বৃহস্পতিবার, ২২ সেপ্টেম্বর, ২০২২ ০০:০০ টা

সংঘর্ষে রণক্ষেত্র মুন্সীগঞ্জ

বিএনপি নেতা-কর্মী পুলিশসহ আহত শতাধিক, গুলিবিদ্ধ তিনজন ঢাকায়

নিজস্ব প্রতিবেদক

সংঘর্ষে রণক্ষেত্র মুন্সীগঞ্জ

মুন্সীগঞ্জে গতকাল পুলিশ ও বিএনপি নেতা-কর্মীদের মধ্যে ব্যাপক সংঘর্ষ হয় -বাংলাদেশ প্রতিদিন

মুন্সীগঞ্জ সদর উপজেলায় পুলিশের সঙ্গে বিএনপি নেতা-কর্মীদের ব্যাপক সংঘর্ষ ঘটেছে। গতকাল বিকাল ৩টা থেকে মুন্সীগঞ্জ শহরের উপকণ্ঠ মুক্তারপুরের পুরনো ফেরিঘাট এলাকায় দেড় ঘণ্টাব্যাপী এ সংঘর্ষে সাংবাদিক, পুলিশসহ শতাধিক আহত হয়েছেন। ফেরিঘাট এলাকা রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। ৪টার দিকে পুলিশের আরও কয়েকটি ইউনিট ঘটনাস্থলে পৌঁছে একসঙ্গে গুলি, রাবার বুলেট ও টিয়ার শেল ছোড়া শুরু করলে বিএনপি নেতা-কর্মীরা ছত্রভঙ্গ হয়ে যান। সংঘর্ষের খবর সংগ্রহ করতে গিয়ে দুজন সংবাদকর্মী গুরুতর আহত হয়েছেন। গুলিবিদ্ধ ও আহত কয়েকজন বিএনপি নেতার অবস্থা অত্যন্ত আশঙ্কাজনক। দফায় দফায় এ সংঘর্ষে আহত যুবদল কর্মী মো. শাওন (২১), বিএনপি কর্মী জাহাঙ্গীর আলম (৪০) ও ছাত্রদল কর্মী মো. তারেককে (২০) ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আনা হয়েছে।

গতকাল সন্ধ্যার দিকে স্থানীয় বিএনপি নেতা মোহাম্মদ সামি তাদের হাসপাতালে নিয়ে আসেন। শাওনের মাথায় গুলি লেগেছে বলে কর্তব্যরত চিকিৎসক জানিয়েছেন। তার অবস্থা বেশি খারাপ। পুলিশ, বিএনপি নেতা-কর্মী ও প্রত্যক্ষদর্শীদের সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে। আহত নেতা-কর্মীদের মুন্সীগঞ্জের হাসপাতালে পুলিশ চিকিৎসা নিতে দিচ্ছে না বলেও অভিযোগ উঠেছে।

মিনহাজুল ইসলাম নামে পুলিশের এক বড় কর্মকর্তা কর্মসূচির ব্যানার ছিনিয়ে নিয়ে ছিঁড়ে ফেলায় এ সংঘর্ষের সূত্রপাত বলে বিএনপি নেতারা দাবি করেছেন। সমাবেশে ঢাকা থেকে বিএনপির কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক অ্যাডভোকেট আবদুস সালাম আজাদ, বেনজীর আহমেদ ও জেলা বিএনপির সদস্যসচিব কামরুজ্জামান রতন অংশ নেন। তাঁরা জানান, বিএনপির শান্তিপূর্ণ সমাবেশে আসা একটি মিছিল থেকে জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার জোরপূর্বক ব্যানার কেড়ে নিয়ে ছিঁড়ে ফেলেন। এরপর সমাবেশস্থল ত্যাগের নির্দেশ দেন বিএনপি নেতা-কর্মীদের। এ থেকেই মূলত ঘটনার সূত্রপাত। এরপর তাদের ছোড়া মুহুর্মুহু কাঁদানে গ্যাস, গুলি ও রাবার বুলেটে বিএনপির শতাধিক নেতা-কর্মী আহত হয়েছেন।

অন্যদিকে পুলিশ বলছে, বিএনপি নেতা-কর্মীরা পরিকল্পিতভাবে পুলিশের ওপর ইটপাটকেল ছুড়েছেন। এতে পুলিশের ২০-২৫ জন সদস্য আহত হয়েছেন। এজন্য তারা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে লাঠিচার্জ, গুলি, টিয়ার শেল ও রাবার বুলেট ছুড়েছেন। আহত পুলিশ সদস্যরা হলেন- অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (সদর) মিনহাজ উল ইসলাম, মুন্সীগঞ্জ সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) তারিকুজ্জামান, পরিদর্শক মোজাম্মেল হক, উপপরিদর্শক (এসআই) আবুল বাসার, ফরিদুল হাসান, লিটু গাজী, ফাইজুর রহমান, কাজল দাস, মাইনুদ্দিন, সুকান্ত বাউল, আনিসুল হক, অজিত, কনস্টেবল রায়হান প্রমুখ। তাঁদের মুন্সীগঞ্জ জেনারেল হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে।

জানা গেছে, আহত দুই বিএনপি কর্মীর মধ্যে একজনের মাথা এবং অন্যজনের মুখ থেঁতলে গিয়ে ভয়ানক আকার ধারণ করেছে। এদেরসহ তিনজনকে ঢাকা মেডিকেলে ভর্তি করা হয়েছে। গুলিবিদ্ধ এ তিনজনকে তাৎক্ষণিকভাবে দলের কেন্দ্রীয় যুগ্মমহাসচিব হাবিব-উন-নবী খান সোহেল ও স্বাস্থ্যবিষয়ক সম্পাদক ডা. রফিকুল ইসলাম হাসপাতালে দেখতে যান।

সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানান, বিকাল ৩টার দিকে বিএনপি নেতা-কর্মীরা পূর্বনির্ধারিত কর্মসূচিতে যোগ দিতে মিছিল নিয়ে মুক্তারপুরে সমবেত হন। পুলিশ তাদের সেখানে অবস্থান করতে নিষেধ করে। মুক্তাপুর থেকে পরে নেতা-কর্মীরা ট্রাকে করে পুরনো ফেরিঘাট এলাকায় যান। সেখানে বিভিন্ন এলাকা থেকে ছোট ছোট মিছিল আসতে শুরু করে। এ সময় মুন্সীগঞ্জ সদর সার্কেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মিনহাজুল ইসলাম বিএনপির একটি মিছিলের ব্যানার ধরে টান দেন। এতে নেতা-কর্মীরা পুলিশের সঙ্গে বাগ্?বিতণ্ডায় জড়িয়ে পড়েন। একপর্যায়ে তাঁরা পুলিশের দিকে ইটপাটকেল নিক্ষেপ শুরু করেন। পুলিশও পাল্টা গুলি ছোড়ে। প্রথম দিকে ১০ থেকে ১৫ মিনিট বিএনপির ইটপাটকেলের জবাবে গুলি ছোড়ে পুলিশ। তবে পরবর্তী ৩৫ মিনিটে পুলিশকে কোণঠাসা করে ফেলেন বিএনপি কর্মীরা। তিন দিক থেকে ছোড়া ইটপাটকেলে বেশ কয়েকজন পুলিশ সদস্য আহত হন। এ সময় কয়েকজন পুলিশ সদস্যকে পিছু হটতে হটতে ধলেশ্বরী নদীতে ঝাঁপ দিতে দেখা যায়। ঘটনাস্থলে বিএনপির এক কর্মী গুলিবিদ্ধ হন। আহত অন্য নেতা-কর্মীরাও কেউ মুন্সীগঞ্জ জেলা হাসপাতালে না গিয়ে অন্যান্য হাসপাতালে চিকিৎসা নেন। বিকাল ৪টার দিকে পুলিশের একাধিক দল এসে যোগ দিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে। সংবাদ সংগ্রহ করতে গিয়ে দুই পক্ষের সংঘর্ষের মাঝখানে পড়ে দৈনিক মানবজমিনের স্টাফ রিপোর্টার মোজাম্মেল হোসেন সজল, বাংলাভিশন প্রতিনিধি সোনিয়া হাবিব লাবণী, সমকালের জেলা প্রতিনিধি কাজী সাব্বির আহমেদ দীপু, দিনকালের জেলা প্রতিনিধি গুলজার হোসেন ও সাংবাদিক রুবেল আহত হন। এ সময় উত্তেজিত নেতা-কর্মীরা পুলিশ ও সাংবাদিকদের আটটি মোটরসাইকেল ভাঙচুর করেন ও পুড়িয়ে দেন। ঘটনাস্থল থেকে সাতজনকে আটক করেছে পুলিশ।

জেলা বিএনপির একজন সিনিয়র নেতা বলেন, ‘পুলিশের অনুমতি নিয়েই শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি শুরু করতে যাচ্ছিলাম। ৩টার দিকে আমাদের নেতা-কর্মীরা মিছিল নিয়ে মুক্তারপুরের দিকে আসছিলেন। তখন পুলিশ আমাদের লোকজনকে মিছিল করতে নিষেধ করে। আমাদের লোকজন মিছিল করা বন্ধ করে দেন। সে সময় পুলিশের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা মিছিল থেকে ব্যানার টেনে ছিঁড়ে ফেলেন। এ নিয়ে বিএনপি নেতা-কর্মীদের সঙ্গে পুলিশের বাগ্?বিতণ্ডা হয়। পুলিশ আমাদের লোকজনের ওপর লাঠিচার্জ করে, হামলা চালায়। পরে আমাদের লোকজন আত্মরক্ষার্থে ইটপাটকেল নিক্ষেপ করেন। পুলিশ আমাদের ওপর তখন বৃষ্টির মতো রাবার বুলেট, টিয়ার গ্যাস ও গুলি ছুড়তে থাকে। এতে আমাদের শতাধিক নেতা-কর্মী আহত হয়েছেন। এর মধ্যে একজনের অবস্থা গুরুতর।’

মুন্সীগঞ্জ সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) তারিকুজ্জামান বলেন, ‘পুলিশ সেখানে শান্তিপূর্ণভাবে অবস্থান করছিল। বিএনপি নেতা-কর্মীরা পূর্বপরিকল্পিতভাবে পুলিশের দিকে ইটপাটকেল নিক্ষেপ শুরু করেন। তাঁদের নিষেধ করায় তাঁরা আরও ইটপাটকেল নিক্ষেপ করেন এবং পুলিশের ওপর হামলা চালান। এতে পুলিশের অন্তত ২০ জন আহত হয়েছেন। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আমরা টিয়ার শেল নিক্ষেপ করি।’

প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, বিকাল ৩টার দিকে মুক্তারপুর ফেরিঘাট এলাকায় বিএনপির নির্ধারিত বিক্ষোভ সমাবেশ শুরু হওয়ার আগে একটি মিছিল নিয়ে সমাবেশস্থলে আসার সময় পুলিশ তাদের বাধা দেয় এবং ব্যানার কেড়ে নেয়। এ সময় বিএনপি নেতা-কর্মীরা উত্তেজিত হয়ে ওঠেন। একপর্যায়ে উভয় পক্ষের মধ্যে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া শুরু হলে পুলিশ লাঠিচার্জ করে। এরপর তারা নির্বিচার গুলি, টিয়ার শেল ও রাবার বুলেট ছোড়ে।

প্রতিবাদে রাজধানীতে বিক্ষোভ : মুন্সীগঞ্জে দলীয় নেতা-কর্মীদের ওপর হামলাসহ শতাধিক নেতা-কর্মীকে আহত করার প্রতিবাদে রাজধানীতে বিক্ষোভ মিছিল করেছে বিএনপি। গতকাল সন্ধ্যা ৭টার দিকে বিএনপির সিনিয়র যুগ্মমহাসচিব রুহুল কবির রিজভী আহমেদের নেতৃত্বে মিছিলটি নয়াপল্টনে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে থেকে শুরু হয়। পরে নাইটিঙ্গেল মোড় ঘুরে পুনরায় কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে সংক্ষিপ্ত সমাবেশের মাধ্যমে শেষ হয়।

মিছিলে যুবদল সভাপতি সুলতান সালাউদ্দিন টুকু, সাধারণ সম্পাদক আবদুল মোনায়েম মুন্না, ছাত্রদলের সাবেক সহসভাপতি মাহমুদুল হাসান বাপ্পি, ছাত্রদল সভাপতি কাজী রওনকুল ইসলাম শ্রাবণ, সাধারণ সম্পাদক সাইফ মাহমুদ জুয়েলসহ বিএনপির অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনের বিভিন্ন পর্যায়ে নেতা-কর্মী অংশ নেন।

সর্বশেষ খবর