একটি পুরোনো বিষয় দিয়েই লেখাটা শুরু করছি। গত ৫ মে জনপ্রিয় তারকাদের অংশগ্রহণে সেলিব্রিটি চ্যাম্পিয়নস ট্রফি-২০২৫-এর উদ্বোধন হয়। মূলত সেলিব্রিটিদের নিয়ে ক্রিকেট লিগ একটি বিনোদনমূলক খেলা। উদ্দেশ্য খেলাধুলার প্রসার ঘটানোর জন্য শিল্পীদের মাঠে একত্র করা। এখানে অংশগ্রহণ করেন কিছু পরিচিত ও অপরিচিত মডেল ও অভিনেত্রী। ক্রিকেট খেলার চেয়ে দর্শকদের দৃষ্টি কাড়ে কিছু মডেল ও অভিনেত্রীর অদ্ভুত সব অঙ্গভঙ্গি ও অশোভন চিত্র। কিছুদিন আগে ইউটিউব আর রিলজুড়ে ভেসে বেড়িয়েছে সেলিব্রিটিদের ক্রিকেট খেলার এসব খণ্ডিত চিত্র। অনেকেই এ খেলাটিকে অশ্লীলতা প্রদর্শনীর জন্য দায়ী করেছেন। যা নিয়ে পরবর্তী সময়ে অনেক আলোচনা-সমালোচনা হয়। একটি অনলাইন পত্রিকা লিখেছে, এটি হয়ে উঠেছে একধরনের গ্ল্যামার শো। যেখানে অশ্লীলতা, বেহায়াপনা ও অপসংস্কৃতি চর্চাই ছিল মুখ্য।
বল বা ব্যাটিং করার দৃশ্যের চেয়ে মাঠজুড়ে কে কী করছেন, কীভাবে হাঁটছেন, দৌড়াচ্ছেন, শারীরিক কসরত করছেন-এসব দৃশ্য নিয়েই মাঠের মিডিয়া ক্যামেরা ও মোবাইল ফোনগুলো ছিল ব্যস্ত। সোশ্যাল মিডিয়ায় এসব চিত্র দেখে অনেকেই বিভিন্ন ধরনের নেতিবাচক মন্তব্য করেছেন। তার মধ্যে একটি মন্তব্য তুলে ধরা প্রয়োজন মনে করছি। মন্তব্যটি লিখেছেন মোহাম্মদ রানা-“আশ্চর্য লাগে, আমরা নিজেদের ‘শিক্ষিত সমাজ’ বললেও কার্যত অশিক্ষার প্রতিচ্ছবি হয়ে উঠেছি। মেয়েরা যখন নিজেদের অশালীনভাবে উপস্থাপন করে, সেটি যেমন দুঃখজনক, তেমনি আরও ভয়াবহ হলো, সেই দৃশ্যগুলোকে মিডিয়া এবং কিছু তথাকথিত ‘সাংবাদিক’রা উসকে দিচ্ছে, প্রচার করছে। একসময় যাদের কাজ ছিল সমাজের সঠিক চিত্র তুলে ধরা, আজ তারাই অশ্লীলতার বাহক হয়ে উঠেছে শুধু দর্শকসংখ্যা বাড়ানোর লোভে। প্রশ্ন হচ্ছে, এটা কি সাংবাদিকতা, নাকি জনপ্রিয়তার নামে নৈতিকতা বিসর্জনের প্রতিযোগিতা? মিডিয়ার দায়িত্বশীলতা এখন প্রশ্নবিদ্ধ। সংবাদ প্রচারের নামে অশ্লীলতা ছড়িয়ে তারা যেমন সমাজের মানসিকতা ধ্বংস করছে, তেমনি ভবিষ্যৎ প্রজন্মের মূল্যবোধকেও ঝুঁকিতে ফেলছে। সময় এসেছে-এই ভণ্ড শিক্ষিতদের মুখোশ উন্মোচনের।”
শুধু মোহাম্মদ রানাই নন, আরও অনেকেই এ ধরনের মন্তব্য করে এসব অশ্লীলতার প্রতিবাদ করেছেন। শুধু তা-ই নয়, এ সেলিব্রিটি ক্রিকেট লিগে অশ্লীলতার দায়ে ৯ জন সেলিব্রিটিকে লিগ্যাল নোটিসও দেওয়া হয়েছে, যা ইতোপূর্বে আমাদের দেশে কখনো হয়নি। এ সম্পর্কে বাড়তি মন্তব্যের প্রয়োজন আছে বলে মনে করি না। যাদের উদ্দেশে রানা এই মন্তব্য করেছেন আশা করি তাদের বোধোদয় হবে। তবে শালীনতা, সংযম, শিষ্টাচার কাউকে জোর করে শিখিয়ে দেওয়া যায় না। এটা অন্তরে ধারণ করতে হয়, যার জন্য পারিবারিক শিক্ষা প্রয়োজন।
