গুমের প্রতিটি ঘটনা গা শিউরে ওঠার মতো মন্তব্য করে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, নির্মমতা ও নিষ্ঠুরতার এই চিত্র মানুষের কাছে তুলে ধরতে হবে। এটা ঘিরে শুধু বাংলাদেশ নয়, বৈশ্বিকভাবেও আগ্রহ রয়েছে। প্রতিবেদনটি ওয়েবসাইটে ও বই আকারে প্রকাশের ব্যবস্থা করতে হবে। ঘটনাগুলো নিয়ে একটি হরর মিউজিয়াম হওয়া উচিত। গতকাল গুম-সংক্রান্ত তদন্ত কমিশনের দ্বিতীয় অন্তর্বর্তীকালীন প্রতিবেদন হাতে পাওয়ার পর তিনি এ মন্তব্য করেন।
বেলা ১১টায় রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় কমিশন প্রধান বিচারপতি মঈনুল ইসলাম চৌধুরীর নেতৃত্বে কমিশনের সদস্যরা প্রধান উপদেষ্টার কাছে এ প্রতিবেদন জমা দেন। সদস্যদের মধ্যে নূর খান, সাজ্জাদ হোসেন এবং নাবিলা ইদ্রিস উপস্থিত ছিলেন। অন্যান্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন উপদেষ্টা আদিলুর রহমান খান, জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা খলিলুর রহমান ও প্রধান উপদেষ্টার মুখ্য সচিব সিরাজ উদ্দিন মিয়া। গুম কমিশনের প্রতিবেদনে উঠে এসেছে নিষ্ঠুরতার ভয়াবহ চিত্র। সবচেয়ে বেশি অভিযোগ এসেছে র্যাবের গোয়েন্দা শাখার বিরুদ্ধে। কীভাবে ভিকটিমদের ধরে নেওয়া হতো, কীভাবে মারা হতো তার ভয়াবহ বর্ণনা উঠে এসেছে প্রতিবেদনে। কখনো নৌকায় নিয়ে গিয়ে হত্যার পর পেট কেটে সিমেন্ট ভরে নদীতে ফেলে দেওয়া হতো, কখনো গুলি করে বা ইনজেকশন দিয়ে হত্যা করা হতো। বস্তায় ভরে ফেলে দেওয়া হতো ট্রেন লাইনে। ট্রেনের চাকায় ভিক্টিমের শরীর ছিন্নভিন্ন হয়ে যেত। অনেক সময় চলন্ত গাড়ির সামনে ফেলে দেওয়া হতো। সবকিছু শুনে অধ্যাপক ইউনূস বলেন, ‘কী ভয়াবহ একেকটি ঘটনা! আমাদের সমাজের ‘ভদ্রলোকেরা’, আমাদেরই আত্মীয়-পরিজনরা এই ঘটনাগুলো ঘটিয়েছে। এসব তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে একটি হরর মিউজিয়াম হওয়া উচিত। গা শিউরে ওঠার মতো ঘটনা। এই ধরনের বন্দিশালা কেমন হয়, তিন ফিট বাই তিন ফিট খুপড়ির মধ্যে দিনের পর দিন, মাসের পর মাস আটকে থাকার নির্মমতা, নিষ্ঠুরতার চিত্র মানুষের কাছে তুলে ধরা উচিত। প্রধান উপদেষ্টা কমিশন সদস্যদের কাছে প্রতিবেদনের আশু করণীয়গুলো চিহ্নিত করে কোনটি কোন মন্ত্রণালয়ের আওতায় পড়ছে তা সুনির্দিষ্ট করে দেওয়ার নির্দেশনা দেন।
গতকাল সমসাময়িক ঘটনাবলি নিয়ে রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম বলেন, গুমের শিকার তিন শতাধিক মানুষ এখনো নিখোঁজ রয়েছেন। নিখোঁজ শেষ মানুষটির অবস্থা ও অবস্থান না জানা পর্যন্ত কমিশন কাজ চালিয়ে যাবে। কমিশনের কাছে এখন পর্যন্ত ১ হাজার ৮৫০টি অভিযোগ এসেছে। তার মধ্যে ১ হাজার ৩৫০টি অভিযোগ যাচাইবাছাই শেষ হয়েছে। এখনো অভিযোগ আসছে। কমিশন সদস?্যরা জানিয়েছেন, অভিযোগের সংখ্যা সাড়ে তিন হাজার ছাড়িয়ে যেতে পারে। সবকিছু শুনে অধ্যাপক ইউনূস এই ভয়াবহতা নিয়ে একটা হরর মিউজিয়াম হওয়া উচিত বলে মন্তব্য করেছেন। গণভবনে জুলাই অভ্যুত্থান নিয়ে যে মিউজিয়াম করা হচ্ছে, তার একটা অংশে হরর মিউজিয়াম করা হবে। শফিকুল আলম বলেন, যারা পুলিশে আছেন, তারা পিপিএম, বিপিএম-এর মতো অ্যাওয়ার্ড পেতে, ভালো পোস্টিং বা পদোন্নতির জন্য এই কাজগুলো করেছেন। র্যাবের গোয়েন্দা শাখা ছিল গুমের পেছনে মূল কালপ্রিট। কিলার ফোর্স। তারা গুমে সবচেয়ে বেশি জড়িত ছিল। অনেকে করতে চাননি। দুজন অফিসার লিখিতভাবে এ থেকে পরিত্রাণ চেয়ে চিঠিও লিখেছিলেন। চিঠিগুলো গণভবনে পাওয়া গেছে। গুমের সঙ্গে জড়িতদের বিচার এই মাটিতে হবে। শফিকুল আলম বলেন, অধ্যাপক ইউনূস ৯-১৩ জুন যুক্তরাজ্য সফর করবেন। সেখানে তিনি কিং চার্লস দ্য থার্ড হারমোনি অ্যাওয়ার্ড পাবেন। অ্যাওয়ার্ড অনুষ্ঠানের আগে কিং চার্লসের সঙ্গে অধ্যাপক ইউনূসের একটি বৈঠক হবে। এসব নিয়ে আলোচনা করতে গতকাল ব্রিটিশ হাইকমিশনার অধ্যাপক ইউনূসের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন।