বুধবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৩ ০০:০০ টা

শীর্ষ ঋণখেলাপিরা চট্টগ্রামের

৫৫ কোম্পানির খেলাপি প্রায় ৫০ হাজার কোটি টাকা, উদ্বেগ ব্যাংকপাড়ায়

শাহেদ আলী ইরশাদ

শীর্ষ ঋণখেলাপিরা চট্টগ্রামের

ব্যাংক থেকে নেওয়া ঋণের টাকা ফেরত দিচ্ছেন না চট্টগ্রামের ব্যবসায়ীরা। ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোয় চট্টগ্রামের ৫৫ ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের খেলাপি ঋণ প্রায় ৫০ হাজার কোটি টাকা। ঋণের ২০ হাজার কোটি টাকা মেরে বিদেশে পাড়ি জমিয়েছেন অন্তত ৩৩ জন ব্যবসায়ী। টাকা ফেরত না দেওয়ায় উদ্বেগ তৈরি হয়েছে ব্যাংকপাড়ায়।

ব্যাংকাররা জানিয়েছেন, ব্যাংক পরিচালক-উদ্যোক্তাদের সঙ্গে ঋণগ্রহীতাদের সম্পর্ক থাকায় ঋণ দিতে বাধ্য করা হয়েছে কর্মকর্তাদের। ফলে এসব ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে যথাযথ নিয়মনীতি অনুসরণ করেনি ব্যাংক। এভাবে ঋণ নিয়ে অনেকেই আত্মসাৎ করে ব্যাংকগুলোকে বিপদের মুখে ঠেলে দিয়েছেন। অর্থ আদায়ে ঋণদাতা ব্যাংক, বাংলাদেশ ব্যাংক, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে যৌথ উদ্যোগ নেওয়ার দাবি জানিয়েছেন ব্যাংকাররা।

ব্যাংক ও সংশ্লিষ্ট সূত্র জানান, চট্টগ্রামের ১৫ ব্যবসায়ী গ্রুপের খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৯ হাজার ৯৫২ কোটি টাকা। এর মধ্যে সীতাকুণ্ডের শাহ আমানত আয়রন মার্টের গিয়াস উদ্দিন কুসুমের খেলাপি ঋণ ৬০০ কোটি টাকা। লিজেন্ড হোল্ডিংয়ের এস এম আবদুল হাইয়ের খেলাপি ঋণ ৫২৫ কোটি টাকা। বাদশা গ্রুপের মোহাম্মদ ইসা বাদশার কাছে আট ব্যাংকের পাওনা ৫০০ কোটি টাকা। ন্যাম করপোরেশনের কর্ণধার আবদুল আলিম চৌধুরীর কাছে সাত ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের পাওনা ৫০০ কোটি টাকা। নাজমুল আবেদীনের কাছে চার ব্যাংকের পাওনা ৪০০ কোটি টাকা। আলম অ্যান্ড কোংয়ের শাহ আলমের কাছে আট ব্যাংকের পাওনা ৩০০ কোটি টাকা। সিঅ্যান্ডএ গ্রুপের মোহাম্মদ মোর্শেদের কাছে ব্যাংকের পাওনা ২৮০ কোটি টাকা। এমএএফ ইন্টারন্যাশনালের মালিক মাকসুদুল আলমের কাছে চার ব্যাংকের পাওনা ২০০ কোটি টাকা। জাহিদ এন্টারপ্রাইজের পরিচালক জাহিদ হোসেন মিয়ার কাছে বিভিন্ন ব্যাংকের পাওনা ১৮৬ কোটি টাকা। বাগদাদ গ্রুপের মালিক ফেরদৌস খান আলমগীরের কাছে পাঁচ ব্যাংকের পাওনা ১৫০ কোটি টাকা। চট্টগ্রামের ইফফাত ইন্টারন্যাশনালের মালিক দিদারুল আলমের কাছে দুই ব্যাংকের পাওনা প্রায় ১৫০ কোটি। সার্ক ইন্টারন্যাশনালের স্বত্বাধিকারী আনোয়ারুল হক চৌধুরীর কাছে দুটি ব্যাংকের ঋণ ৭১ কোটি টাকা। এনএম ট্রেডিং করপোরেশনের মালিক এবং আল আরাফাহ ইসলামী ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান এস এম শামীম ইকবাল তিন ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়েছেন ৭০ কোটি টাকা। খাতুনগঞ্জের এসএল এন্টারপ্রাইজের মালিক লিয়াকত আলী চৌধুরী বিভিন্ন ব্যাংক থেকে নেওয়া ২০ কোটি টাকা পরিশোধ করছেন না। খাতুনগঞ্জের ইয়াসির এন্টারপ্রাইজের মালিক মোহাম্মদ মোজাহের হোসেন বিভিন্ন ব্যাংক থেকে ১ হাজার ২০০ কোটি টাকার ঋণ নিয়েছেন। কিন্তু পরিশোধ করছেন না। ম্যাক ইন্টারন্যাশনালের মালিকদের কাছে ১২টি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের পাওনা ৮০০ কোটি টাকার বেশি। ৩০ ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কাছে হাবিব গ্রুপের খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৪ হাজার কোটি টাকা।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে ন্যাশনাল ক্রেডিট অ্যান্ড কমার্স (এনসিসি) ব্যাংকের এক্সিকিউটিভ ভাইস প্রেসিডেন্ট আলী তারেক পারভেজ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ব্যাংক পরিচালকরা বেনামে ঋণ নিয়ে যাচ্ছেন। এতে কোনো কোনো ব্যবসায়ী লোকসানে পড়েছেন, আবার কেউ কেউ ইচ্ছাকৃতভাবে ব্যাংক ঋণ শোধ না করে দেশ ত্যাগ করেছেন। এতজন ব্যবসায়ী দেশ ত্যাগ করায় এসব ঋণ উদ্ধারে ব্যাংক কর্মকর্তাদের এখন প্রতিদিন আদালতে দৌড়াতে হচ্ছে। জ্যেষ্ঠ এই ব্যাংকার মন্তব্য করেন, ব্যাংকের টাকা জনগণের আমানত। তাই এ টাকা উদ্ধারে খেলাপিদের দেশে ফেরত আনতে রাষ্ট্রীয়ভাবে উদ্যোগ নিতে হবে।

