মো. সাজেদুল ইসলাম। দীর্ঘ ২৫ বছর যাবৎ পাইলট হিসেবে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সে কর্মরত আছেন। পেশাগত কারণে বৈমানিকদের শুক্র-শনিবার সরকারি ছুটিসহ এমনকি ঈদের মতো উৎসবগুলোতে পরিবার-পরিজন থেকে দূরে বিভিন্ন দেশে অবস্থান করতে হয়। পাইলটদের পেশাগত নানান বিষয়ে কথা বলেন বাংলাদেশ প্রতিদিনের সাথে।
বাংলাদেশ প্রতিদিন : বিমানচালক বা পাইলট হওয়ার ইচ্ছা বা স্বপ্ন কবে থেকে শুরু হয়?
পাইলট সাজেদুল ইসলাম : শৈশবে বাবার হাত ধরে যখন স্কুলের মাঠে বেড়াতে যেতাম, তখন পশ্চিম আকাশে দেখতে পেতাম বিমানের ফোকার-২৭ প্লেনটি প্রপেলারের বিরামহীন শব্দ নিয়ে উড়ে যাচ্ছে। বাবাকে পরে বলতে শুনেছি, তখনই আমি প্লেনের দিকে আঙুল দেখিয়ে বলতাম ‘বাবা আমিও প্লেন চালাবো’। বৈমানিক হওয়ার স্বপ্নটা ঠিক তখন থেকেই শুরু।
প্রশ্ন : পাইলট হওয়ার স্বপ্নপূরণের যাত্রাটা কীভাবে শুরু করেন?
পাইলট : নানান চড়াই-উতরাই পেরিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জনের পর আমার শৈশবের স্বপ্নটা আবার জেঁকে বসে। একদিন এভিয়েশনে আমার অগ্রজ ক্যাপ্টেন তানভীর আমাকে নিয়ে যান বাংলাদেশ ফ্লাইং একাডেমিতে। নানান ফর্ম পূরণ করে ভর্তি হয়ে যাই আমার আজীবন লালিত স্বপ্ন পূরণের আশায়। অধিক প্রশিক্ষণের জন্য পরবর্তীতে ফিলিপাইনের ম্যানিলা যাই। কিছু আওয়ার সেখানে শেষ করার পর দেশে ফিরে আবারও ফ্লাইং একাডেমিতে ফ্লাই করি, বাংলাদেশ সিভিল এভিয়েশন থেকে পিপিএল এবং পরবর্তীতে সিপিএল অর্জন করি।
প্রশ্ন : প্রথম বিমান চালানোর অভিজ্ঞতা যদি আমাদের সাথে শেয়ার করতেন?
পাইলট : বাংলাদেশ ফ্লাইং একাডেমিতে ভর্তি হওয়ার পরও আসতে থাকে নানা প্রতিবন্ধকতা। একদিন আবহাওয়া ভালো নেই, আরেকদিন এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোলের অনুমতি মিলে না, অন্যদিন প্রশিক্ষণ উড়োজাহাজে যান্ত্রিক সমস্যা। অবশেষে এলো প্রথম উড্ডয়নের সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। একদিন অপরাহ্নে আমার জীবনের প্রথম ফ্লাইট প্রশিক্ষক ক্যাপ্টেন মোজাম্মেল আমাকে ফ্লাইং বিভিন্ন ধাপ নিয়ে ব্রিফিং করেন। পড়ন্ত বিকেলে ক্যাপ্টেন মোজাম্মেলকে সাথে নিয়ে আমি চেপে বসি সেসনা-১৫০ উড়োজাহাজে। এটিসির অনুমতি নিয়ে এগিয়ে যাই রানওয়ের দিকে। তারপর পাওয়ার অন, স্যারের কমান্ড V1, Rotate ! একসময় নিজেকে আবিষ্কার করি আমি আমার স্বপ্ন নিয়ে আকাশে।
