রাজধানীসহ সারা দেশে সর্বাত্মক অভিযানের ষষ্ঠ দিনে আরও সহস্রাধিক ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। গত কয়েক দিনে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় ধ্বংসাত্মক তৎপরতায় জড়িতদের গ্রেপ্তারে চলছে এই অভিযান। রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় ব্লক রেইড দিচ্ছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। ঢাকার বিভিন্ন মেস, আবাসিক হোটেল, হামলাকারীদের বাসাবাড়ি ও গোপন আস্তানা টার্গেট করে ব্লক রেইড দেওয়া হচ্ছে। পাশাপাশি বিভিন্ন জেলায় চিরুনি অভিযান চলছে। ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) এডিসি কে এন রায় নিয়তি জানান, সহিংসতার ঘটনায় গতকাল পর্যন্ত ডিএমপিতে ২০৭টি মামলায় ২ হাজার ৫৩৬ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। গোয়েন্দা তথ্য ও সিসিটিভি ফুটেজ বিশ্লেষণ করে প্রতিদিনই জড়িতদের শনাক্ত এবং গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। গত শুক্রবারও ১৭৯ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। এর আগে, ২১ জুলাই ৫১৬ জনকে, ২২ জুলাই ৬০১ জনকে, ২৩ জুলাই ৬৪১ জনকে, ২৪ জুলাই ৪৫১ জনকে এবং ২৫ জুলাই ১৪৮ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়।
এদিকে র্যাব সদর দপ্তরে দায়িত্বরত এএসপি (মিডিয়া) আ ন ম ইমরান খান জানান, সহিংসতার ঘটনায় গত শুক্রবার সারা দেশ থেকে ২৯০ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এর মধ্যে ঢাকায় ৭১ জন এবং ঢাকার বাইরে ২১৯ জন। এর আগে, সারা দেশ থেকে গত বৃহস্পতিবার ২৬৬ জনকে এবং গত বুধবার ২২৮ জনকে গ্রেপ্তার করে র্যাব।
পুলিশ ও র্যাব বলছে, কোটা সংস্কার আন্দোলনের সময় ঢাকাসহ সারা দেশে সরকারি স্থাপনায় ভাঙচুর, সহিংসতা, অগ্নিসংযোগ ও নাশকতায় অংশ নেওয়া ব্যক্তিদের টার্গেট করে প্রতিদিনই চিরুনি অভিযান চলছে। মদদদাতা ও বাস্তবায়নকারীদের গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। এদের অনেকে রিমান্ডে আছে, কারও রিমান্ড শেষ হয়ে জেলহাজতে পাঠানো হয়েছে। কোটা সংস্কার আন্দোলনকে পুঁজি করে কৌশলে নাশকতাকারীরা অংশ নিয়ে পরিস্থিতি ঘোলাটে করে। ধ্বংসাত্মক কর্মকা চালায়। ধ্বংসাত্মক এবং ভয়ংকর পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য কারফিউ ঘোষণা করে সরকার। নামানো হয় সেনাবাহিনী।
এ্যানী-স্বপনসহ রিমান্ডে আরও ৩৪ কারাগারে ১৭২ জন : বাংলাদেশ টেলিভিশন (বিটিভি) ভবনে হামলা-ভাঙচুরের মামলায় বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব শহীদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানীর সাত দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন আদালত। গতকাল এ্যানীকে আদালতে হাজির করে ১০ দিনের রিমান্ডের আবেদন করেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পুলিশ পরিদর্শক মোহাম্মদ ইয়াসিন শিকদার। অন্যদিকে রিমান্ড বাতিল ও জামিন চেয়ে আবেদন করেন আসামিপক্ষের আইনজীবী। শুনানি শেষে জামিন নামঞ্জুর করে এ্যানীকে সাত দিনের রিমান্ডে নেওয়ার আদেশ দেন ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট শান্তা আক্তার।
