সহজে লুকানো, বিনিময় ও বহনযোগ্য হওয়ায় সোনা, ডলার আর ইউরোতে ঘুষ খান সরকারি আমলারা। তাদের বাসাবাড়িতে অভিযান চালিয়ে বিপুল পরিমাণ সোনার বার, মার্কিন ডলার আর ইউরো উদ্ধারের দাবি জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। তারা বলেছেন, খোলাবাজার থেকে কারা বিলিয়ন বিলিয়ন বৈদেশিক মুদ্রা নিয়ে যাচ্ছে, তাদের ওপর কড়া নজরদারি জরুরি।
এ প্রসঙ্গে ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন বাংলাদেশ শিল্প ও বণিক সমিতি ফেডারেশন-এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি আবদুল আউয়াল মিন্টু গতকাল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, বিগত ১৫ বছরে আমি কাউকে ঘুষ প্রদান করিনি। তবে লোকমুখে শুনেছি, আওয়ামী ফ্যাসিবাদী সরকারের আমলারা ঘুষ হিসেবে সোনা, ডলার ও ইউরোর মতো বৈদেশিক মুদ্রা বেশি পছন্দ করতেন। কারণ হিসেবে অনেকে বলতেন, সোনা, ডলার ও ইউরো সহজে বহনযোগ্য এবং লুকিয়ে রাখা সম্ভব। ফলে আমরা দেখছি, আমলাদের কাছে এখন ব্যাপক অর্থ-সম্পদ পাওয়া যাচ্ছে। অনেক সময় তারা নগদে নিতেন। আবার অনেক সময় আমলাদের পরিবার-পরিজনের মাধ্যমে বিদেশে এসব সম্পদ প্রদানের প্রচলন রয়েছে।
জুয়েলারি শিল্প মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ জুয়েলার্স অ্যাসোসিয়েশন- বাজুসের মুখপাত্র ও কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য আনোয়ার হোসেন গতকাল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, প্রশাসনের দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা-কর্মচারীরা সোনা, ডলার আর ইউরোতে ঘুষ নিতে বেশি উৎসাহী। এ ক্ষেত্রে আমলারা সোনাকে বেশি অগ্রাধিকার দেন। আবারও অনেক কৌশলে টাকার বদলে সোনার অলংকার আমলাদের পরিববার-পরিজনকে ঘুষ বা উপহার হিসেবে দেন। আমি মনে করি, শত শত আমলার বাসাবাড়িতে অভিযান চলালে পাওয়া যাবে বিপুল পরিমাণ সোনা, ডলার আর ইউরো। বৈদেশিক মুদ্রা লেনদেনে যুক্ত বৈধ প্রতিষ্ঠানগুলোর সংগঠন মানি চেঞ্জার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সভাপতি এস এম জামান গতকাল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, কিছু নামসর্বস্ব অবৈধ মানি চেঞ্জারের মাধ্যমে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার নিয়ে গেছে পাচারকারীরা। এর সঙ্গে আমাদের কোনো সদস্য জড়িত নয়। এ বিষয়ে একাধিকবার আমরা বাংলাদেশ ব্যাংক এবং বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট বা বিএফআইইউকে বলেছি। এখনো বলছি, খোলাবাজার থেকে কারা ডলার, ইউরোসহ অন্যান্য বৈদেশিক মুদ্রা নিয়ে যাচ্ছে, তাদের ওপর কড়া নজরদারি জরুরি। এ ক্ষেত্রে গাফিলতি দূর করতে হবে।