সামরিক বাহিনীর প্রয়োজনীয় সংস্কার সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করতে একটি ‘ডিফেন্স রিফর্ম কমিশন’ গঠনের প্রস্তাব করা হয়েছে। অধ্যাপক আলী রীয়াজের নেতৃত্বাধীন সংবিধান সংস্কার কমিশনে সশস্ত্র বাহিনীর প্রাক্তন সদস্যদের একটি ফোরাম ‘জাস্টিস ফর কমরেডস’ মঙ্গলবার এ প্রস্তাব জমা দিয়েছে। প্রস্তাবে বিদ্যমান সংবিধানে থাকা ৪৫ অনুচ্ছেদসহ সংশ্লিষ্ট ধারা আমূল সংস্কারের দাবি জানানো হয়েছে। সংবিধানের ওই অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘কোন শৃঙ্খলা-বাহিনীর সদস্য-সম্পর্কিত কোন শৃঙ্খলামূলক আইনের যে কোন বিধান উক্ত সদস্যদের যথাযথ কর্তব্যপালন বা উক্ত বাহিনীতে শৃঙ্খলা রক্ষা নিশ্চিত করিবার উদ্দেশ্যে প্রণীত বিধান বলিয়া অনুরূপ বিধানের ক্ষেত্রে এই ভাগের কোন কিছুই প্রযোজ্য হইবে না।’ এতে সেনাবাহিনীতে মানবাধিকার লঙ্ঘনের পুনরাবৃত্তি বন্ধ হবে। আনুষ্ঠানিক প্রস্তাব হস্তান্তরকালে উপস্থিতি ছিলেন ব্রিগেডিয়ার (অব.) জেনারেল মোহাম্মদ হাসান নাসির, লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব.) হাসিনুর রহমান বীরপ্রতীক, লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব.) মুস্তাফিজুর রহমান ও কমান্ডার (বিএন, অব.) নেসার আহমেদ জুলিয়াস। উচ্চ আদালতের একজন বিচারপতির নেতৃত্বধীন ‘ডিফেন্স রিফর্ম কমিশনে’ মানবাধিকার কর্মী, সামরিক বাহিনীর কর্মকর্তা ও অবসরপ্রাপ্ত সামরিক কর্মকর্তা থাকবেন বলে প্রস্তাবে উল্লেখ করা হয়। চার পৃষ্ঠার লিখিত প্রস্তাবে কেন সামরিক আইন সংস্কার করা প্রয়োজন সেসবের যুক্তি তুলে ধরা হয়। পাশাপাশি অতীতে সামরিক বাহিনীর সদস্যদের ওপর ঘটে যাওয়া অবিচারের প্রসঙ্গ তোলা হয়েছে। লিখিত প্রস্তাবে সামরিক বাহিনীর জন্য সংবিধানে সুনির্দিষ্ট ৬টি বিষয়ের ওপর সংস্কারের প্রস্তাব দেওয়া হয়।
৪৫ অনুচ্ছেদের পর্যালোচনা : প্রস্তাবে বলা হয়, সংবিধানের ৪৫ অনুচ্ছেদের সংশোধন করে সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যদের সামরিক সিদ্ধান্তগুলোর বিচারিক পর্যালোচনার জন্য উচ্চ আদালতে প্রবেশাধিকারের সুযোগ দিতে হবে। এতে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক মান ও প্রথার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হয়ে উঠবে। পাশাপাশি অবিচার ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের পুনরাবৃত্তি বন্ধ হবে। অন্যায়ভাবে বরখাস্ত, পদত্যাগে বা অবসর নিতে বাধ্য করা সামরিক কর্মীদের পুনর্বহাল করা, তাদের উপযুক্ত পদমর্যাদায় উন্নীত করা, সম্পূর্ণ আর্থিক এবং অন্যান্য সুবিধাসহ অথবা পূর্ণ সম্মান এবং অন্যান্য সরকারি চাকরির প্রথা অনুযায়ী সুবিধাসহ অবসর নেওয়ার সুযোগ পুনঃস্থাপন করতে হবে। সদস্যদের যোগ্যতা এবং অভিজ্ঞতার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ সরকারি পদে সংহত করতে হবে। এর মধ্যে আছে, সশস্ত্র বাহিনী কল্যাণ সংস্থা (এসকেএস), আর্মি ওয়েলফেয়ার ট্রাস্ট, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, জাতীয় ও বাহিনীগত গোয়েন্দা সংস্থা, দুর্নীতি দমন কমিশন, ভূমি ও সমুদ্রবন্দর কর্তৃপক্ষ, করপোরেশন ও বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের অধীন