এ ছাড়া মিরপুর মেট্রোরেল স্টেশনে ভাঙচুরের মামলায় বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা জহির উদ্দিন স্বপনকে পাঁচ দিনের রিমান্ডে পাঠানোর আদেশ দিয়েছেন আদালত। এ ছাড়া এদিন এ মামলায় রিমান্ডে যাওয়া আসামিদের মধ্যে উল্লেখযোগ্যরা হলেন- জামায়াতে ইসলামীর কর্মপরিষদ সদস্য সামিউল হক ফারুকী ও বিএনপির কেন্দ্রীয় আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক নাসির উদ্দিন আহমেদ আসীম। মিরপুরে মেট্রোরেল স্টেশনে ভাঙচুর মামলায় ফারুকীর পাঁচ দিনের ও অসীমের তিন দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন ঢাকার ম্যাজিস্ট্রের আদালত।
গত ২২ জুলাই বনানীর সেতু ভবনে হামলার মামলায় স্বপন, অসীম ও ফারুকীর পাঁচ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন আদালত। ওই রিমান্ড শেষে শনিবার মেট্রোরেলে নাশকতা মামলায় গ্রেপ্তার দেখানোসহ ১০ দিনের রিমান্ড চেয়ে আবেদন করেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ডিবি পুলিশের পরিদর্শক শিকদার মহিতুল আলম। অন্যদিকে রিমান্ড বাতিল ও জামিন চেয়ে আবেদন করেন আসামিপক্ষের আইনজীবীরা। উভয়পক্ষের শুনানি শেষে তাদের জামিন নামঞ্জুর করে এসব রিমান্ড মঞ্জুর করেন ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট সাইফুর রহমানের আদালত।
এদিন রিমান্ডে যাওয়া বিএনপি-জামায়াতের মোট ৩৪ জন আসামির মধ্যে যাত্রাবাড়ী থানার ১২ জন, সাভার থানার চারজন, দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ থানার তিনজন, রামপুরা থানার তিনজন, শাহবাগ থানার দুজন, রূপনগর থানার একজন, শেরেবাংলা নগর থানার দুজন, মিরপুর থানার দুজন, কদমতলী থানার দুজন ও ধানমন্ডি থানার তিনজন রয়েছেন।
এদিকে ঢাকার ৩৪ থানার মামলায় কারাগারে যাওয়া ১৭২ আসামির মধ্যে আশুলিয়া থানার ছয়জন, ধামরাই থানার একজন, দোহার থানার চারজন, কেরানীগঞ্জ মডেল থানার নয়জন, কেরানীগঞ্জ দক্ষিণ থানার তিনজন, নিউমার্কেট থানার একজন, কলাবাগান থানার একজন, রামপুরা থানার আটজন, সবুজবাগ থানার তিনজন, তেজগাঁও থানার সাতজন, হাতিরঝিল থানার একজন, আদাবর থানার পাঁচজন, মোহাম্মদপুর থানার আটজন, পল্লবী থানার ২১ জন, কাফরুল থানার একজন, পল্টন থানার সাতজন, মতিঝিল থানার পাঁচজন, শাহজাহানপুর থানার দুজন, মিরপুর থানার চারজন, শেরেবাংলা নগর থানার ১১ জন, ভাটারা থানার তিনজন, বংশাল থানার নয়জন, কোতোয়ালি থানার তিনজন, চকবাজার থানার দুজন, বনানী থানার নয়জন, গুলশান থানার একজন, শ্যামপুর থানার তিনজন, কদমতলী থানার তিনজন, তুরাগ থানার দুজন, উত্তরা পূর্ব থানার ১৩ জন, হাজারীবাগ থানার দুজন, ডেমরা থানার দুজন, যাত্রাবাড়ী থানার পাঁচজন ও খিলগাঁও থানার সাতজন রয়েছেন।
এ ছাড়া ১৯ জুলাইয়ের পর থেকে গত ২৬ জুলাই পর্যন্ত সাত দিনে অন্তত ১ হাজার ৯৯৬ জনকে ঢাকার ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠানো হয়। ফলে এ নিয়ে কারাগারে যাওয়া মোট আসামির সংখ্যা দাঁড়াল অন্তত ২ হাজার ১৬৮ জনে। এর মধ্যে অনেকেই বিভিন্ন মেয়াদে রিমান্ড ভোগ করেন। গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে ও রিমান্ডে যাওয়া আসামিদের মধ্যে উল্লেখযোগ্যরা হলেন- বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ও সাবেক মন্ত্রী আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী ও নজরুল ইসলাম খান, বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ও সাবেক মন্ত্রী আমান উল্লাহ আমান, যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী, বিএনপি চেয়ারপারসনের বিশেষ সহকারী শামসুর রহমান শিমুল বিশ্বাস, বিএনপি নেত্রী নিপুণ রায় চৌধুরী, জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল ও সাবেক সংসদ সদস্য মিয়া গোলাম পরওয়ার, নায়েবে আমির ও সাবেক এমপি ডা. সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের, ডাকসুর সাবেক ভিপি নুরুল হক নূর, ছাত্রদলের সাবেক সভাপতি কাজী রওনকুল ইসলাম শ্রাবণ প্রমুখ।
