রবিবার, ১৯ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩ ০০:০০ টা

বিশ্বায়নের পরিপ্রেক্ষিতে কথ্য-বাংলার রূপ

ড. সৌমিত্র শেখর

বিশ্বায়নের পরিপ্রেক্ষিতে কথ্য-বাংলার রূপ

একবিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে সারা বিশ্বের যে ব্যাপক রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক পরিবর্তন সাধিত হয় তার প্রভাব বাঙালির জীবনেও পড়ে। বিশ্বায়নের নামে আজ চলছে মূলত পাশ্চাত্যায়ন। সে-কারণে পাশ্চাত্য শিক্ষা-সংস্কৃতি এবং ভাষা হিসেবে ইংরেজির দাপট সারা বিশ্বে। আর এ সবকিছুই পুঁজিবাদের অদলবদল মাত্র। গণমানুষের সমান অধিকার ও সাম্যবাদের কথা বলেও সমাজতান্ত্রিকরা বুর্জোয়া সমাজব্যবস্থার প্রতি মানুষের মোহ দূর করতে পারেনি। তাদের আদর্শে যত না সমস্যা, মূল অসংগতিটা ছিল কর্ম ও কথার। বুর্জোয়া সমাজ বা সাম্রাজ্যবাদের পুঁজি এখন মানুষকে আশার আলো দেখায়। আগে যাকে কুহেলিকা বলা হয়েছিল, আজ তাকে সত্য বলা হচ্ছে। তবে কি কুহেলিকাও আলোকিত হয়, একি প্যারাডক্স? মানুষের মনে এ অবস্থা সৃষ্টির পেছনে ধর্মীয় মৌলবাদের উত্থানকেই প্রধানত দায়ী করা যায়। বুর্জোয়া সমাজব্যবস্থা অন্তত ধর্মীয় মৌলবাদের মতো উগ্র ও অমানবিক নয়। এই বোধ বিবেকবান মানুষকে তাড়িত করেছে। তাই চারদিকে ধর্মীয় উগ্রতা ও অসহিষ্ণুতা প্রত্যক্ষ করে অনেকেই মন্দের ভালো হিসেবে বিশ্বায়নের নামে পাশ্চাত্যায়ন হলেও তাকেই শ্রেয়তর ভেবে নিয়েছে। এ পরিস্থিতিতে আমাদের অবস্থান কী হবে? পাশ্চাত্যায়নের পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের কথ্যরীতির ভাষায় শব্দ প্রয়োগে পরিবর্তন আনা জরুরি। বাংলায় প্রচুর আরবি-ফারসি শব্দ আছে, আছে অন্য ভাষার শব্দও। মনে রাখতে হবে, রাজভাষা ও রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতার কারণেই আরবি-ফারসি বাংলার ওপর একসময় খুব বেশি করে জেঁকে বসেছিল। বাঙালি ধর্ম-সম্প্রদায় নির্বিশেষে ওই সময় আরবি-ফারসি শিখেছিল। একটি সমৃদ্ধ সাহিত্য ও ভাষা হিসেবেই শুধু নয়, ইংরেজি শিখতে হবে বাংলাকে ঋদ্ধ করা ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে নিজস্ব পরিচিতির জন্যও। আজ বাংলায় আরবি-ফারসি শব্দের চাইতে তাই ইংরেজি শব্দের আগমনও অধিক হারে ঘটছে। এ ধারা অব্যাহত থাকবে এ কারণে যে, ইংরেজি শুধু আমাদের অফিসের মুখ্য ভাষা বলে নয়, সারা বিশ্বের সর্বাপেক্ষা পরিচিত ও গুরুত্বপূর্ণ ভাষা বলেও। বাংলা ভাষার কথ্যরীতিতে অন্য ভাষার শব্দ অপেক্ষা ইংরেজি শব্দের সমাদর বাড়ানো দরকার। যে কারণে একদিন ধর্মনির্বিশেষে সব বাঙালি আরবি-ফারসি শিখেছিল এবং ওই ভাষা দুটোর শব্দ-সম্পদ নিজভাষায় গ্রহণ করেছিল, আজ একই কারণে বাঙালির উচিত ইংরেজি ভাষার সমাদর করা এবং অন্য ভাষা থেকে শব্দ-সম্পদ গ্রহণের প্রশ্নে আরবি-ফারসির তুলনায় ইংরেজিকে প্রাধান্য দেওয়া। তবে বাংলা শব্দকে বিসর্জন দিয়ে ইংরেজি শব্দ গ্রহণ নয়, বাংলা উচ্চারণকেও বিকৃত করে ইংরেজির স্বর ও সুর আগমন ঘটিয়ে নয়। যে শব্দ বাংলায় নেই, বাংলা পরিভাষা তৈরি বা জনপ্রিয় হয়নি, তেমন ক্ষেত্রে ইংরেজি শব্দ গ্রহণ করা যেতেই পারে। লেখার ক্ষেত্রে নিরেট ও নির্ভুল বাংলা-অনুমোদিত শব্দ ব্যবহার এবং বাংলা ব্যাকরণ-সিদ্ধ বাক্য গঠন করে ভাষার স্বকীয়তা রক্ষা করা জরুরি। বাংলার কথ্যরীতি থেকে লেখ্যরীতি আবশ্যিকভাবেই পৃথক হবে। অতএব, লেখার ক্ষেত্রে বাংলার সার্বিক নিয়মাবলির ব্যত্যয় না করে ব্যাকরণসম্মত পন্থা অবলম্বন করা উচিত। এতে স্বাজাত্যপ্রীতি ও ভাষাবোধ প্রকাশের মাধ্যমে জাতীয় সংহতি দৃঢ়তর হবে। কিন্তু বলার ক্ষেত্রে বাংলার পশ্চিমমুখো গবাক্ষপথ আরও বেশি করে অবমুক্ত করতে হবে। ভাষাকে গতিশীল করে যুগের সঙ্গে মেলাতে হলে চাই প্রচুর মূল্যবান ও ধারালো শব্দ-সম্পদ। এ সম্পদ অন্য ভাষা থেকে যদি গ্রহণ করতেই হয়, তবে তা ইংরেজি থেকে নয় কেন? বিশ্বায়নের পরিপ্রেক্ষিতে চাই বাংলা কথ্যরীতির খোলনলচে বদল, তবে ঐতিহ্য রক্ষা এবং লেখ্যরীতিকে সংহত করে, অবশ্যই।

লেখক : উপাচার্য, নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়

সর্বশেষ খবর