টানা বর্ষণ ও উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে দেশের বিভিন্ন স্থানে বাঁধ ভেঙে শতাধিক গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন লাখ লাখ মানুষ। ভারতের ত্রিপুরার একটি গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, ত্রিপুরায় অতি বৃষ্টির কারণে সেখানে ব্যাপক বন্যা দেখা দেয়। এজন্য তারা ত্রিপুরা-বাংলাদেশ সীমান্তে অবস্থিত ডম্বুর হাইড্রইলেকট্রিক পাওয়ার প্রজেক্ট বা ডম্বুর গেট খুলে দিয়েছে। যা সর্বশেষ ১৯৯৩ সালে ভারত এই গেট খুলে দিয়েছিল। ডম্বুর গেট খুলে দেওয়ায় ফেনীর মহুরী প্রজেক্ট রেগুলেটর দিয়ে পানি সাগরে পড়তে গিয়ে পার্শ্ববর্তী সোনাগাজী ও ফেনীর অন্যান্য উপজেলায় বন্যার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। এই অবস্থায় ফেনীতে স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যায় একজনের মৃত্যু এবং একজন নিখোঁজের খবর পাওয়া গেছে। বন্যা থেকে স্থানীয়দের সহযোগিতার জন্য কাজ করছে সেনাবাহিনী। এদিকে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়ায় ভারী বৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলে তলিয়ে গেছে জেলার ৩০ গ্রাম। এর মধ্যে পানিতে ডুবে এক গর্ভবতীর মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। শুধু তাই নয়, আখাউড়া ইমিগ্রেশন ভবনে হাঁটুপানি হওয়ায় যাত্রী পারাপার বন্ধ হয়ে গেছে। পরে নির্মিত অস্থায়ী সেতু ভেঙে যাওয়ায় আমদানি-রপ্তানি ব্যাহত হচ্ছে। ফেনীর মহুরী নদীর পানি ঢোকায় নোয়াখালীতে বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। লক্ষ্মীপুর ও রায়পুরে লাখ লাখ মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন। পাশাপাশি মৎস্য ও কৃষি খাতে ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। ভারত থেকে আসা পানিতে কুমিল্লায় গোমতী বাঁধ ভাঙার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। জীবন রক্ষায় বাঁধে সহস্রাধিক পরিবার আশ্রয় নিয়েছে। হবিগঞ্জের নদনদীর পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। মৌলভীবাজারের প্রধান চারটি নদীর পানি বিপৎসীমার ওপরে প্রবাহিত হওয়ায় প্লাবিত হয়েছে অর্ধশত গ্রাম। এ ছাড়া সিলেটে কুশিয়ারা নদীর পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। নিজস্ব প্রতিবেদক ও প্রতিনিধিদের পাঠানো খবর-
ফেনী : স্মরণ অতীতকালের ভয়াবহ বন্যায় ফেনী জেলার পরশুরাম, ফুলগাজী ও ছাগলনাইয়ার দেড় লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দি রয়েছেন। বন্যায় একজনের মৃত্যু হয়েছে বলে প্রশাসনের পক্ষ থেকে নিশ্চিত করা হয়েছে। জেলা প্রশাসক মুছাম্মৎ শাহীনা আক্তার জানান, বন্যাকবলিত মানুষকে উদ্ধার করতে সেনাবাহিনী কাজ করছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই উদ্ধার তৎপরতায় নামবে সেনাবাহিনী।
মুহুরী, কহুয়া ও সিলোনিয়া নদীর পুরনো ভাঙা ২৬টি পয়েন্ট দিয়ে লোকালয়ে পানি প্রবেশ করে গ্রামের পর গ্রাম প্লাবিত হচ্ছে। যত সময় যাচ্ছে পাল্লা দিয়ে পানি বেড়েই চলছে। একটু নিচু এলাকার বাড়ি ঘরের ছাদ পর্যন্ত পানি উঠছে। ফেনী-বিলোনিয়া সড়কে পানি ২ থেকে ৪ ফুট পর্যন্ত রয়েছে। গ্রামের বিভিন্ন সড়কে পানি ৭ থেকে ৮ফুট উচ্চতায় রয়েছে। পরশুরাম উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আফরোজা হাবিব শাপলা বলেন, ‘স্মরণকালের সবচেয়ে ভয়াবহ বন্যায় পরশুরাম পৌরসভা ও তিনটি ইউনিয়নের প্রায় অধিকাংশ গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। এতে পানিবন্দি হয়ে পড়েছে অসংখ্য মানুষ। ব্রাহ্মণবাড়িয়া : ভারী বর্ষণ আর ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের পাহাড়ি ঢলে