আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪-দলীয় জোটের বৈঠকে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে স্বাধীনতাবিরোধী জামায়াত শিবিরকে নিষিদ্ধ করার প্রস্তাব সর্বসম্মতিক্রমে গ্রহণ করা হয়েছে। দাবিটি সরকারের নির্বাহী বিভাগের কাছে লিখিত আকারে দেওয়া হবে। গতকাল বিকাল ৫টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত বৈঠকে এ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। এ ছাড়াও পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত কারফিউ অব্যাহত রাখা এবং পর্যায়ক্রমে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন জোট শরিক দলের নেতারা। বৈঠক শেষে গণভবনের গেটে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক, সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের এ তথ্য জানান। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে তাঁর সরকারি বাসভবন গণভবনে অনুষ্ঠিত বৈঠকে ১৪ দলের কেন্দ্রীয় সমন্বয়ক ও মুখপাত্র আমির হোসেন আমু, আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের ছাড়াও ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন, জাসদ সভাপতি হাসানুল হক ইনু, সাম্যবাদী দলের দিলীপ বড়ুয়া, ১৪ দলের ফজলে হোসেন বাদশা, শিরিন আখতার, সৈয়দ নজিবুল বশর মাইজভান্ডারী, ডা. অসীত বরণ রায়, আওয়ামী লীগের ড. আবদুর রাজ্জাক, মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া বীরবিক্রম, অ্যাডভোকেট কামরুল ইসলাম, অ্যাডভোকেট জাহাঙ্গীর কবির নানক, আবদুর রহমান, মাহবুব-উল আলম হানিফ, আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম প্রমুখ নেতারা উপস্থিত ছিলেন। সূত্র জানায়, বৈঠকে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরসহ সরকারের মন্ত্রীদের অতিকথন নিয়ে কথা বলেন ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন, জাসদ সভাপতি হাসানুল হক ইনু। তারা বলেন, ওবায়দুল কাদের সাহেবসহ সরকারের অনেক মন্ত্রী অতিকথন করছেন। অপরিপক্ব ও অপরিকল্পিত এসব কথাবার্তা বন্ধ করতে হবে। প্রধানমন্ত্রীকে উদ্দেশ করে জাসদ সভাপতি হাসানুল হক ইনু বলেন, দাবা খেলায় রাজাকে রক্ষার জন্য মন্ত্রী, রানি ও হাতি, সৈনিককে বলি দিতে হয়। তেমনি আপনি রাজা, আগে রাজাকে রক্ষা করতে হবে। সেজন্য প্রয়োজনে মন্ত্রী, রানি ও হাতিকে কোরবানি দিন। এ ছাড়া রাজনৈতিক বিষয় রাজনীতি দিয়ে সমাধান করতে বলেন রাশেদ খান মেনন। তিনি বলেন, রাজনীতিবিদদের দিয়েই রাজনৈতিক সমস্যা সমাধান করতে হবে। ডিবি অফিসে নিয়ে ছাত্রদের কেন বিবৃতি দিতে হবে? এটা মোটেও ভালো হয়নি। উচ্চ আদালত একটি কমেন্ট করেছেন, যা সরকারের জন্য মোটেও ভালো হয়নি। রাজনৈতিকভাবে সমাধান করার মতো অনেক নেতা এখানে রয়েছেন। তা না করে আমলা দিয়ে কর্মকাণ্ড করালে শুধু দৃষ্টিকটুই নয়, এতেকরে দেশের মানুষের মধ্যে বিভ্রান্তি তৈরি হয়েছে। অবিশ্বাস তৈরি হয়েছে। এগুলোর দ্রুত সমাধান করা উচিত, একই সঙ্গে সাবধান হওয়া উচিত। এ সময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন। জামায়াত শিবিরকে নিষিদ্ধ করার দাবি জানিয়ে মেনন বলেন, যুদ্ধাপরাধীর বিচারের সময়ে জামায়াতকে নিষিদ্ধের জন্য বলা হয়েছিল। আদালতও একটি পর্যবেক্ষণ দিয়েছিলেন। সে সময় জামায়াত শিবিরকে নিষিদ্ধ না করা ছিল ভুল। আজকে তারা আবার ফণা তুলছে। এখনো সময় আছে, জামায়াত শিবিরকে নিষিদ্ধ করতে হবে। জামায়াতকে নিষিদ্ধের দাবি জানিয়ে হাসানুল হক ইনু বলেন, সাপ মেরে লেজ তাজা রেখে লাভ হবে না। জামায়াত শিবির জঙ্গি গোষ্ঠীকে নিষিদ্ধ করতে হবে। তাহলে তারা এ সন্ত্রাস করার সাহস দেখাবে না। জাতীয় পার্টি (জেপি)-এর সাধারণ সম্পাদক শেখ শহীদুল ইসলাম, তরিকত ফেডারেশনের সভাপতি নজিবুল বশর মাইজভান্ডারীও সভায় জামায়াত-নিষিদ্ধের দাবি জানান। এ সময় ১৪ দলের শরিকরা জামায়াত নিষিদ্ধের বিষয়ে সবাই একমত হন। জোটনেত্রী শেখ হাসিনা উপস্থিত নেতা-কর্মীদের উদ্দেশে বলেন, আপনারা যদি সবাই একমত হন তাহলে এ বিষয়ে আমরা পদক্ষেপ নেব। এসময় সবাই শেখ হাসিনাকে এই উদ্যোগ নেওয়ার জন্য বলেন। তরিকত ফেডারেশনের চেয়ারম্যান নজিবুল বশর মাইজভান্ডারী সভায় পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত কারফিউ অব্যাহত রাখার প্রস্তাব দেন। শরিক দলের নেতাদের বক্তব্যে ১৪ দলের মধ্যে দূরত্ব দূর করে সামনে ঐক্যবদ্ধ থাকার পথ তৈরির পরামর্শও উঠে আসে। জেপির মহাসচিব শেখ শহীদুল ইসলাম পরিস্থিতি বুঝে ধীরে ধীরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়ার প্রস্তাব দেন। তিনি বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় না খুললেও প্রাথমিক বিদ্যালয় খুলে দিন। না হয় অনেক শিক্ষার্থীর শিক্ষা জীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়ছে। একই সঙ্গে তিনি স্থগিত থাকা এইচ এস সি পরীক্ষা দ্রুত শেষ করার তাগিদ দেন। বৈঠকে জোটের এক শরিক নেতা বলেন, জোটের সাংগঠনিক ভিত্তি বাড়ানো দরকার। আওয়ামী লীগের একলাচলো নীতি জোটের ভিত্তি কিছুটা হলেও নড়বড়ে অবস্থায়। এটা দূর করতে হবে। দ্রুতই সব সমাধান করার জন্য জোট প্রধানের হস্তক্ষেপ কামনা করেন তিনি। বৈঠক শেষে ওবায়দুল কাদের বলেন, বিএনপি-জামায়াত নৈরাজ্যের মাধ্যমে দেশকে অকার্যকর করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। জাতীয় স্বার্থে দেশবিরোধী অপশক্তি নির্মূল করার জন্য ১৪ দলের বৈঠকে সর্বসম্মতভাবে জামায়াত-শিবিরের রাজনীতি নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। ওবায়দুল কাদের বলেন, আওয়ামী লীগ সভানেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে ১৪ দলের নেতাদের জরুরি বৈঠকে দেশের সাম্প্রতিক সময়ে সংঘটিত সন্ত্রাস নাশকতা ও নৈরাজ্যের বিরুদ্ধে দেশের জাতীয় নিরাপত্তা, জনগণের জানমাল রক্ষার লক্ষ্যে আইন অনুযায়ী প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করে জনমনের স্বস্তি ফিরিয়ে আনার জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ধন্যবাদ জানান ১৪ দলের নেতারা। পরিপূর্ণ স্বস্তি আনার ক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও সামরিক বাহিনীর অগ্রণী ভূমিকা রাখার জন্য তাদের প্রতিও নেতারা ধন্যবাদ জানান। তিনি আরও বলেন, নেতারা মনে করেন বিএনপি-জামায়াত-ছাত্রদল-শিবির এবং তাদের দোসর উগ্রবাদী জঙ্গিগোষ্ঠী বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব নস্যাৎ করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। তারা সন্ত্রাস, নৈরাজ্য ও হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে দেশকে অকার্যকর করার ষড়যন্ত্র করছে। অতি সম্প্রতি চোরাগোপ্তা হামলা করে এবং গুলিবর্ষণ করে সরকারের ওপর দায় চাপাতে তারা দেশে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে। পুলিশ বাহিনীর সদস্যসহ মানুষ হত্যা করে লাশ পর্যন্ত ঝুলিয়ে রেখেছে। এ সন্ত্রাসী গোষ্ঠী যে প্রক্রিয়ায় এসব হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে তা ইতিহাসে নজিরবিহীন। জাতীয় স্বার্থ দেশবিরোধী এ অপশক্তিকে নির্মূল করা প্রয়োজন।
ওবায়দুল কাদের আরও বলেন, ১৪ দলের এ সভায় সর্বসম্মতিক্রমে সিদ্ধান্ত হয়, জামায়াত শিবির গোষ্ঠীর অপশক্তির রাজনীতি নিষিদ্ধ করার জন্য। তিনি আরও বলেন, ১৪ দল মনে করে শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা, তাদের শিক্ষা জীবনের সুরক্ষা দেওয়ার লক্ষ্যে সরকারকে পর্যায়ক্রমে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত। নেতারা মনে করেন, কোনো শিক্ষার্থী এবং নিরপরাধ মানুষ যেন হয়রানির শিকার না হয় সে বিষয়টিকেও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে বিশেষ গুরুত্ব সহকারে দেখতে হবে। ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন বলেন, জামায়াত শিবির নিষিদ্ধের সিদ্ধান্ত সরকার দ্রুত বাস্তবায়ন করবে। তরিকত ফেডারেশনের সভাপতি সৈয়দ নজিবুল বশর মাইজভান্ডারী বলেন, জামায়াত শিবির নিষিদ্ধ হলে তারা আর সংবাদ সম্মেলন কিংবা অন্য কোনো রাজনৈতিক কর্মসূচি করতে পারবে না। প্রসঙ্গত, এর আগে গত ১৯ জুলাই ১৪ দলের নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সেদিনও প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবনে অনুষ্ঠিত ওই সভায় উদ্ভূত পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা হয়।