ডাকসুসহ তিনটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হচ্ছে। কিন্তু দেশবাসীর আগ্রহ ডাকসুকে ঘিরেই। ডাকসুকে বলা হয় বাংলাদেশের ‘দ্বিতীয় পার্লামেন্ট’। জাতীয় নির্বাচনের আগে ডাকসু নির্বাচন অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। এ নির্বাচনে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের কিছুটা হলেও প্রভাব থাকবে। ডাকসু নির্বাচন যদি শেষ পর্যন্ত সুন্দর, সুষ্ঠুভাবে হতে পারে, তাহলে নিঃসন্দেহে জাতীয় নির্বাচনের একটি আবহ তৈরি হবে, দেশের মানুষ স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলবে। ডাকসু নির্বাচনের সফলতা জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় এবং রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদ নির্বাচনকে সুষ্ঠুভাবে করতে উৎসাহ জোগাবে। অন্যদিকে শেষ পর্যন্ত ডাকসু নির্বাচনে যদি অনাকাঙ্ক্ষিত পরিবেশ তৈরি হয়, তাহলে মাশুল দিতে হবে গোটা দেশকে। এর ফলে গণতান্ত্রিক উত্তরণ হুমকির মুখে পড়তে পারে। ডাকসু নির্বাচন এমন একসময়ে হচ্ছে যখন শিক্ষার্থীদের নানান দাবিতে শিক্ষাঙ্গন এবং রাজপথ উত্তপ্ত। বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার চেয়ে আন্দোলন বেশি। জুলাই বিপ্লবের পর গত এক বছরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো ঠিকঠাকমতো শিক্ষাক্রম চালু করতে পারেনি, শিক্ষার্থীরা তাদের পাঠ্যক্রমে মনোযোগ দিতে পারেনি। এক্ষেত্রে অন্তর্বর্তী সরকারের ব্যর্থতা রয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকার শিক্ষা কাঠামোকে ঠিক করার জন্য শিক্ষাঙ্গনে পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে উপদেষ্টা বদল করেছে বটে কিন্তু তাতে কোনো কাজ হয়নি। ডাকসু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হচ্ছে ৯ সেপ্টেম্বর। ডাকসু নির্বাচনের যখন প্রচারণা শুরু হয়েছে, ঠিক সেই সময় বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) এবং অন্য প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়গুলো তিন দফা দাবিতে রাজপথে আন্দোলন শুরু করেছে। গত বুধবার (২৭ আগস্ট) এ আন্দোলন সহিংসতায় রূপ নিয়েছিল। সামনে এ আন্দোলনের প্রভাব কীভাবে পড়ে সেটি দেখার বিষয়।
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে চলছে অস্থিরতা। ডাকসুর নির্বাচন নিয়েও অস্বস্তি এবং নানা শঙ্কা আছে। চাপা উত্তেজনা উত্তাপ তৈরি হয়েছে নির্বাচনি প্রচারণায় প্রতিদ্বন্দ্বিতা। প্রতিদ্বন্দ্বিরা একে অন্যের বিরুদ্ধে আক্রমণ এবং প্রতি আক্রমণে ব্যস্ত। মাঝে মাঝেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসের পরিবেশ উত্তপ্ত হচ্ছে। একটি আতঙ্ক সৃষ্টির চেষ্টা করা হচ্ছে কোনো কোনো মহল থেকে। তবে অনেকে মনে করেন নির্বাচনে এ ধরনের পরিবেশ থাকাই স্বাভাবিক। শেষ পর্যন্ত সব মহল দায়িত্বশীল আচরণ করবে সেটি দেশবাসী প্রত্যাশা করে। ডাকসুর নির্বাচনে কে জয়ী হলো, কে পরাজিত হলো সেটি বড় কথা নয়। কিন্তু ডাকসু নির্বাচন যদি শেষ পর্যন্ত অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষভাবে অনুষ্ঠিত হয়, তাহলে সারা দেশে একটি স্বস্তির বার্তা দেবে।