জানা গেছে, বিগত ১৫ বছরে আওয়ামী সরকারের আশীর্বাদপুষ্ট হয়ে ক্ষমতার দাপট দেখিয়েছেন আমলারা। বিভিন্ন সময়ে অনেকের বিরুদ্ধে ঘুষ নেওয়ার সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পেয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন-দুদক। তবে বিভিন্ন মহলের চাপের কারণে এতদিন সেসব অভিযোগ নিয়ে কাজ করতে পারেনি সংস্থাটি। রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর এখন সেসব অভিযোগ অনুসন্ধান করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এরই মধ্যে দীর্ঘদিন লাল ফিতায় বন্দি থাকা অনেক গুরুত্বপূর্ণ ফাইল নিয়ে নতুন করে তদন্ত শুরু করেছে দুদক। আওয়ামী লীগ সরকারের তলপিবাহক ঘুষখোর শত শত আমলার বিরুদ্ধে অবৈধভাবে বিপুল সম্পদ অর্জনের তথ্য রয়েছে। চাকরি জীবনে ক্ষমতার অপব্যবহার, ঘুষ, উন্নয়ন প্রকল্প থেকে কমিশন নেওয়াসহ বিভিন্ন অনিয়মে জড়িয়ে মালিক হয়েছেন শত শত কোটি টাকার। এসব অবৈধ অর্থে তারা দেশে-বিদেশে বিপুল সম্পদ গড়েছেন। বিভিন্ন ব্যাংকে নামে-বেনামে কোটি কোটি টাকার এফডিআর রয়েছে। কারও কারও রয়েছে বিভিন্ন কোম্পানির বিপুল পরিমাণ শেয়ার। দেশের বিভিন্ন জায়গায় জমি আছে অনেকের। এসব সম্পদের বেশির ভাগই স্ত্রী, সন্তান কিংবা আত্মীয়-স্বজনদের নামে। অনেকেই চাকরি শেষে নাম লিখিয়েছেন রাজনীতিতে। কেউ কেউ গড়েছেন ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান। কয়েকজন আবার দেশ ছেড়ে পরিবার-পরিজন নিয়ে বিদেশে স্থায়ী হয়েছেন। কারও কারও বিরুদ্ধে অর্থ পাচারেরও অভিযোগ রয়েছে। এদিকে দেশের টাকা পাচার করে যুক্তরাষ্ট্রে বাড়ি কিনেছেন এমন ২৫২ জন আমলা, পুলিশসহ সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের তালিকা ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বর মাসে তৎকালীন সরকারের প্রধানমন্ত্রীর শেখ হাসিনার কাছে উত্থাপন করা হয়েছিল। ওই তালিকা বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, এই ২৫২ জনের মধ্যে অন্তত ৩০-৩৫ জন পুলিশের ওসি (ইন্সপেক্টর) রয়েছেন। এদের কারও আবার একাধিক বাড়িও আছে। যুক্তরাষ্ট্রে কারা বাড়ি কিনেছেন, এ ব্যাপারে কয়েক মাস ধরে তদন্ত করছিল একটি গোয়েন্দা সংস্থা। এদের সবাই দেশ থেকে টাকা পাচার করে যুক্তরাষ্ট্রে নিয়েছেন।
সরকারের সচিব পদমর্যাদার কর্মকর্তা ছাড়াও পুলিশের শীর্ষ কর্মকর্তাও আছেন এই তালিকায়, যারা সরকারের আস্থাভাজন হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে ছিলেন। বিগত সরকারের সময় দায়িত্ব পালন করা অনেক আমলা, পুলিশ কর্মকর্তাসহ সরকারি কর্মকর্তারা বিদেশে টাকা পাচার করেছেন। তখন কয়েক শ সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীর বিদেশে সম্পদ থাকার তালিকা প্রকাশ হয়েছিল।
গত জানুয়ারি মাসে জাতীয় সংসদে বিদেশে বাড়ি-গাড়ি আছে, এমন আমলাদের তালিকা সংসদে প্রকাশের দাবি করেছিলেন তৎকালীন বিরোধী দল জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্য ব্যারিস্টার শামীম হায়দার পাটোয়ারি। তখন তিনি বলেছিলেন, গণমাধ্যমে এসেছে আমলাদের বিদেশে প্রচুর সম্পদ আছে। আমলাদের মধ্যে কাদের বিদেশে বাড়ি-গাড়ি আছে তাদের তালিকা সংসদে প্রকাশ করা উচিত। তাদের বরখাস্ত করে বিচারের আওতায় আনা উচিত। এমনকি তাদের ফাঁসি দেওয়া উচিত।