নিজস্ব প্রতিবেদক ও প্রতিনিধিদের পাঠানো খবর-
চট্টগ্রাম : চট্টগ্রাম মহানগর বিএনপির সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক মনজুরুল আলম চৌধুরী মঞ্জুকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। গতকাল আকবর শাহ থানা এলাকার কর্নেলহাটের নিজ বাসা থেকে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। নগর বিএনপির দপ্তরের দায়িত্বপ্রাপ্ত ইদ্রিস আলী বলেন, বিএনপি নেতা মনজুরুল আলম চৌধুরী মঞ্জুকে বাসা থেকে গ্রেপ্তারের সময় পুলিশ তার পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে অশোভন আচরণ করে। পরিবারের সব সদস্যের মোবাইল ফোন কেড়ে নিয়ে সবাইকে এক জায়গায় দাঁড় করিয়ে রাখে। কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে গত ১৬ জুলাই থেকে ২৭ জুলাই সন্ধ্যা পর্যন্ত চট্টগ্রামে বিএনপির ৩৭০ নেতা-কর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে ১৮টি মামলায় ৩৭ হাজার জনকে আসামি করা হয়েছে। শুক্রবার থেকে শনিবার সন্ধ্যা পর্যন্ত ২০ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এদিকে চট্টগ্রামে কোটা সংস্কার আন্দোলনের নামে সহিংসতার ঘটনায় গত ২৪ ঘণ্টায় জেলা পুলিশ ও নগর পুলিশ আরও ৪৪ জনকে গ্রেপ্তার করেছে। পাশাপাশি সিএমপির আকবরশাহ থানায় ৩৭ জনের নাম উল্লেখ করে ৭০ জনকে অজ্ঞাত আসামি করে নতুন মামলা দায়ের করেছে পুলিশ। নতুন মামলাসহ সিএমপিতে ১৯টি মামলায় এ পর্যন্ত গ্রেপ্তার করা হয়েছে ৪৭৬ জনকে। গতকাল এসব তথ্য জানানো হয়।
রাজশাহী : কোটা সংস্কার আন্দোলনের নামে সহিংসতার ঘটনায় শুক্রবার রাত থেকে শনিবার সকাল পর্যন্ত ৩৯ জনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। এর মধ্যে জেলায় ৬ জন ও নগরীতে ৩৩ জন। এ নিয়ে ১৬ মামলায় রাজশাহীতে ৩৫৬ জনকে গ্রেপ্তার করা হলো। যার মধ্যে মহানগরে ২১৮ ও জেলায় ১৩৮ জন। জেলা ও মহানগর পুলিশের মুখপাত্ররা এসব তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
খুলনা : খুলনায় নাশকতার মামলায় নগরীর আযম খান কমার্স কলেজের ছাত্রদলের আহ্বায়ক মো. নাজিম উদ্দিন শামীমসহ ৭ জনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। এ নিয়ে তিনটি মামলায় গত ১১ দিনে খুলনায় ১০০ জনকে গ্রেপ্তার করা হলো।
গাইবান্ধা : কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে গাইবান্ধায় বিএনপি-জামায়াতের ৭৮ নেতা-কর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। গতকাল সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মাসুদ রানা গ্রেপ্তারের বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। এর আগে বিএনপি-জামায়াতের নেতা-কর্মী ও আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে তিনটি মামলা দায়ের করে পুলিশ। এতে অন্তত ৭০০ থেকে ৮০০ জনকে আসামি করা হয়।
বগুড়া : শুক্রবার পর্যন্ত বগুড়া সদর থানায় ১৪টি মামলা করা হয়েছে। মামলায় ১ হাজার ২৩৯ জনকে আসামি করা হয়েছে। এ ছাড়া অজ্ঞাতনামা আসামি করা হয়েছে অনেককে। সর্বশেষ গত শুক্রবার জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের পক্ষ থেকে মামলা দায়ের করা হয়। মামলায় জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের শহরের সাতমাথা কার্যালয়ে হামলা, লুটপাট, অগ্নিসংযোগ ও ভাঙচুরের ঘটনায় ১৫০ জনকে অজ্ঞাত আসামি করে মামলা দায়ের করা হয়েছে।