প্রশ্ন : শুরু থেকে এখন পর্যন্ত কতো ঘণ্টা ফ্লাই করেছেন? দীর্ঘ এই অভিজ্ঞতাটা যদি আমাদের সাথে শেয়ার করেন।
পাইলট : শুরু থেকে অদ্যাবধি বিভিন্ন এয়ারক্রাফট মিলিয়ে আমি প্রায় ১৪ হাজার ৫০০ ঘণ্টা ফ্লাইং করেছি। এর মধ্যে রয়েছে সেসনা-১৫০, ফোকার -২৮, এয়ারবাস-৩১০, ডিসি-১০, বোয়িং ৭৭৭, বোয়িং ৭৩৭ এনজি আর এখন ক্যাপ্টেন হিসেবে ফ্লাই করছি বোয়িং ৭৮৭ ফ্লিটে।
প্রশ্ন : এখন পর্যন্ত আপনার সবচেয়ে রোমাঞ্চকর যাত্রা কোনটি? বিমান চালাতে গিয়ে সবচেয়ে আনন্দের এবং সবচেয়ে কষ্টকর অভিজ্ঞতা যদি শেয়ার করেন।
পাইলট : আমার প্রথম সলো পেয়েছিলাম ফিলিপাইনের ম্যানিলাতে। সেদিন সকাল সকাল আমার ফ্লাইং শিডিউল ছিল। ক্যাপ্টেন রে ডেলা ক্রুজকে সাথে নিয়ে একটা সার্কিট করার পর শুনলাম ক্যাপ্টেন টাওয়ারের সাথে স্থানীয় ভাষায় কি যেন বললেন। অতঃপর আমাকে বললেন STOP THE AIRCRAFT. থামার পর উনি দরজা খুলে প্লেন থেকে নেমে পড়লেন। আর যাবার সময় বলে গেলেন Good Luck . বুঝতে পারলাম আমি সলো ফ্লাইং করতে যাচ্ছি। এটিসির অনুমতি নিয়ে টেইক অফ করলাম। পাশের সিটে কেউ বসা নেই। মানে আমি কারো কোনো সাহায্য ছাড়াই ফ্লাই করছি। এ যেন এক নতুন রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা, যা ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না, আর প্রতিটি নবীন বৈমানিকেরই তা অভিষ্ট লক্ষ্য।
প্রশ্ন : পেশাগত কাজের জন্য অনেক সময় পরিবার-পরিজন থেকে দূরে ঈদ করতে হয়-সেই অভিজ্ঞতাটা জানতে চাই।
পাইলট : পেশাগত কারণেই বৈমানিকদের শুক্র-শনিবার সরকারি ছুটি, ঈদ পয়লা বৈশাখ ইত্যাদি দিনগুলোতে পরিবার-পরিজন থেকে দূরে বিভিন্ন দেশে অবস্থান করতে হয়। প্রবাসীদের দেশে আনন্দ উদযাপনের সুযোগ করে দিতেই বৈমানিককে অবস্থান করতে হয় বিদেশের মাটিতে। বিদেশ বিভূঁইয়ে ঈদের দিনটিও তার কাছে হয়ে যায় বৎসরের অন্যান্য দিনের মতই। দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে আমাকেও জীবনের বহু ঈদ দেশের বাইরে করতে হয়েছে। ঈদের দিনে সাধারণত ঈদের নামাজ আদায় করে সহকর্মীদের সাথে সালাম কোলাকুলি কুশল-বিনিময় করে হোটেলে ফিরে টেলিফোনে পরিবার-পরিজন বন্ধু বান্ধবদের সাথে ঈদের শুভেচ্ছা বিনিময় করা হয়। অথবা অনেক সময়ই প্রবাসী বাংলাদেশি আত্মীয়স্বজন বা পরিচিত মহলে গিয়ে তাদের সাথে ঈদের আনন্দ শেয়ার করেছি।
প্রশ্ন : কোনো জরুরি পরিস্থিতিতে বিমান পরিচালনার অভিজ্ঞতা আছে কি? থাকলে যদি শেয়ার করতেন?