স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান, গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা, আইন প্রয়োগকারী সংস্থা, কাস্টমস এবং ভ্যাট কর্তৃপক্ষ ইত্যাদি। সক্রিয় সেবা থেকে সামরিক অফিসারদের অসামরিক এবং ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানে নিযুক্ত করার প্রয়োজনীয়তাকে একটি স্বাধীন সংস্কার কমিশনের মাধ্যমে বিস্তারিত পর্যালোচনা করা প্রয়োজন। কমিশন অবসরপ্রাপ্ত এবং সাবেক প্রতিরক্ষা অফিসারদের বৃহৎ শিক্ষিত ও অভিজ্ঞ গোষ্ঠীকে কম বয়সে সংহত করার সুযোগগুলোও পর্যালোচনা করতে পারে। এর ফলে সামরিক বাহিনী সামরিক মিশন এবং লক্ষ্যের পথে যে কোনো ধরনের বিভ্রান্তি থেকে মুক্ত থাকতে পারবে। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক যুগ/পাকিস্তান আমলের প্রাচীন সামরিক আইন, নিয়ম ও নির্দেশাবলি একটি স্বাধীন সংস্কার কমিশনের মাধ্যমে বিস্তারিত পর্যালোচনা এবং সংস্কার করাই সামরিক বিচার ব্যবস্থায় মতো স্বচ্ছতা এবং জবাবদিহি নিশ্চিত করতে পারে। যারা অবিচারের জন্য দায়ী এবং যাদের ফলে প্রশিক্ষিত জনবল ও সরকারি অর্থের ক্ষতি হয়েছে, তাদের পদমর্যাদা বা অবস্থান নির্বিশেষে অবশ্যই জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে। এসব সংস্কারের যুক্তি তুলে ধরে প্রস্তাবে বলা হয়, ২০০৯ সাল থেকে বিগত শাসনামলে, বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর প্রায় ৩৫০-৪০০ কর্মকর্তা এবং ১ হাজার জন অন্যায়ভাবে বরখাস্ত, জোরপূর্বক পদত্যাগ/অবসর গ্রহণ, অতিরিক্ত শাস্তি এবং সামাজিক হয়রানিসহ অবিচারের শিকার হয়েছেন। এই কর্মগুলো প্রায়ই রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত লক্ষ্যবস্তুর ওপর ভিত্তি করে ছিল। এই ধরনের মামলা পরিচালনায় স্বচ্ছতার অভাব, একই অভিযুক্ত অপরাধের জন্য একাধিক কোর্ট-মার্শাল অন্তর্ভুক্ত এবং রায়ের যথেচ্ছ পরিবর্তন, ভুক্তভোগীদের জন্য উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিগত এবং পেশাগত দুর্ভোগের দিকে পরিচালিত করেছে। কর্মকর্তাসহ কেউ কেউ দীর্ঘস্থায়ী আর্থিক ক্ষতি এবং সামাজিক অবমাননার কারণে আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছেন। রাজনীতিবিদ ও সংস্থাগুলোর প্রভাবে এসব অন্যায় সংগঠিত হয়েছে। এর মধ্যে ছিল, অন্যায্য বরখাস্ত, জোরপূর্বক পদত্যাগ/অবসর, অসামঞ্জস্যপূর্ণ শাস্তি, অধিকার ও সুযোগ-সুবিধার ওপর বেআইনি নিষেধাজ্ঞা আরোপ।
সংস্কার প্রস্তাব প্রসঙ্গে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) মোহাম্মদ হাসান নাসির বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, সামরিক বাহিনীকে শুধু পোশাক বা অস্ত্রশস্ত্রে আধুনিক করলে হবে না, আইনকেও সংস্কার করতে হবে। বর্তমানে সামরিক বাহিনী যে আইন অনুসরণ করে সেটা ব্রিটিশ আমলের। এসব আইনে কর্তৃত্ববাদ আছে, মানবাধিকার নেই। সামরিক বাহিনীর জন্য পিএনজি নামক শাস্তির বিধান রয়েছে, এটা অসম্পূর্ণ অবৈধ। তিনি বলেন, অনুচ্ছেদ ৪৫ এবং সামরিক বাহিনী সংশ্লিষ্ট ধারা সংস্কার অনিবার্য হয়ে পড়েছে। প্রয়োজনে এসব ধারা বাতিল করে নতুন করে করতে হবে। সংবিধান সংস্কার কমিশনের পক্ষ থেকে আমাদের দাবি ও প্রস্তাবগুলো সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে দেখা হবে বলে জানিয়েছেন।