যুক্তরাষ্ট্রের ধর্মীয় স্বাধীনতাবিষয়ক আন্তর্জাতিক কমিশনের (ইউএসসিআইআরএফ) প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে আসন্ন জাতীয় নির্বাচন ঘিরে ধর্মীয় উসকানিমূলক সহিংসতার ঝুঁকি বাড়ছে। হিন্দু, আদিবাসী, আহমদিয়া ও সুফি সম্প্রদায়ের মানুষ এখনো বৈষম্যের শিকার। তবে এখন পর্যন্ত এ ধরনের সহিংসতা মোকাবিলায় সরকার কোনো সুসংগঠিত কৌশল উপস্থাপন করতে পারেনি। সোমবার ইউএসসিআইআরএফ প্রকাশিত প্রতিবেদনে এসব তথ্য জানিয়েছে।
চলতি বছরের মে মাসে ঢাকা সফরে আসে যুক্তরাষ্ট্রের ধর্মীয় স্বাধীনতাবিষয়ক কমিশনের একটি প্রতিনিধিদল। তারা সুশীল সমাজ ও সরকারি কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক এবং বাংলাদেশের ধর্মীয় স্বাধীনতা পরিস্থিতি সরেজমিন পর্যালোচনা করেন। এসব পর্যালোচনা উঠে এসেছে সম্প্রতি প্রকাশ হওয়া সংস্থাটির এ প্রতিবেদনে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, গত বছরের জুলাইয়ে শিক্ষার্থীদের নেতৃত্বে রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে গঠিত অন্তর্বর্তী সরকার নতুন সংস্কারের উদ্যোগ নিলেও ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের অবস্থা খুব বেশি বদলায়নি। সরকার ধর্মীয় স্বাধীনতার অঙ্গীকার করলেও বিভিন্ন গোষ্ঠীর মানুষ নিজেদের বিশ্বাস প্রকাশে নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। সরকারের প্রস্তাবিত একাধিক সংবিধান সংশোধন, প্রশাসনিক সংস্কার ও আইনি পরিবর্তনের মধ্যেও ধর্মীয় সম্প্রদায়গুলোর মধ্যে বিভাজন ও উত্তেজনা এখনো স্পষ্ট।
এতে আরও বলা হয়, সরকার পতনের পর ৫ থেকে ৮ আগস্টের মধ্যে মোট ১ হাজার ৭৬৯টি সহিংস ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে ২০টি ছিল সাম্প্রদায়িক হামলা। তবে অনেক ঘটনার পেছনে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য ছিল। সরকার ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর হামলার নিন্দা জানালেও জবাবদিহি নিশ্চিতে ব্যর্থ হচ্ছে। এর পেছনে আংশিকভাবে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর দুর্বলতাকেই দায়ী করা হয়েছে।
সংস্থাটি জানায়, অন্তর্বর্তী সরকার সংবিধান সংস্কারের প্রস্তাবে ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ শব্দটি বাদ দিয়ে ‘বহুসংস্কৃতিবাদ’ বা ‘বহুত্ববাদ’ যুক্ত করার চিন্তা করেছে; যা ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের অধিকারের পক্ষে হুমকি হতে পারে। তবে বিএনপি, জামায়াতসহ রাজনৈতিক দলগুলো এ বিষয়ে এখনো একমত হয়নি। ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের অভিযোগ, এ সংস্কার প্রক্রিয়ায় তারা অন্তর্ভুক্ত নয় এবং রাজনৈতিক ও রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে তাদের প্রতিনিধিত্ব অত্যন্ত সীমিত।
অন্যদিকে নারী সংস্কার কমিশন থেকে নারীর অধিকার ও বৈষম্য দূরীকরণে ৪৩৩টি সুপারিশ করা হয়েছে। কিন্তু হেফাজতে ইসলাম এসব প্রস্তাব ইসলামবিরোধী আখ্যা দিয়ে বিক্ষোভ করেছে। বিশেষ করে ধর্মীয় পারিবারিক আইনের পাশাপাশি একটি সিভিল কোড প্রবর্তনের প্রস্তাব ব্যাপক বিতর্কের সৃষ্টি করে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশের সংবিধানে ধর্মীয় স্বাধীনতা নিশ্চিত করা হলেও দ বিধির ১৯৫এ ধারা ও ২০২৩ সালের সাইবার নিরাপত্তা আইনের কিছু অংশ এখনো এমন আইনি কাঠামো বহাল রেখেছে যেগুলো ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হানার অভিযোগে মামলার সুযোগ তৈরি করে; যা মতপ্রকাশের স্বাধীনতার জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে।
তবে ধর্মীয় স্বাধীনতাসংক্রান্ত আন্তর্জাতিক মানদ রক্ষার জন্য বাংলাদেশ সরকারের ওপর চাপ তৈরিতে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতি প্রণয়নের সুপারিশ করেছে সংস্থাটি। তাদের ভাষ্যমতে, বাংলাদেশ যদি সত্যিকার অর্থে ধর্মীয় বৈচিত্র্য ও সহনশীলতা নিশ্চিত করতে চায়, তাহলে তাকে নীতিগত ও প্রশাসনিক স্তরে আরও শক্ত পদক্ষেপ নিতে হবে।