পাইলট : আমি তখন এয়ারবাস ৩১০ এর ফার্স্ট অফিসার। একবার শীতের দুপুরে ক্যাপ্টেন হাসান ইমাম এবং আমি দুবাই থেকে লন্ডন যাচ্ছিলাম। ইরানের আকাশসীমার শেষ দিকে হঠাৎ করে ক্লিয়ার এয়ার টার্বুলেন্সে পরি। হঠাৎ লক্ষ করলাম আমাদের উড়োজাহাজের এক নম্বর ইঞ্জিন অয়েল কোয়ান্টিটি স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক নিচে নেমে এসেছে এবং ECAM-Electronic Centralised Aircraft Monitoring তা ফ্লাশ করছে। ক্যাপ্টেন হাসান ইমামের নির্দেশে সাথে সাথেই চেকলিস্ট বের করে দেখলাম অয়েল কোয়ান্টিটি এর চেয়ে কমে গেলে precautionary engine shut down করতে হবে। উড়োজাহাজ তখন তুরস্কের আকাশে। ক্যাপ্টেন আর আমি নিজেদের মধ্যে সিমুলেট করে নিলাম কে কি করবো সেটা নিয়ে। কেবিন ইনচার্জকে ক্যাপ্টেন ককপিটে ডেকে জাহাজের অবস্থা, আমাদের করণীয় এবং তাকে আনুষাঙ্গিক নির্দেশনা দিলেন। ককপিটে পিন পতন নিস্তব্ধতা। নীরবতা ভেঙে আমি হঠাৎ বললাম ‘আমরা ইনশাল্লাহ এই উড়োজাহাজ নিয়ে লন্ডনেই ল্যান্ডিং করবো’। উড়োজাহাজের তখনকার পরিস্থিতিতে হয়তো তা সুদূর পরাহতই ছিল। ক্যাপ্টেন আমার দিকে তাকিয়ে শুধু একটু বাঁকা হাসি দিলেন। বিশ্বাস করুন, সর্বশক্তিমান আল্লাহর অশেষ মেহেরবানীতে ইঞ্জিন অয়েল কোয়ান্টিটিতে আর কোনো পরিবর্তন হয়নি। যদিও আমরা বাকিটা পথ প্রস্তুত ছিলাম যে কোনো অপ্রীতিকর পরিস্থিতি মোকাবিলা করার জন্য তথাপি যাত্রী তথা উড়োজাহাজের নিরাপত্তার সাথে সামান্য কম্প্রোমাইজ না করেই আল্লাহর রহমতে নির্দিষ্ট সময়ে লন্ডন হিথ্রো বিমানবন্দরে নিরাপদে অবতরণে সমর্থ হই।
প্রশ্ন : নতুনদের জন্য বলবেন কী, একজন শিক্ষার্থীকে পাইলট হতে হলে, তাকে কী কী ধাপ অনুসরণ করতে হবে?
পাইলট : একজন শিক্ষার্থীকে পাইলট হতে হলে প্রথমেই লক্ষ্য স্থির করতে হবে। বাংলাদেশে একজন প্রশিক্ষণার্থী পাইলটের সর্বনিম্ন বয়স ১৭ হতে হয়। এইচএসসি বা সমমানের পরীক্ষায় পদার্থবিদ্যা ও গণিত থাকা আবশ্যকীয়। তাকে ইংরেজিতে পারদর্শী হতে হবে। ক্লাস -১ মেডিকেল সার্টিফিকেট অর্জন করতে হবে। ফ্লাইং একাডেমিতে ভর্তির পর ফ্লাইং সংশ্লিষ্ট কিছু বিষয়ে গ্রাউন্ড কোর্স করার পর সিভিল এভিয়েশনের পরীক্ষায় পাশ করতে হয়। নির্দিষ্ট সংখ্যক ঘণ্টা ফ্লাইং করার পর পরীক্ষা দিয়ে প্রথমে পিপিএল এবং পরবর্তীতে সিপিএল অর্জন করতে হয়।
প্রশ্ন : এই পেশা কতটুকু চ্যালেঞ্জিং আপনি মনে করেন? আগামী দিনের পাইলটদের জন্য যদি কোনো পরামর্শ দিতে চান।
পাইলট : পাইলট বা এভিয়েশন সম্পর্কিত সকল চাকরিই দুনিয়া জোড়া অত্যন্ত আকাঙ্ক্ষিত। অন্যান্য সকল চাকরির মতই এখানে রয়েছে নানা ধরনের চ্যালেঞ্জ। তবে স্থির থাকলে যে কোনো ধরনের চ্যালেঞ্জই ওভারকাম করা যায়। পাইলটদের প্রতিদিনই ভিন্ন ধরনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হয়। আর এজন্য তাকে সবসময়ই শারীরিক ও মানসিকভাবে সুস্থ হতে হয়। বেসিক ফ্লাইং, আবহাওয়া, ইন্সট্রুমেন্ট সম্পর্কে সম্যক ধারণা থাকতে হয়। ফ্লাইং একাডেমির একজন প্রশিক্ষণার্থীর ফ্লাইং সম্পর্কে গুণগত পড়াশোনা, তার বেসিক ফ্লাইং পরবর্তীতে এয়ারলাইন্সে কর্মজীবনে সহায়ক হয়।
বিডি প্রতিদিন/এমআই