আরেকটি বেসরকারি ব্যাংকের কর্মকর্তা বলেন, ‘ব্যাংকগুলো এসব ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে যথাযথ নিয়মনীতি অনুসরণ করেনি। এতে কিছু ব্যবসায়ী লোকসানের মধ্যে পড়লেও অন্যরা ইচ্ছা করে অর্থ আত্মসাৎ করে ব্যাংককে বিপদের মুখে ঠেলে দিয়েছেন।’ ঋণ নিয়ে পরিশোধ না করার পাশাপাশি টাকা মেরে বিদেশেও পাড়ি জমিয়েছেন অনেকে। গত এক দশকে চট্টগ্রামের ২২ ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের ৩৩ কর্ণধার প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়ে দেশ ত্যাগ করেছেন। এসব ব্যবসায়ীর মধ্যে ১১ জন বসবাস করছেন কানাডায়। ছয়জন লন্ডনে, চারজন যুক্তরাষ্ট্রে, তিনজন মালয়েশিয়ায়, তিনজন সংযুক্ত আরব আমিরাতে, দুজন তুরস্কে এবং একজন করে অস্ট্রেলিয়া, মন্টেনিগ্রো ও সিঙ্গাপুরে অবস্থান করছেন। বড়সংখ্যক ঋণখেলাপির দেশ ত্যাগ করে বিদেশে বসবাসের ঘটনায় সংকটের মধ্যে পড়েছে চট্টগ্রামের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো। এদের সবার বিরুদ্ধে আর্থিক ও চেক প্রত্যাখ্যান আইনে একাধিক মামলায় গ্রেফতারি পরোয়ানাও রয়েছে। দেশত্যাগের নিষেধাজ্ঞা জারির আগেই ১৩ এবং নিষেধাজ্ঞার পর আরও ১৩ জন বিদেশে পাড়ি জমিয়েছেন। ব্যাংকের ঋণ পরিশোধ না করেই সম্প্রতি দেশত্যাগ করেছেন মাহিন এন্টারপ্রাইজের কর্ণধার আশিকুর রহমান লস্কর। ১০ ব্যাংক থেকে তিনি ঋণ নিয়েছেন ২ হাজার কোটি টাকা। গত বছরের শেষ দিকে দেশ ত্যাগ করেন হাবিব গ্রুপের পাঁচ কর্ণধার। ব্যাংকগুলোর কাছে এই গ্রুপের দেনা ৪ হাজার কোটি টাকার বেশি। নূরজাহান গ্রুপের পরিচালক জহির আহমেদ রতনের কাছে বিভিন্ন ব্যাংকের পাওনা ২ হাজার ৬০০ কোটি টাকার বেশি। মিশম্যাক গ্রুপের কাছে ব্যাংকগুলো পাবে ১ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। ৮০০ কোটি টাকা ঋণ নিয়ে দেশ ছেড়েছেন ইমাম গ্রুপের মালিক মুহাম্মদ আলী। মোস্তফা গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক জহির উদ্দিন ২ হাজার ৫০০ কোটি টাকা ঋণ পরিশোধ না করে কানাডায় পাড়ি জমিয়েছেন। সব মিলিয়ে ৫৫ ব্যবসায়ী গ্রুপের কাছে ব্যাংকগুলোর প্রায় ৫০ হাজার কোটি টাকা আটকে আছে। এ বিষয়ে গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মানীয় ফেলো ড. মোস্তাফিজুর রহমান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, বেনামি ঋণ বিতরণ বন্ধ এবং খেলাপি ঋণ আদায়ে আইনের কঠোর প্রয়োগ করতে হবে। একই সঙ্গে বেনামি ঋণ বিতরণের সঙ্গে জড়িতদের আইনের আওতায় নিয়ে আসতে হবে। তিনি বলেন, এখন বেনামি ঋণ ও কুঋণের কারণে ব্যাংক খাতে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। এটা অর্থনীতির জন্য খুবই ক্ষতিকারক। সুতরাং বাংলাদেশের যেসব প্রচলিত আইন আছে সে মোতাবেক বাংলাদেশ ব্যাংককে স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে এদের আইনের আওতায় নিয়ে আসার দিকে জোর দিতে হবে।

 

সর্বশেষ খবর