জেলার আখাউড়ায় অন্তত ৩০টি গ্রামে পানি প্রবেশ করেছে। এতে ৫ শতাধিক পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। বেশ কিছু পুকুর ও সাড়ে ১২ শ হেক্টর কৃষি জমি পানিতে তলিয়ে গেছে। পানিতে ডুবে সুবর্ণা আক্তার (২৫) নামে গর্ভবতীর মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। তিনি বীরচন্দ্রপুর গ্রামের পারভেজ মিয়ার স্ত্রী। আখাউড়া স্থলবন্দরের সহকারী পরিচালক মাহমুদুল হাসান জানান, সকালে বন্দরে কয়েকটি মাছের পিকআপ ভ্যান এসেছে। তবে জলাবদ্ধতার কারণে বড় ট্রাকগুলো আসতে পারেনি। এর ফলে রপ্তানি কার্যক্রম কিছুটা ব্যাহত হচ্ছে। আখাউড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা গাজলা পারভীন জানান, ঢলের পানিতে বেইলি সেতু তলিয়ে যাওয়ায় যান চলাচল বন্ধ রয়েছে। সেতুটি মেরামতের জন্য সড়ক ও জনপথ বিভাগকে খবর দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া ইমিগ্রেশনের কার্যক্রমও সাময়িক সময়ের জন্য বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। নোয়াখালী : ফেনীর মহুরী নদীর পানি ঢোকায় নোয়াখালীর ৯ উপজেলায় বন্যা পরিস্থিতি অবনতি হয়েছে। নতুন করে জেলার অনেক এলাকা বন্যার পানিতে প্লাবিত হচ্ছে। এদিকে নোয়াখালীতে গত ২৪ ঘণ্টায় ৭১ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত জেলা আবহওয়া অফিস রেকর্ড করেছে। এর মধ্যে নয়টি উপজেলার ২০ লাখ মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন। গ্রামীণ সব সড়ক, ফসলি মাঠ এখনো পানিতে তলিয়ে আছে। ভেসে গেছে পুকুর ও খামারের মাছ। লক্ষ্মীপুর : মেঘনা নদীর আস্বাভাবিক জোয়ার এবং কয়েকদিনের টানাবৃষ্টিতে পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন লক্ষ্মীপুরের লাখো মানুষ। ডুবে গেছে আমনের বীজতলাসহ ফসলি কৃষি জমি, রাস্তাঘাট, ভেসে গেছে মাছের ঘের, পুকুর ও জলাশয়, নিম্নাঞ্চলের ঘরবাড়ি ও শহরের বিভিন্ন এলাকায় ঢুকে গেছে পানি। চারদিকে ভয়াবহ বন্যা পরিস্থিতি বিরাজ করছে। রায়পুর (লক্ষ্মীপুর) : রায়পুর উপজেলায় টানা তিন দিনের ভারী বর্ষণে প্রায় তিন লাখ মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন। বেশি কষ্টে রয়েছেন উপকূলীয় জনপদের বাসিন্দারা। দক্ষিণ চরবংশী, দক্ষিণ চর আবাবিল, উত্তর চরবংশী ও উত্তর চরআবাবিলের বেশির ভাগ এলাকা তলিয়ে গেছে। কুমিল্লা : ভারত থেকে আসা পানিতে বিপৎসীমায় রয়েছে কুমিল্লার গোমতী নদীর পানি। আশঙ্কা রয়েছে বাঁধ ভেঙে পড়ার। বাঁধে অবস্থান করছে সহস্রাধিক পরিবার। এদিকে পানিতে ডুবে গেছে দক্ষিণ কুমিল্লার বেশির ভাগ সড়ক ও ফসলি জমি। হবিগঞ্জ : পাহাড়ি ঢলে বেড়েই চলেছে হবিগঞ্জের খোয়াই নদীর পানি। নদীর পানি সবগুলো পয়েন্টেই বিপৎসীমা অতিক্রম করেছে। যে কারণে নদী পাড়ের বাসিন্দাদের মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছে। মৌলভীবাজার : পাহাড়ি ঢলে মৌলভীবাজারের কুলাউড়ায় বিভিন্ন স্থানে বাঁধ ভেঙে শতাধিক গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। এতে উপজেলার টিলাগাঁও, জয়চ-ী, সদর, রাউৎগাঁও ও পৃথিমপাশা ইউনিয়নের বিভিন্ন এলাকায় সহস্রাধিক মানুষ পানিবন্দি রয়েছে। সড়ক পথেও অনেক গ্রামের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। সিলেট : বৃষ্টি কমলেও বাড়ছে সিলেটের বিভিন্ন পয়েন্টের নদনদীর পানি। এর মধ্যে কুশিয়ারা নদীর দুটি পয়েন্টে পানি বিপৎসীমা অতিক্রম করেছে। এদিকে আবহাওয়া অধিদপ্তর আগামী শুক্রবার পর্যন্ত সিলেটসহ দেশের কয়েকটি অঞ্চলে হালকা থেকে ভারী বৃষ্টিপাতের পূর্বাভাস দিয়েছে। বরিশাল : বরিশাল বিভাগের ৭টি নদীর পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এতে বরিশাল নগরসহ নদীর তীরবর্তি নিম্নাঞ্চল তলিয়ে গেছে।