ইদানীং আরেকটি বিষয় লক্ষ করা যায়-ফেসবুক, টিকটক, ইউটিউবে কিছু কিছু শিল্পী ব্যক্তিগত বিষয় ছাড়াও একান্ত ব্যক্তিগত পরিবেশে ‘ইনফরমাল’ অবস্থায় তোলা ছবি ও ভিডিও পোস্ট করছেন। শুধু তা-ই নয়, কোনো ছবি মুক্তি পেলে সদলবলে সিনেমা হলে আনন্দ-উৎসব করতে গিয়ে তাদের বিভিন্ন অভিব্যক্তি, চলাফেরা, কথাবার্তা, একে অন্যের সঙ্গে শুভেচ্ছাবিনিময় সবকিছুই মিডিয়ায় দেখা যায়।
কিছু কিছু ক্ষেত্রে মনে হয় ছবির দর্শকদের চেয়ে তাদের উচ্ছ্বাসটাই যেন বেশি। এসব ক্ষেত্রে শিল্পীদের আরও সতর্ক হওয়া প্রয়োজন। কারণ তাদের চারপাশে শত শত ক্যামেরা ঘুরছে। ভিউ বাড়ানোর প্রতিযোগিতায় তারা এমন সব ছবি আপলোড করছেন, যা হয়তো শিল্পী নিজেও জানেন না। এসব ভিডিওর নিচে শত শত মানুষ বিভিন্ন মন্তব্য করছেন। মাঝে মাঝে প্রশ্ন জাগে-এসব কি শিল্পীরা পড়েন না? তেমনই একটি মন্তব্য এখানে তুলে ধরছি। তামান্না জাহারা নামে এক নারী তার ফেসবুকে লিখেছেন-‘শিল্পীরা কেন সিনেমা হলে গিয়ে এমন আচরণ করছেন? তারা কি আমাদের প্রবীণ শিল্পীদের দেখেও কিছু শিখেননি? আমরা কি কখনো শাবানা-ববিতা-রাজ্জাক-কবরী-গোলাম মুস্তাফা-আনোয়ার হোসেনকে এভাবে ছবি রিলিজের পর পাবলিকলি গলাগলি, জড়াজড়ি করতে দেখেছি? শিল্পীরা আমাদের কাছে স্বপ্নের মতো। আমরা অর্থ দিয়ে স্বপ্ন দেখতে যাই। কিন্তু স্বপ্ন দেখা মানুষগুলো যদি এতটা সস্তা হয়ে যায় তাহলে তাদের পয়সা দিয়ে হলে গিয়ে দেখব কেন? ইউটিউব-ফেসবুকে দেখাই ভালো। রিলস আর ফেসবুকে দেখা যায়-শিল্পীরা প্রশংসা করতে গিয়ে একজন আর একজনকে জড়িয়ে ধরছে। কী নারী, কী পুরুষ কোনো বাছবিচার নেই। যা অবশ্যই দৃষ্টিকটু। মনে হলো মিডিয়ার ডজন ডজন মাইক্রোফোন দেখে অনেকেই খেই হারিয়ে ফেলেছেন। দুই-একটা ছবি করেই এ অবস্থা, রাজ্জাক-শাবানার মতো শত শত হিট ছবির নায়ক-নায়িকা হলে এরা কী করবেন? মনে রাখবেন, আপনারা এখনো অতবড় তারকা হননি। আপনাদের ছবি মাল্টিপ্লেক্সের কয়েক শ বিশেষ শ্রেণির দর্শকের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। কিন্তু তাদের ছবি ছিল সারা দেশের হাজার হাজার সিনেমা হলের লাখ লাখ দর্শকের কাছে প্রিয়। যার কিছুটা রেশ শাকিব খানের মধ্যে আছে। সে কারণেই তাকে মেগাস্টার বলা হয়। কই তাকে তো সিনেমা হলে গিয়ে এতটা লাফালাফি করতে দেখা যায় না।’ দর্শকের এ মন্তব্যের পরে এ বিষয়ে আর কিছু লিখতে চাই না। তবে এসব ব্যাপারে আমাদের একটু বেশি সতর্ক ও সচেতন থাকা প্রয়োজন।
শেষ করব শিল্পীদের রাজনীতি নিয়ে। আমি তিন যুগ ধরে একটি চ্যানেলেই অর্থাৎ বিটিভিতেই অনুষ্ঠান করছি। প্রতিবারই সরকার পতনের পর কিছু শিল্পীকে তথাকথিত কালোতালিকাভুক্ত করা হয়। এটি বাংলাদেশ টেলিভিশনের একটি অলিখিত নিয়ম। যেহেতু বাংলাদেশ টেলিভিশন সরকারি মাধ্যম, তাই যখন যে সরকার আসে সেই সরকারই এ চ্যানেলটিকে নিজের মতো ব্যবহার করে। অর্থাৎ বিটিভি যখন যার তখন তার। এসব কারণেই আমার অনুষ্ঠানে শিল্পী নির্বাচন করতে গিয়ে বিভিন্ন সময় আমিও মাঝে মাঝে তাদের অলিখিত নিয়মে পড়ে যাই। ৩৭ বছরে আমি বেশ কয়েকটি রাজনৈতিক সরকারসহ তত্ত্বাবধায়ক সরকার দেখেছি। গত সরকারের আমলে যারা একটু বেশি বেশি সরকারের কাছাকাছি ছিলেন, সক্রিয়ভাবে রাজনীতিতে জড়িত ছিলেন, বর্তমানে তাদের বিটিভির কোনো অনুষ্ঠানে দেখা যায় না। যেহেতু নিষিদ্ধ শিল্পীদের কোনো তালিকা নেই, তাই আমি আমার অনুষ্ঠানের প্রয়োজনে যে কোনো শিল্পীকেই নির্বাচন করি। যে কারণে অনুষ্ঠান প্রিভিউর সময় প্রায়ই আমি শিল্পী এবং সেই শিল্পীর অভিনীত পর্বটি নিয়ে সমস্যায় পড়ি। টিভি কর্তৃপক্ষ অপারগতা প্রকাশ করায় মন্ত্রী পর্যন্ত যেতে হয়েছে। গত ঈদের অনুষ্ঠানেও একই ঝামেলায় পড়েছিলাম। ৩৭ বছরের ইত্যাদির জীবনে এরকম তিক্ত অভিজ্ঞতা বহুবারই হয়েছে।
শিল্পীদের রাজনীতি করা নিয়ে অনেক আলোচনা-সমালোচনা রয়েছে। বেশির ভাগ শিল্পীই মনে করেন, শিল্পীরা অবশ্যই রাজনীতিসচেতন হবেন কিন্তু কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত হয়ে সক্রিয় রাজনীতিতে ভূমিকা রাখবেন না। অর্থাৎ শিল্পীদের রাজনৈতিক দর্শন থাকবে, কিন্তু সক্রিয় অংশগ্রহণ থাকবে না। আর সেটা করতে চাইলে শিল্পীজীবনের ইতি ঘটিয়ে রাজনীতিতে যোগ দিতে হবে। মূলত শিল্পীদের এ রাজনীতিতে জড়ানোর প্রবণতা গত দেড় দশকে বেশ বেড়েছে।
আমাদের দেশে কেউ চাপে পড়ে, কেউ সুযোগসুবিধা পাওয়ার জন্য, কেউ ক্ষমতার কাছাকাছি থাকার জন্য রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হন এবং অতি উৎসাহী ভূমিকা পালন করেন।
যিনি আদর্শ শিল্পী তিনি কখনোই কোনো রাজনৈতিক দলের লেজুড়বৃত্তি করেন না। পত্রিকায় এবং সোশ্যাল মিডিয়ার তথ্য অনুযায়ী গেল ১৫ বছরে অনেক শিল্পীকেই সরাসরি রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে জড়িত হতে দেখা গেছে। শুধু তা-ই নয়, দুই-একজনকে নিজ নিজ জেলায় গিয়ে দলীয় কর্মীর মতো ভোট ভিক্ষার পাশাপাশি স্থানীয় প্রার্থীর পক্ষে ভোটসভায় ভাষণ দিতেও দেখা গেছে। এসব করে অনেকে যেমন বিভিন্ন সুযোগসুবিধা লাভ করেছেন, তেমনি শিল্পী মহলে সমালোচিতও হয়েছেন।
