একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পান কুমিল্লা-৯ আসনের আওয়ামী লীগের এমপি মো. তাজুল ইসলাম। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে দ্বিতীয় মেয়াদে একই মন্ত্রণালয়ে দায়িত্ব পালন করেন তিনি। রাষ্ট্রের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ এই মন্ত্রণালয়ের নিয়ন্ত্রণ ছিল তাজুল ইসলামের সহকারী একান্ত সচিব (এপিএস) জাহিদ হোসেন ও এক ভাতিজার হাতে। কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বদলি, টেন্ডার বাণিজ্য, নিয়োগে ঘুষ বাণিজ্য, স্থানীয় সরকার পর্যায়ে বিভিন্ন স্থানে অর্থ বরাদ্দ, স্থানীয় সরকারের জনপ্রতিনিধিদের বরখাস্ত কিংবা প্রত্যাহার সবকিছু হতো তাদের ইশারায়। বড় বড় আমলারাও ছিল তাদের ভয়ে তটস্থ। মন্ত্রী নিয়মিত সচিবালয়ে না গেলেও তারা নিয়মিত অফিস করতেন।
কোনো কাজের জন্য এপিএস ও ভাতিজা যে তালিকা দিতেন সেটাই ছিল চূড়ান্ত। মন্ত্রণালয়ের অধীনে প্রকৌশলীদের বদলির জন্য ৩০ লাখ থেকে কোটি টাকা পর্যন্ত নিতেন এই দুজন। সে সময়ে অনেকেই মুখ না খুললেও বলতেন, মন্ত্রী তাজুল ইসলাম হলেও মন্ত্রণালয় পরিচালনা করতেন এই ‘ছায়া’ দুই মন্ত্রী। আর এসব করে গত সাড়ে পাঁচ বছরে হয়েছেন কোটি কোটি টাকার মালিক। তাদের নামে-বেনামে অসংখ্য প্লট ও ফ্ল্যাট। রিয়েল এস্টেট, হাউজিং, বিভিন্ন কোম্পানির ডিলারসহ ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানের মালিক বনে গেছেন তারা। গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার আন্দোলনে পটপরিবর্তন হওয়ার পর মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা মুখ খুলতে শুরু করেছেন। তারা বলছেন, এপিএস জাহিদ ও ভাতিজা ছায়ামন্ত্রী হিসেবে নানা অনিয়ম-দুর্নীতি করেছেন। সবকিছু ছিল তাদের কবজায়। মন্ত্রীর কাছেও কোনো কাজ নিয়ে গেলে তারা এপিএস কিংবা ভাতিজার সঙ্গে দেখা করেছেন কিনা জিজ্ঞেস করতেন বলেও সচিবালয়ে চাউর আছে।
ফেনীর ছাগলনাইয়া উপজেলার মল্লভপুর গ্রামের বাসিন্দা এপিএস জাহিদ। বাবা উপজেলা সমবায় অফিসের কেরানি। ডিগ্রি পাস করার পর মাস্টাররোলে চাকরি পান সংসদ সচিবালয়ে। এর কিছুদিন পর জ্বালানি খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের সংসদীয় স্থায়ী কমিটির তৎকালীন সভাপতি মো. তাজুল ইসলামের ব্যক্তিগত সহকারী হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। তোষামোদ ও চাটুকারিতায় পারদর্শী জাহিদ ধীরে ধীরে তাজুলের বিশ্বস্ত হয়ে ওঠেন। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর সরকার গঠন হলে তাজুল ইসলাম স্থানীয় সরকার ও পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রীর দায়িত্ব পান। তেলবাজিতে পারদর্শী জাহিদকে ব্যক্তিগত সহকারী হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। এরপর আর ফিরে তাকাতে হয়নি তাকে।
মন্ত্রীর ভাতিজার সঙ্গে আঁতাত করে নানা অনিয়ম দুর্নীতি শুরু করেন। স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি), জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর (ডিপিএইচই), ওয়াসা, সিটি করপোরেশন, জেলা ও উপজেলা পরিষদ, পৌরসভার প্রকল্প গ্রহণ, টেন্ডার ও ঠিকাদার নিয়োগ করতেন তারা দুজন। একইসঙ্গে এসব সংস্থার কর্মকর্তাদের বদলি, থোক বরাদ্দ গ্রহণ, বিশেষ কর্মসূচি গ্রহণসহ সব কার্যক্রমই মূলত তাদের দুজনের নিয়ন্ত্রণে হতো। বিশেষ করে বদলি বাণিজ্যের দিকে তাদের নজর ছিল বেশি। যদিও এলজিইডিসহ বিভিন্ন সংস্থার সহকারী থেকে নির্বাহী প্রকৌশলী পর্যন্ত বদলির ক্ষমতা ছিল সংস্থাটির প্রধানের হাতে। কিন্তু এলজিআরডি মন্ত্রী তাজুল ইসলাম মন্ত্রণালয়ে দায়িত্ব নেওয়ার পর এসব বদলির ক্ষমতা তার হাতে নিতে তৎপরতা চালায় মন্ত্রীর এই দুই সহচর। পরে মন্ত্রী এসব বদলির ক্ষমতা মন্ত্রণালয়ে নিয়ে আসেন। এরপরই শুরু হয় এপিএস জাহিদ ও ভাতিজার বদলি বাণিজ্য।
