বুধবার, ১ মার্চ, ২০২৩ ০০:০০ টা
কিশোরগঞ্জে জনসভায় শেখ হাসিনা

ওয়াদা করুন, নৌকায় ভোট দেবেন

সাইফউদ্দীন আহমেদ লেনিন, কিশোরগঞ্জ

ওয়াদা করুন, নৌকায় ভোট দেবেন

কিশোরগঞ্জে গতকাল জনসভা পরিণত হয় জনসমুদ্রে -পিআইডি

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে আরও একবার নৌকা প্রতীকে ভোট চেয়ে হাওরের মানুষের ওয়াদা নিলেন আওয়ামী লীগ সভানেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। হাওরবাসীর উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘এই বছরের শেষে বা ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে যে নির্বাচন হবে, সেখানে আওয়ামী লীগকে ভোট দিয়ে জয়যুক্ত করে আপনাদের সেবা করার সুযোগ দেবেন। আপনারা দুই হাত তুলে ওয়াদা করেন নৌকায় ভোট দেবেন।’ এ সময় উপস্থিত জনতা হাত নেড়ে প্রধানমন্ত্রীর আহ্বানের প্রতি সমর্থন জানায়। একই সঙ্গে নেতা-কর্মীরা ‘নৌকা নৌকা’ স্লোগানে জনসভাস্থল মুখরিত করে তোলেন। গতকাল বিকালে কিশোরগঞ্জের মিঠামইন উপজেলা সদরে হেলিপ্যাড মাঠে স্থানীয় আওয়ামী লীগ আয়োজিত জনসভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এ ওয়াদা করান। এ সময় আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা বলেন, বিএনপি যখনই ক্ষমতায় এসেছে তখনই দেশের সম্পদ লুট করেছে। সেই সম্পদ বিদেশে পাচার করে এখন আরাম-আয়েশে দিন কাটায়। আর দেশের মানুষ যখন কষ্ট পায়, তখন তারা আরও কষ্ট দেয়। আগুন দিয়ে মানুষ পুড়িয়ে হত্যা করে। যারা বোমা মেরে, আগুন দিয়ে মানুষকে হত্যা করতে পারে তারা কখনো মানুষের কল্যাণ করতে পারে না। আর আওয়ামী লীগ জাতির পিতার হাতে গড়া সংগঠন। আওয়ামী লীগ যখনই ক্ষমতায় আসে দেশের মানুষের কল্যাণ হয়। মানুষ খেয়ে-পরে ভালো থাকে। মানুষের ভাগ্য পরিবর্তন হয়। অন্তত ১৪ বছরে আজকের বাংলাদেশ ঘুরে দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশ বিশ্বে মর্যাদা পেয়েছে, বাংলাদেশ উন্নয়নের রোল মডেল। বাংলাদেশ এগিয়ে যাবে।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, আমার চাওয়া-পাওয়ার কিছু নেই। মা, বাবা, ভাই সব হারিয়েছি। আমি নিঃস্ব, রিক্ত। এ দেশের মানুষকে আমার বাবা ভালোবেসেছিলেন, তিনি তাঁর জীবন দিয়ে গেছেন। জীবন দিয়ে গেছেন আমার মা, আমার ভাইয়েরা। আজকে আমি আপনাদের পাশে দাঁড়িয়েছি, আপনাদের ভাগ্য পরিবর্তন করার জন্য।

মঞ্চে উপস্থিত রাষ্ট্রপতির ছেলে কিশোরগঞ্জ-৪ (ইটনা-মিঠামইন-অষ্টগ্রাম) আসনের সংসদ সদস্য প্রকৌশলী রেজওয়ান আহাম্মদ তৌফিককে দেখিয়ে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী বলেন, গত নির্বাচনে রাষ্ট্রপতির ছেলেকে ভোট দিয়ে নির্বাচিত করেছেন। আপনাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাই। আগামীতেও একমাত্র নৌকা মার্কা সরকারে এলে আপনাদের উন্নতি হবে, দেশের উন্নতি হবে। এই হাওরাঞ্চলের উন্নয়নে যে সার্বিক কর্মসূচি আমরা বাস্তবায়ন করছি, সেগুলো বাস্তবায়িত হবে।

