১৭ জনের বিরুদ্ধে চার্জ গঠন করে আদালত। ১৭ আসামির মধ্যে ২০১০ সালের ২৮ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলায় মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত পাঁচজনের ফাঁসি কার্যকর করা হয়। এ ছাড়া মামলার বাকি ১২ আসামি পলাতক। আদালতের নথিপত্রে বলা হয়, মামলার ৫৮ সাক্ষীর মধ্যে এখনো পর্যন্ত বাদীসহ ২০ জনের সাক্ষ্য গ্রহণ সম্ভব হয়েছে। সমন দিয়ে, এমনকি গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেও সাক্ষীদের আদালতে হাজির করা যাচ্ছে না।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকার মহানগর দায়রা জজ আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) আবদুল্লাহ আবু বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, মামলাটিতে সাক্ষ্য গ্রহণ শেষ করার জন্য রাষ্ট্রপক্ষ সর্বাত্মক প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছে। করোনার কারণে প্রায় দেড় বছর সাক্ষ্য গ্রহণ বন্ধ থাকার পর গত বছর দুজনের সাক্ষ্য গ্রহণ করা সম্ভব হয়েছে। আর কোনো সাক্ষী পাওয়া না গেলেও তদন্ত কর্মকর্তার সাক্ষ্য গ্রহণের মাধ্যমে মামলার বিচারকাজ চলতি বছরই শেষ করার চেষ্টা করা হবে বলে জানান তিনি।

হাই কোর্টের স্থগিতাদেশে বন্ধ সেরনিয়াবাত হত্যা মামলার বিচার : পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট ভোর সাড়ে ৫টার দিকে বঙ্গবন্ধুর ভগ্নিপতি তৎকালীন পানি ও বন্যানিয়ন্ত্রণ মন্ত্রী আবদুর রব সেরনিয়াবাতের বাড়িতে হামলা চালায় সেনারা। বাসার সব সদস্যকে ড্রয়িংরুমে জড়ো করে তারা। একপর্যায়ে ব্রাশফায়ার করে আবদুর রব সেরনিয়াবাতসহ আটজনকে হত্যা করে ঘাতকরা। এ ঘটনায় ১৯৯৬ সালের ২১ অক্টোবর আবদুর রব সেরনিয়াবাতের ছেলে আবুল হাসানাতের স্ত্রী সাহান আরা বেগম বাদী হয়ে ঢাকার রমনা থানায় হত্যা মামলা করেন। ১৯৯৭ সালের ৩০ জুলাই ১৫ সাবেক সেনা কর্মকর্তাসহ ১৬ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দাখিল করা হয়। এ মামলার এক আসামি ২০০০ সালের ফেব্রুয়ারিতে মামলাটির স্থগিতাদেশ চেয়ে উচ্চ আদালতে আবেদন করেন। উচ্চ আদালত তিন মাসের জন্য মামলার কার্যক্রম স্থগিত করেন। ২০০১ সালে বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট ক্ষমতায় আসার পর এ স্থগিতাদেশ দফায় দফায় বাড়তে থাকে। এরপর ২০০৩ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি সরকারের প্রতি দেওয়া রুলের শুনানি না হওয়া পর্যন্ত মামলার কার্যক্রম স্থগিত করা হয়। এভাবে ২২ বছর ধরে স্থগিত আছে এ মামলার বিচার।

তবে মূল মামলাটি বতর্মানে ঢাকার প্রথম অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ আদালতে বিচারাধীন। জানতে চাইলে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী আবদুস সাত্তার দুলাল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, উচ্চ আদালতের স্থগিতাদেশের কারণে মামলাটি এখনো মুলতবি আছে। তাই বিচারকাজ এগিয়ে নেওয়া যাচ্ছে না।

এ মামলার বিষয়ে জানতে চাইলে অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘বিষয়টি আমার জানা নেই। আমি দায়িত্ব নেওয়ার পর এ বিষয়ে আমাকে কেউ অবহিত করেনি।’ খোঁজ নিয়ে এ বিষয়ে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে বলেও জানান রাষ্ট্রের প্রধান এই আইন কর্মকর্তা।

শেখ মণি হত্যা মামলা : ২৫ থেকে ৩০ জনের একটি ঘাতক দল পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট শেখ ফজলুল হক মণির ধানমন্ডির ১৩/১-এর বাসায় আক্রমণ চালায়। তারা খুন করে শেখ মণি ও তার অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী আরজু মণিকে। ১৯৯৬ সালের ২০ নভেম্বর ধানমন্ডি থানায় ১৮ জনকে আসামি করে মামলা হলেও নথি না পাওয়ায় মামলার কার্যক্রম এগিয়ে নেওয়া যাচ্ছে না বলে জানিয়েছে বিভিন্ন সূত্র।

এ মামলার বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকার মহানগর দায়রা জজ আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) আবদুল্লাহ আবু বলেন, ‘নথি হারিয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই। যেহেতু শুনানি হচ্ছে না, তাই নথি খোঁজা হয়নি। আমরা চেষ্টা চালাচ্ছি। আশা করছি এ মামলাও দ্রুত শেষ করা যাবে।’

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর