ভাষাই আমাদের ভিত্তি। ভাষা আন্দোলনের পথ ধরেই মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল। দেশ স্বাধীন হয়েছিল। কিন্তু ভাষার মর্যাদা যেভাবে দেওয়ার কথা ছিল, সেভাবে পারিনি। ইংরেজি স্কুলে পড়া ছেলে-মেয়েরা শুধু ইংরেজি ভাষাটা শেখার জন্য নিজের কৃষ্টি, সংস্কৃতি, ভাষা সবকিছু উৎসর্গ করছে। তাদের একটা মাত্র বই আছে বাংলা। সেটায় সবাই ‘এ’ পায়। বোঝানো হয় তারা খুব ভালো বাংলা শিখছে। অথচ, ওই ‘এ’ পাওয়া ছেলে-মেয়েগুলো বাংলা ঠিকমতো বোঝেই না। ইংরেজি স্কুলে পড়া একটি শিশু ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসও জানছে না। ছেলে-মেয়েদের ভাষা আন্দোলন সম্পর্কে না জানাটা শিক্ষার ত্রুটি। নতুন প্রজন্মকে নিজের শিকড় জানতে হবে আগে। ভুল শিক্ষা পদ্ধতির কারণে আজ ইংরেজি স্কুল মাশরুমের মতো গজাচ্ছে। আছে মাদরাসা শিক্ষা। অথচ, আমাদের দরকার ছিল একরৈখিক শিক্ষা পদ্ধতি। ইংরেজি স্কুলে পড়া ছেলে-মেয়েরা নিজের ভাষাটাই ঠিকভাবে জানছে না। রক্ত দিয়ে অর্জিত মাতৃভাষার গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস জানছে না। ইংরেজি আমাদের প্রয়োজন, তবে তা বাংলাকে বাদ দিয়ে নয়। এখন নিম্নমধ্যবিত্ত বা মধ্যবিত্ত যারা ইংরেজি স্কুলে সন্তানদের পড়াচ্ছেন, তাদের লক্ষ্য মূলত ভালো ইংরেজি শিখিয়ে আমেরিকা, কানাডা, সুইডেন, অস্ট্রেলিয়া- এসব দেশে সন্তানকে পাঠানো। বাংলা শিখলে যে সে ইংরেজি পারবে না, এমন কথা তো নেই। বিশ্ববিদ্যালয়ে যারা ইংরেজি পড়ান তাদের অধিকাংশের লেখাপড়ার ভিত্তি বাংলা। ম্যাট্রিক পর্যন্ত তারা বাংলা মিডিয়ামে পড়েছেন। তারা ইংরেজি মাধ্যমে গিয়ে ইংরেজি শিক্ষাও দিচ্ছেন, আবার বাংলাও দিচ্ছেন। তাই ইংরেজি মাধ্যমে পড়লেও যেন একজন শিক্ষার্থী বাংলা ভাষা, বাংলাদেশের ইতিহাস, সংস্কৃতি বিস্তৃতভাবে পড়তে পারে সেই ব্যবস্থা করতে হবে। নিজের শিকড়টা জানা জরুরি। এ ব্যাপারে দেরি হলে অনেক বড় শূন্যতা তৈরি হবে। ভাষার ব্যাপারে অনেক পিছিয়ে যাব।
১৯৫২ সালে ভাষার জন্য আমরা রক্ত দিলেও ভাষা আন্দোলন এখনো চলছে। এখন ভাষার ওপরে যত কাজ হচ্ছে সেটাও আন্দোলনেরই একটা অংশ। ভাষার উন্নয়ন ও শিল্প-সাহিত্যের বিকাশে সবচেয়ে বেশি কাজ বাংলা একাডেমির। কিন্তু, বাংলা একাডেমিতে ইংরেজি বই যেভাবে অনুবাদ হওয়া দরকার ছিল, যে গুরুত্বের সঙ্গে করার কথা ছিল, সেটা তারা করছে না। বাংলা একাডেমির মূল কাজ হয়ে গেছে এখন বইমেলা। এর জন্য প্রায় ছয় মাস ব্যস্ত থাকে প্রতিষ্ঠানটি। বইমেলার জন্য প্রকাশকরা সারাক্ষণ সেখানে যাচ্ছেন, স্টল বরাদ্দ নিচ্ছেন। এরপর মেলা পরিচালনা। বাংলা একাডেমির কাজের ব্যাপ্তি অনেক বড়। অনুবাদ থেকে শুরু করে সাহিত্যকে আরও গভীরে নিয়ে যাওয়া তাদের কাজ। নিজেদের ভাষা ও সাহিত্যকে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে নিয়ে যাওয়াও তাদের কাজ। মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট, বাংলা একাডেমি- এই প্রতিষ্ঠানগুলোর কাজই তো দেশের সাহিত্যকে দেশ-বিদেশে ছড়িয়ে দেওয়া। আমি একজন লেখক। ব্যক্তিগতভাবে আমার তো সাধ্য নেই নিজের বই আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ছড়িয়ে দেওয়ার। এটা তো ইনস্টিটিউটের কাজ। তারা বইমেলা নিয়ে ব্যস্ত থাকলে এই কাজগুলো কখন করবে? আজ হোক, কাল হোক বাংলা একাডেমিকে বইমেলার দায়িত্ব ছাড়তে হবে। না হলে বাংলা ভাষার উন্নতি হবে না। প্রচুর ভালো ভালো বই লেখা হচ্ছে। সেগুলো অনুবাদ করতে হবে। না হলে আমাদের শিল্প-সাহিত্য আন্তর্জাতিক অঙ্গনে পৌঁছাবে না। বিশ্বের অন্যান্য দেশে একটি ভালো বই বের হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে অনুবাদ হয়ে যাচ্ছে। এখানে কেন হচ্ছে না? আমাদের দৌড় বড়জোর পশ্চিমবঙ্গ পর্যন্ত। সেখানকার পাঠকরাও আমাদের বই পড়ছেন না। শুধু ইংরেজি কেন, জার্মান ভাষায়, ফ্রেন্স ভাষায় কেন অনূদিত হবে না? সৈয়দ হকের বই জার্মান ভাষায় অনূদিত হয়েছে। জার্মান ছেলে মেয়েরা বঙ্গবন্ধুর বীরগাথা এখন পড়ছে জার্মান ভাষায়। এই বইটা অনূদিত না হলে তো তারা পড়তে পারত না। লেখক : কথাসাহিত্যিক। অনুলেখক : শামীম আহমেদ
