শনিবার, ২৫ মার্চ, ২০২৩ ০০:০০ টা

তুচ্ছ ঘটনায় বেড়েছে খুনোখুনি

পারিবারিক সামাজিক অপরাধের ভয়াবহতার শেষ নেই

আলী আজম ও মাহবুব মমতাজী

তুচ্ছ ঘটনায় বেড়েছে খুনোখুনি

সাতক্ষীরার দেবহাটায় গত বছরের ২২ জুন স্ত্রীর তালাক নোটিস পেয়ে শ্বশুরকে ঘুমন্ত অবস্থায় কুপিয়ে হত্যার অভিযোগ ওঠে সালাউদ্দিন সানা (২৮) নামে এক যুবকের বিরুদ্ধে। ওই ঘটনার সপ্তাহখানেক পর ঢাকার কেরানীগঞ্জ থেকে তাকে গ্রেফতার করে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। কয়েক বছরে এমন সামাজিক অপরাধের ভয়াবহ চিত্র ফুটে উঠেছে। পুলিশের একটি পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, সারা দেশে তিন কারণে খুনোখুনি বেশি। এর মধ্যে পারিবারিক কলহে খুন ২১ শতাংশের বেশি, সম্পত্তি-সংক্রান্ত বিরোধে ১৩ শতাংশের বেশি এবং পূর্বশত্রুতায় খুন ১০ শতাংশের বেশি। তুচ্ছ ঘটনায় আরেকটি খুনের তথ্য পাওয়া যায় গত বছরের ১৬ জুলাই বগুড়ার গাবতলীতে। স্থানীয় যুবসংঘের উদ্যোগে একটি ফুটবল খেলায় মোতালেব ওরফে খোকন আর নাহিদ নামে দুই যুবক একই দলে খেলছিলেন। তাদের দল ২-১ গোলে পিছিয়ে পড়ে। খেলা শেষ হওয়ার প্রায় এক মিনিট আগে একটি ফাউলে তারা পেনাল্টি শট পান। এর আগে স্ট্রাইকার হিসেবে দলের একমাত্র গোলটি করেছিলেন নাহিদ। খেলায় সমতা আনার জন্য পেনাল্টি শটটিও নাহিদকে দিয়ে করাতে দলের অধিনায়কসহ সবাই একমত হন। কিন্তু খোকন সেই পেনাল্টি শট নেওয়ার জন্য গোঁয়ার্তুমি করতে থাকেন। নাহিদ পেনাল্টি শটের প্রস্তুতি নিলে খোকন তাকে মাঠের মধ্যে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেন ও মারধর করতে থাকেন। তখন নাহিদের ফুফাতো ভাই মামুন এর প্রতিবাদ করেন।

মামুনের সঙ্গে সৃষ্ট এই বিরোধের জেরে তাকে শিক্ষা দেওয়ার পরিকল্পনা করেন খোকন। এরপর স্থানীয় একটি দোকানের সামনে থেকে মামুনকে ধারালো দা দিয়ে কুপিয়ে গুরুতর জখম করেন খোকন। পরদিন ১৭ জুলাই রাতে বগুড়া মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মামুন মারা যান।

সারা দেশে এমন ঘটনা ছিল হাজারের বেশি। ঢাকায় গত বছর খুনের সংখ্যা ছিল ১৭৭টি। ২০২১ সালের তুলনায় ১১টি বেশি ঘটেছে। ওই বছর খুনের সংখ্যা ছিল ১৬৬টি। পুলিশ সদর দফতরের তথ্যে দেখা গেছে, ২০১০ সাল থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত সারা দেশে খুনের ঘটনা ঘটেছে ৪৫ হাজার ১৪৬টি। ২০২১ সালে সারা দেশে হত্যাকাণ্ডের সংখ্যা ৩ হাজার ৪৫৮টি। এর আগের বছর ২০২০ সালে খুনের সংখ্যা ছিল ৩ হাজার ৫৩৯টি। ২০১৯ সালে এ সংখ্যা ছিল ৩ হাজার ৬৫৩।

ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) মামলার তথ্যে দেখা গেছে, ঢাকার ওয়ারী ও মিরপুরে খুনোখুনি বেশি। ঢাকায় গত বছর ১৭৭টি খুনের ঘটনার মধ্যে ৩৭টি হয়েছে ওয়ারীতে, আর ৩১টি মিরপুরে। ২০২১ সালেও ৩৫টি ছিল ওয়ারীতে এবং ২৬টি মিরপুরে। ডিএমপির পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গত বছর ২১টি করে খুনের ঘটনা ঘটে গুলশান ও মতিঝিলে, ১৭টি করে উত্তরা ও লালবাগে, রমনায় ১৬টি এবং তেজগাঁও ১৩টি। ২০২২ এবং ২০২১ অপরাধের তথ্য বিশ্লেষণ করে পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, রাজধানীর যেসব এলাকায় নিম্ন আয় ও ভাসমান মানুষের বসবাস বেশি, সেখানে অপরাধের ঘটনাও বেশি।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহকারী অধ্যাপক তৌহিদুল হক বলেন, তুচ্ছ কারণে যেসব মারামারি হচ্ছে সেগুলোও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর আমলে নেওয়া উচিত। এসব ঘটনায় যারা জড়িত তাদের দ্রুত বিচারের মুখোমুখি করা উচিত। এসব কেন ঘটছে, তা নিয়েও গবেষণা করা দরকার। আর সম্পর্কের অবনতির কারণে একপক্ষ আরেক পক্ষের ওপর হামলা করছে। কোনো এলাকায় এটা বাড়ে, আবার কোনো এলাকায় কমে। কোনো অপরাধের বিচার যদি দ্রুত সময়ে না হয়, তাহলে এ ধরনের অপরাধ বেড়ে যায়।

২০২১ সালে পারিবারিক সহিংসতার ১৪টি ঘটনায় ২২ জন খুন হন। এসব বিষয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা বলছেন, করোনা মহামারিতে দেশে পারিবারিক সহিংসতা বেড়েছে। ২০২০ সালের শেষে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ব্র্যাকের এক জরিপে বলা হয়, করোনার সময়ে যারা পারিবারিক সহিংসতার শিকার হয়েছেন, তাদের ৯১ শতাংশ নারী ও কন্যাশিশু। ৮৫ শতাংশ নির্যাতনকারী ঘরের সদস্য। ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) অতিরিক্ত কমিশনার (ক্রাইম ও অপারেশন) ড. খ. মহিদ উদ্দিন বাংলাদেশ প্রতিদিন বলেন, কোনো ঘটনা ঘটলে মামলা হয়। এরপর অভিযুক্তদের আইনের আওতায় আনা হয়। সামাজিক মূল্যবোধ এবং পারিবারিক মূল্যবোধের অবক্ষয় ও মানুষের চাওয়া-পাওয়া উচ্চমাত্রায় বেড়েছে। যে কারণে তুচ্ছ ঘটনায় খুনোখুনি বেড়েছে। এক্ষেত্রে সবাইকে সচেতন হতে হবে এবং আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে হবে। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) নির্বাহী পরিচালক মো. নূর খান বলেন, দেশে যতক্ষণ অস্থিরতা থাকবে ততক্ষণ পর্যন্ত সামাজিক, পারিবারিক সহিংসতা বাড়বে। জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান ড. কামাল উদ্দিন আহমেদ বলেন, পারিবারিক সহিংসতায় খুনোখুনি খুবই দুঃখজনক। সরকার চেষ্টা করছে এটি নিয়ন্ত্রণের জন্য। একই সঙ্গে এ সহিংসতা কমাতে আইন কঠোর করা হচ্ছে।

সর্বশেষ খবর