দলমতনির্বিশেষে শিল্পীরা সবার কাছেই প্রিয়। এ দেশে যেহেতু নানা মতাদর্শে বিভিন্ন দল এবং তাদের সমর্থক রয়েছে, তাই কোনো রাজনৈতিক দলের এজেন্ডা বাস্তবায়নে শিল্পীদের ভূমিকা থাকা উচিত নয়। শিল্পীকে হতে হবে নিরপেক্ষ ও সর্বজনীন।
অনেকেই উদাহরণ দিতে গিয়ে বিদেশি শিল্পীদের রাজনীতিতে অংশগ্রহণের বিষয়টি তুলে ধরেন। বিদেশের রাজনীতি আর এ দেশের রাজনীতি এক নয়। সেখানে মিটিং-মিছিলে অভিভাবক নিজে বা স্ট্রলারে করে শিশুদেরও নিয়ে যান। ওখানে সাউন্ড গ্রেনেডের ভয় থাকে না। লাঠিচার্জও করা হয় না। একে অন্যকে অশ্রাব্য ভাষায় গালাগালি কিংবা মারামারিও করেন না। শুনতে হয় না কোনো মারমুখী সেøাগান।
ভারতে অভিনেতা অমিতাভ বচ্চন, প্রয়াত রাজেশ খান্না, সুনীল দত্তদের মতো অভিনেতারা জনপ্রিয়তা এবং গ্রহণযোগ্যতার সুবাদে কংগ্রেসের হয়ে নির্বাচন করে সংসদ সদস্যও হয়েছেন। তাদের ব্যক্তিত্বে দল উজ্জ্বলতর হয়েছে। তারা রাজনীতি করেছেন কিছু পাওয়ার জন্য নয়, দেশকে কিছু দেওয়ার জন্য। আর ট্রাম্পের মতো মানুষকে সমালোচনা করে অভিনেতা জর্জ ক্লুনি, গায়িকা টেইলর সুইফটসহ আরও অনেকেরই কোনো সমস্যা হয়নি। হামলার শিকার হননি। দেশ ছাড়তেও হয়নি। সুতরাং বিদেশে শিল্পীরা যে কোনো সরকারের পক্ষে-বিপক্ষে নির্ভয়ে মতামত প্রকাশ করতে পারেন কিন্তু আমাদের দেশে সেটা সম্ভব নয়। এখানে রাজনৈতিক নেতারা শিল্পীদের জনপ্রিয়তাকে পুঁজি করে তাদের বিতর্কিত করে তোলেন। ফলে দেশব্যাপী ভক্ত ও শুভাকাক্সক্ষীদের কাছে তাদের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয়। ঘটে অনেক অনাকাক্সিক্ষত ঘটনাও।
সময়ের পরিবর্তনে অনেকেই প্রতিপক্ষের হামলার শিকার হন। পত্রিকায় সংবাদ ছাপা হয় শিল্পীর ওপর হামলা। ফলে ‘শিল্পী’ শব্দটির সম্মান ও ভাবমূর্তিও ক্ষুণ্ন হয়। কারণ যারা রাজনীতির ঊর্ধ্বে কিংবা সক্রিয় রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত নন, শিল্পীর পাশে এ ‘হামলা’ শব্দটি সবাইকে আহত করে।
শিল্পীরা দেশের সম্পদ। তাদের কর্মকাণ্ডে দেশের ভাবমূর্তিও উজ্জ্বল হয়। শিল্পীদের সবাই ভালোবাসেন আর তাই তাদের সুসংবাদে ভক্তরা আনন্দিত হন। দুঃসংবাদে হন ব্যথিত। সেজন্যই আমাদের দেশে রাজনীতির ব্যাপারে খুব সতর্ক সিদ্ধান্ত নিতে হয়। কারণ রাজনীতি এমনই একটি বিষয় যেখানে শেষ কথা বলে কিছু নেই। ফলে লঘু পাপে কেউ গুরু দণ্ড পাচ্ছেন, আর রাজনীতির চক্রে চরিত্র পাল্টে গুরু পাপেও কেউ পুরস্কৃত হচ্ছেন। তবে সাধারণ মানুষ সবাইকে চেনেন। সবকিছুই দেখেন, বোঝেন। তাই নাটকের চরিত্রের মতো তাদের প্রকৃত চরিত্রও অন্তরে গেঁথে রাখেন।
লেখক : গণমাধ্যমব্যক্তিত্ব