শেখ হাসিনা বলেন, নৌকা আমাদের প্রতীক। নদীমাতৃক বাংলাদেশ, এই নৌকায় ভোট দিয়ে দেশের মানুষ স্বাধীনতা পেয়েছে। এই নৌকায় ভোট দিয়েছে বলেই আজকে কিশোরগঞ্জ অবহেলিত নেই। আজকে উন্নত একটি জেলায় উন্নীত হয়েছে। প্রতিটি উপজেলা উন্নত হচ্ছে। তিনি বলেন, এই নৌকায় ভোট দিয়েছে বলেই এ দেশের মানুষ শিক্ষার সুযোগ পাচ্ছে, স্বাস্থ্যসেবা পাচ্ছে। ডিজিটাল বাংলাদেশ করেছি। সেই সুযোগটা সবাই পাচ্ছে। নৌকা মার্কায় ভোট দিয়ে আমাদের আপনাদের সেবা করার সুযোগ দিয়েছেন। তাই আপনাদের পাশে আমরা সব সময় আছি। সরকারপ্রধান বলেন, কিশোরগঞ্জ হলো সেই জেলা, মুক্তিযুদ্ধের সময় যখন বঙ্গবন্ধু গ্রেফতার হয়েছিলেন তখন যে সরকার গঠন হয়েছিল সৈয়দ নজরুল ইসলাম উপ-রাষ্ট্রপতি ছিলেন। আর তাজউদ্দীন আহমদ প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। তারা তখন মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করেছিলেন। রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমান ছিলেন এই কিশোরগঞ্জের। আর এখন হামিদ ভাই, তিনিও রাষ্ট্রপতি। কাজেই আমি তো দেখি কিশোরগঞ্জ থেকে সব সময় রাষ্ট্রের প্রধান হয়ে সারা বাংলাদেশ পরিচালনা করছেন। কিশোরগঞ্জবাসী ভোট দেন, তাই সব সময় আমরা আপনাদের প্রতি কৃতজ্ঞ। আওয়ামী লীগ সরকারের সঙ্গে অন্য সরকারগুলোর কাজের তুলনা করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, বিএনপি-জামায়াত যখন ক্ষমতায় আসে, তখন লুটপাট, অর্থ পাচার, জঙ্গিবাদ, দুর্নীতি, সন্ত্রাস, মানুষ হত্যা, আর আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীর ওপর অকথ্য নির্যাতন চালায় তারা। মানুষের ওপর অত্যাচার আর মানুষকে শোষণ করা ছাড়া কিছু তারা দিতে পারে নাই, পারবেও না। তার কারণ হচ্ছে যাদের হাতে এই দলটি (বিএনপি) সৃষ্টি তারা কখনো জনগণের ভোট নিয়ে ক্ষমতায় যায় না। তিনি বলেন, অবৈধভাবে, সংবিধান লঙ্ঘন করে যারা ক্ষমতায় আসে, যে ক্ষমতা উচ্চ আদালত বলেছেন অবৈধ, অবৈধ ক্ষমতা দখলকারীর হাতে তৈরি সংগঠন (বিএনপি); এরা তো জনগণের কথা চিন্তা করে না। এরা বাংলাদেশের কথাই চিন্তা করে না। এরা আসে লুটপাট করে নিতে। তাই যখনই এরা ক্ষমতায় এসেছে এ দেশের মানুষের সম্পদ লুট করেছে, বিদেশে পাচার করে এখন আরাম-আয়েশে দিন কাটায়। মিঠামইন উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা অধ্যক্ষ আবদুল হকের সভাপতিত্বে সমাবেশ সঞ্চালনা করেন উপজেলা আওয়ামী লীগের সিনিয়র সহসভাপতি মো. শাহজাহান মিয়া ও সাধারণ সম্পাদক সমীর কুমার বৈষ্ণব। এতে বক্তব্য রাখেন- আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক, সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, সাংগঠনিক সম্পাদক মির্জা আজম এমপি, দফতর সম্পাদক বিপ্লব বড়ুয়া, কিশোরগঞ্জ-৫ আসনের এমপি আফজাল হোসেন, কিশোরগঞ্জ-৪ আসনের এমপি রাষ্ট্রপতিপুত্র প্রকৌশলী রেজওয়ান আহাম্মদ তৌফিক, কিশোরগঞ্জ-২ আসনের এমপি নূর মোহাম্মদ, কিশোরগঞ্জ-১ আসনের এমপি ডা. সৈয়দা জাকিয়া নূর লিপি, কিশোরগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি ও জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান বীর মুক্তিযোদ্ধা অ্যাডভোকেট মো. জিল্লুর রহমান ও সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট এম এ আফজল প্রমুখ।

প্রধানমন্ত্রীকে স্বাগত জানান রাষ্ট্রপতি ও তাঁর স্ত্রী

দীর্ঘ দুই যুগেরও বেশি সময় পর গতকাল সকালে মিঠামইনে আসেন জাতির পিতার কন্যা। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আগমন উপলক্ষে উৎসবের আমেজ ছিল মিঠামইনসহ গোটা কিশোরগঞ্জে। তোরণ, ব্যানার, ফেস্টুনে সাজানো হয় এ জেলার বিভিন্ন সড়ক, গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা। সুধী সমাবেশ রূপ নেয় পুরোপুরি জনসভায়। মাঠে বিশাল নৌকা আকৃতির মঞ্চ নির্মাণ করা হয়। ভোর থেকে ইটনা, মিঠামইন, অষ্টগ্রাম, করিমগঞ্জ, নিকলী, বাজিতপুরসহ কিশোরগঞ্জের অধিকাংশ উপজেলার নেতা-কর্মীরা বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষকে সঙ্গে নিয়ে সড়কপথে, বাস, পিকআপ, মাইক্রোবাস, অটোরিকশা ও নৌপথে নৌকা, ট্রলার ও লঞ্চযোগে জনসভায় আসেন। সভাস্থলের আশপাশের সড়কগুলোতে বিপুলসংখ্যক মানুষের উপস্থিতি দেখা গেছে। সুধী সমাবেশের আনুষ্ঠানিকতা শুরুর আগেই কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে যায় সমাবেশস্থল। দূরের কয়েক হাজার কর্মী-সমর্থক আগের দিন বিকালেই ট্রলারসহ বিভিন্ন যানবাহনে মিঠামইনে পৌঁছান। রাতে তাঁবু টানিয়ে রাতযাপন করেন। নিজেরাই গরু জবাই ও খিচুড়ি রান্না করে আহার করেন। জেলার বিভিন্ন এলাকা থেকে ট্রলারযোগে নেতা-কর্মীরা হাজির হন মিঠামইনে।

এর আগে গতকাল সকালে এক দিনের সফরে ঢাকা থেকে হেলিকপ্টারে হাওর অধ্যুষিত মিঠামইন আসেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বেলা সাড়ে ১১টার দিকে হেলিপ্যাড থেকে সরাসরি ঘোড়াউত্রা নদীর চরে রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদের নামে নবনির্মিত ‘বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. আবদুল হামিদ সেনানিবাস’ উদ্বোধন ও জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেন প্রধানমন্ত্রী। সেখান থেকে দুপুরে মিঠামইনের কামালপুর গ্রামে রাষ্ট্রপতির বাড়িতে যান তিনি। নিজের বাড়িতে বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ফুল দিয়ে স্বাগত জানান রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ ও তাঁর পরিবারের সদস্যরা।

 

বাংলাদেশের ফুটবল খেলার উন্নয়নে আর্জেন্টিনার সহায়তা চেয়েছেন প্রধানমন্ত্রী

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশের ফুটবল খেলার উন্নয়নে বর্তমান বিশ্বকাপ চ্যাম্পিয়ন আর্জেন্টিনার সহযোগিতা চেয়েছেন। বাংলাদেশের ফুটবলের উন্নয়নে আর্জেন্টিনা বাংলাদেশকে সহযোগিতা করতে পারে অভিমত ব্যক্ত করে শেখ হাসিনা বলেন, মেসির নাম এবং আর্জেন্টিনা দলের ফুটবল বাংলাদেশের ঘরে ঘরে খুবই জনপ্রিয়। আর্জেন্টিনার পররাষ্ট্র ও আন্তর্জাতিক বাণিজ্যবিষয়ক মন্ত্রী সান্তিয়াগো আন্দ্রেস ক্যাফিয়েরো গতকাল সকালে গণভবনে সৌজন্য সাক্ষাৎকালে প্রধানমন্ত্রী এ কথা বলেন। বৈঠকের পর প্রধানমন্ত্রীর স্পিচ রাইটার মো. নজরুল ইসলাম সাংবাদিকদের ব্রিফ করেন। প্রধানমন্ত্রী পারস্পরিক সুবিধার জন্য বাংলাদেশ ও আর্জেন্টিনার মধ্যে ব্যবসা-বাণিজ্য, অর্থনৈতিক, সামাজিক, ক্রীড়া, সংস্কৃতি ও পর্যটনসহ বিভিন্ন খাতে সহযোগিতা বাড়ানোর প্রয়োজনীয়তার ওপরও জোর দেন। আর্জেন্টিনার সঙ্গে যোগাযোগ জোরদারে তাঁর সরকারের আগ্রহ প্রকাশ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ঢাকা বুয়েন্স আয়ার্সের সঙ্গে সম্পর্ক বাড়াতে খুবই আগ্রহী।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, বর্ধিত সহযোগিতার মাধ্যমে দুই দেশ আর্থ-সামাজিক অগ্রগতির মাধ্যমে তাদের জনগণের ভাগ্য পরিবর্তন করতে পারে। এ প্রসঙ্গে শেখ হাসিনা বলেন, আর্জেন্টিনা বাংলাদেশ থেকে তৈরি পোশাকের পাশাপাশি উচ্চমানের ফার্মাসিউটিক্যালস, পাট ও পাটজাত পণ্য, চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য কিনতে পারে।

অন্যদিকে বাংলাদেশ আর্জেন্টিনা থেকে সয়াবিন, এনিমেল ভেজিটেবল ফ্যাটস অ্যান্ড ওয়েল, তৈলবীজ, ফলমূল, দুগ্ধজাত পণ্য এবং প্রাকৃতিক মধু আমদানি করে।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, তাঁর সরকার কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং শিল্পায়নের লক্ষ্যে সারা দেশে ১০০টি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল স্থাপন করছে। তিনি বলেন, বাংলাদেশ এখন দক্ষিণ এশিয়ায় একটি বিপণন কেন্দ্র। প্রধানমন্ত্রী বলেন, তাঁর সরকার শুধু দেশের মধ্যেই নয়, প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গেও শক্তিশালী যোগাযোগ অবকাঠামো গড়ে তুলছে। সান্তিয়াগো আন্দ্রেস ক্যাফিয়েরো আশা প্রকাশ করেছেন যে ঢাকায় আর্জেন্টিনার দূতাবাস পুনরায় খোলার মাধ্যমে দুই দেশের মধ্যে অর্থনৈতিক, বাণিজ্য ও ব্যবসায়িক সহযোগিতা বৃদ্ধি পাবে। তিনি বলেন, ঢাকায় তাদের দূতাবাস পুনরায় চালু হওয়ায় আর্জেন্টিনা খুবই খুশি এবং এ লক্ষ্যে সহযোগিতা প্রদানের জন্য বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানান। এটি প্রথম সফর উল্লেখ করে আর্জেন্টিনার পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশ এত সুন্দর হবে তা কখনই ভাবিনি।

আর্জেন্টিনা প্রথম ১৯৭৪ সালে ঢাকায় তার দূতাবাস খোলে। কিন্তু ১৯৭৮ সালে সামরিক জান্তার শাসনামলে সেটি বন্ধ করে দেওয়া হয়। সোমবার ঢাকার বনানীতে আর্জেন্টিনা দূতাবাস পুনরায় খোলা হয়েছে।

প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সচিব মোহাম্মদ সালাহউদ্দিন, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সচিব (পশ্চিম) সাব্বির আহমেদ চৌধুরী এবং বাংলাদেশে আর্জেন্টিনার অনাবাসিক রাষ্ট্রদূত হুগো গোবি এ সময় উপস্থিত ছিলেন।

সর্বশেষ খবর