আমরা লক্ষ্য করেছি যে, ডাকসু প্রতিষ্ঠা হওয়ার পর এর আগে ৩৭ বার নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। সর্বশেষ নির্বাচন হয়েছিল ২০১৯ সালে। সেই নির্বাচনটিও কলঙ্কিত হয়েছিল এবং ডাকসু নির্বাচনে ছাত্রলীগকে বিজয়ী করার জন্য প্রশাসন নানারকম অপকৌশল ব্যবহার করেছিল বলে অভিযোগ ওঠে। শিক্ষার্থীদের আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটেনি ওই নির্বাচনে। আর সে কারণে ২০১৯ সালে ডাকসু তেমন কোনো কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারেনি। ডাকসু শিক্ষার্থীদের সমস্যা ও আকাঙ্ক্ষা মেটাতে পারেনি।
স্বাধীনতার পর ৫৪ বছরে মাত্র সাতবার ডাকসু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। একমাত্র শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান নিয়মিতভাবে ডাকসু নির্বাচনের ব্যবস্থা করেছিলেন। সে সময় তিনটি ডাকসু নির্বাচনেই বামপন্থি ছাত্র সংগঠন জয়ী হয়েছিল। দুটিতে জাসদ ছাত্রলীগ এবং একটিতে মাহমুদুর রহমান মান্নার নেতৃত্বে বাসদ ছাত্রলীগ জয়ী হয়। এই গণতান্ত্রিক চর্চা হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ এসে বন্ধ করে দেন। এরশাদ শাসনামলের শেষ দিকে এসে ছাত্রদের চাপে দুটি ডাকসু নির্বাচন সম্পন্ন করেছিলেন। একটি নির্বাচনে বিজয়ী হয়েছিলেন সম্মিলিত ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ নেতা, ছাত্রলীগের সুলতান মাহমুদ মনসুর। পরে ডাকসু নির্বাচনে ছাত্রদল বিপুল ভোটে বিজয়ী হয়েছিল। ’৯০ সালে অনুষ্ঠিত ডাকসুর ওই নির্বাচনের পরপরই স্বৈরাচার পতনের আন্দোলন তীব্রতা পায়। আমান উল্লাহ আমান, খায়রুল কবির খোকনের নেতৃত্বে ডাকসু স্বৈরাচার পতনের ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে ১৫ বছরে মাত্র একবার ডাকসু নির্বাচন করে। সেই ডাকসু নির্বাচন এমনভাবে সাজানো হয়েছিল যেন ছাত্রলীগ বিজয়ী হয়। এবার ডাকসু নির্বাচনে আশা করা যায় যে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ, সরকার এবং কোনো পক্ষেরই কোনো স্বার্থ নেই। এখানে শিক্ষার্থীরা তাদের নিজেদের পছন্দের প্রার্থীকে নির্বাচিত করবে। ২৬ আগস্ট থেকে শুরু হওয়া প্রচারণার ধরন দেখলে বোঝা যায় ডাকসুতে জাতীয় রাজনীতির চেয়ে ক্যাম্পাসের দাবি-দাওয়া, সমস্যা এসেছে বেশি। বিশেষ করে আবাসন সংকট, শিক্ষার মানোন্নয়ন, লাইব্রেরি, গবেষণা ইত্যাদি বিষয় নির্বাচনি প্রচারণায় প্রাধান্য পাচ্ছে। এটি ইতিবাচক। তবে একটা কথা মনে রাখতে হবে, ডাকসু নির্বাচন যে কোনো মূল্যে সুন্দর এবং সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করতে হবে। এক্ষেত্রে শুধু ক্যাম্পাসে ক্রিয়াশীল ছাত্র সংগঠনগুলো নয়, দেশের রাজনৈতিক দল এবং সরকারকেও দায়িত্বশীল আচরণ করতে হবে।