এসব প্রকৌশলীর বদলি হতে ৩০ লাখ থেকে ১ কোটি টাকা পর্যন্ত নিতেন তারা। আর তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী বদলি ও প্রকল্প পরিচালক নিয়োগ ৫০ লাখ থেকে ১ কোটি টাকা রেট ধার্য ছিল। একইসঙ্গে ঠিকাদার নিয়োগ দিয়ে নিতেন ৮-১০% কমিশন। এ ছাড়া ডিপিএইচই ও সিটি করপোরেশনের টিভিতে প্রচার হওয়া বিভিন্ন সচেতনতামূলক অনুষ্ঠান তৈরি করতেন জাহিদ। এর মধ্যে ডেঙ্গুবিষয়ক অনুষ্ঠান তৈরিতে তিনি খরচ দেখিয়েছেন ১০ কোটি টাকা। এর মধ্যে ৫ কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। দুর্নীতি ও অনিয়মের মাধ্যমে এসব কর্মকান্ড করে কোটি কোটি টাকার মালিক হয়েছেন তিনি। ঢাকার বনশ্রীতে রয়েছে তার হাউজিং ব্যবসা। মালিক হয়েছেন কয়েকটি প্লট ও ফ্ল্যাটের।
চাচা মন্ত্রী হওয়ার আগের দিনও রাজধানীর সুবাস্তু নজর ভ্যালিতে একরুমের একটি ভাড়া বাসায় থাকতেন ভাতিজা। ঠিকমতো বাসা ভাড়াও দিতে পারতেন না বলে জনশ্রুতি রয়েছে। মন্ত্রী হওয়ার পরের দিন থেকেই তার চলন-বলনে পরিবর্তন আসে। মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন প্রকল্পের দামি গাড়ি নিয়ে চলাচল শুরু করেন। এরপর ভাড়া বাসা ছেড়ে গুলশানে একটি আলিশান ফ্ল্যাটে ওঠেন। মন্ত্রণালয়ে গিয়ে প্রভাব বিস্তার করতেন মন্ত্রীর ভাতিজা হিসেবে। কর্মকর্তারাও তাকে সমীহ করতেন। এরপর আর তাকে ফিরে তাকাতে হয়নি। এপিএস জাহিদের সঙ্গে মিলেমিশে ‘ছায়া’ মন্ত্রী হিসেবে নিজেদের আবির্ভাব ঘটাতে থাকেন। এলজিইডি ও ঢাকা ওয়াসার কর্মকর্তাদের বদলি বাণিজ্য শুরু করেন তারা। এ ছাড়া প্রকল্পের ফাইল পাস করাতেও নিতেন টাকা। ১০ লাখ থেকে কোটি টাকা পর্যন্ত নিতেন। কয়েক বছরে মালিক হন কোটি কোটি টাকার। এরপর শুরু হয় প্লট এবং ফ্ল্যাট কেনা। শুরুতে একটি গুলশান এলাকায় ফ্ল্যাট কিনেন। এরপর বনানীতে ফ্ল্যাট কেনার তথ্য রয়েছে। জানা যায়, হাউজিং দিয়ে প্লট ব্যবসা প্রতিষ্ঠান দাঁড় করান। এই হাউজিংয়ে কিছু জায়গাও কিনেন তিনি। হাউজিংয়ে নিজস্ব অফিস নির্মাণ হলেও কোনো আবাসিক ভবন তৈরি হয়নি। এ ছাড়া মোবাইল ব্যাংকিং সেবা ‘নগদ’ এর এলাকা ভিত্তিক এজেন্ট কিনে নেন ভাতিজা। বাড্ডা, লাকসাম ও মনোহরগঞ্জ এলাকার এজেন্ট হন। সব শেষ সরকারের পটপরিবর্তনের আগে লাকসাম ও মনোহরগঞ্জের এজেন্ট ৫ কোটি টাকায় বিক্রি করে দিয়ে সে টাকা সিঙ্গাপুরে তার নিজস্ব অ্যাকাউন্টে স্থানান্তর করেন। আর বাড্ডার এজেন্সি সম্প্রতি তিনি বিক্রি করে দেন। একইসঙ্গে ঢাকার আমুলিয়ায় ব্লক ইট তৈরির কারখানা গড়ে তোলেন। সেই কারখানা থেকে মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন প্রকল্পে এই ব্লক ইট ব্যবহার করা হতো। আরও জানা যায়, এলজিইডি, ডিপিএইচই, ওয়াসাসহ বিভিন্ন দপ্তর ও সংস্থার টেন্ডারের ঠিকাদার নিয়োগ দিতেন। প্রতিটি টেন্ডার থেকে ১০% কমিশন তার জন্য ছিল বাধ্যতামূলক। আর বড় প্রকল্পে বিদেশি ঠিকাদার নিয়োগে তিনি বোঝাপড়া করতেন। ওই দুজন রাজধানীর একটি অভিজাত হোটেলে বড় বড় ঠিকাদার নিয়ে বৈঠক করে দেনদরবার করতেন। আর দপ্তর ও সংস্থার জন্য বিশেষ বরাদ্দের টাকাও তার হাত দিয়ে বণ্টন হতো। এর মধ্যে ২০% টাকা তিনি রেখে দিতেন। এসব করে রাতারাতি শত কোটি টাকার মালিক বনে যান। নিয়মিত ৫৫ লাখ টাকার দামি গাড়ি দিয়ে চলাচল করেন ভাতিজা।
এ প্রসঙ্গে সাবেক মন্ত্রী তাজুল ইসলামের এপিএস জাহিদ হোসেনের সঙ্গে একাধিকবার ফোনে যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হলে তা বন্ধ পাওয়া যায়।