প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস ইতোমধ্যে আগামী ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ঘোষণা দিয়েছেন। সেই অনুযায়ী নির্বাচন কমিশন কাজ শুরু করে দিয়েছে। নির্বাচন বানচালের জন্য নানা মহল নানা রকম চক্রান্তে লিপ্ত রয়েছে। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর অভিযোগ করেছেন, ‘সরকারের ভিতরের একটি অংশ নির্বাচন বানচালের চেষ্টা করছে।’ তিনি নিশ্চয়ই জেনেবুঝে এ অভিযোগ করেছেন। বাস্তবিকই সরকারের কিছু কিছু উপদেষ্টা এবং সরকারের কিছু মহলের কর্মকাণ্ডে মনে হয় যে, নির্বাচনের ব্যাপারে তাদের নেতিবাচক মনোভাব রয়েছে। এটি অনাকাঙ্ক্ষিত। যে কোনো অবস্থাতেই আগামী বছরের ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে হবে। একটি গণতান্ত্রিক ধারায় দেশকে এগিয়ে নিতে হবে। নির্বাচিত সরকার ছাড়া বিদ্যমান সংকট সমাধানের কোনো পথ নেই। ড. মুহাম্মদ ইউনূস তাঁর প্রতিশ্রুতিতে অটল রয়েছেন কিন্তু নির্বাচনের আগে অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার, দেশে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি, মব সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি বন্ধের যে প্রয়োজনীয়তা রয়েছে সেটির ব্যাপারে এখন পর্যন্ত নজরদারির অভাব রয়েছে। তবে সবাই আশা করেন যে, নির্বাচন কমিশনের আনুষ্ঠানিক কার্যক্রম শুরুর পর থেকে এ বিষয়ে সরকার কাজ শুরু করবে। রাজনৈতিক দলগুলো একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনে নির্বাচন কমিশনকে সহযোগিতা করবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সবসময় বাংলাদেশকে পথ দেখায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সবসময় আমাদের আলোকিত করে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মাধ্যমে এদেশের মানুষ অধিকার আদায়ের সংগ্রামে ভূমিকা রাখে। ১৯৭১, ১৯৯০ এবং ২০২৪ সালের গণ অভ্যুত্থান সবচেয়ে বড় প্রমাণ। কাজেই আগামী ৯ সেপ্টেম্বর যে ডাকসু নির্বাচন হবে, সেই নির্বাচন যদি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হয়, একটি অনুকরণীয় নির্বাচন যদি হয়, তাহলে সেটি আগামী জাতীয় নির্বাচনের পথ দেখাবে। সবাই একটি সুষ্ঠু গণতান্ত্রিক ধারার বাংলাদেশ বিনির্মাণের ব্যাপারে আশাবাদী হবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছিল ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনের কেন্দ্রস্থল। এখান থেকেই আন্দোলন দানা বেঁধে উঠেছিল। কাজেই তারা এখন গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় উত্তরণে ডাকসু নির্বাচন বাংলাদেশকে পথ দেখাবে। আগামী জাতীয় নির্বাচনের জন্য এটি অনুপ্রেরণা হবে। তাই আমরা আশা করি যে, সব ছাত্র সংগঠন সহিষ্ণুতার পরিচয় দেবে, গণতন্ত্রের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ দেখাবে। এখানে জয়-পরাজয় বড় কথা নয়, আন্দোলনে জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় যেমন পথপ্রদর্শক, ঠিক তেমনিভাবে একটি সুষ্ঠু ডাকসু নির্বাচন উপহার দিয়ে গণতন্ত্র চর্চার উদাহরণ তৈরি করবে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। আর সে কারণেই ডাকসু নির্বাচন বাংলাদেশে জাতীয় নির্বাচনের আগে একটি মহড়া। এটি গণতন্ত্রের অগ্নিপরীক্ষাও বটে।