চলমান রাজনৈতিক অস্থিরতা ও বিদেশি অর্থায়নে প্রকল্প বাস্তবায়নের ধীরগতির পরিপ্রেক্ষিতে ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে (এডিপি) বিদেশি সহায়তায় বড় ধরনের কাটছাঁট করতে যাচ্ছে অন্তর্বর্তী সরকার। পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের এক লাখ কোটি টাকা থেকে প্রায় ১৪ হাজার কোটি টাকা কমিয়ে আগামী অর্থবছরের বাজেটে বিদেশি সহায়তা বরাদ্দ ৮৬ হাজার কোটি টাকা নির্ধারণ করার কথা ভাবছে সরকার। যা আগের তুলনায় প্রায় ১৬ শতাংশ কম। মূল বরাদ্দ কমানো হলেও, এটি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের সংশোধিত লক্ষ্যমাত্রা ৮১ হাজার কোটি টাকার তুলনায় ৫ হাজার কোটি টাকা বেশি। উল্লেখ্য, আগস্টে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর বিদেশি সহায়তা ব্যবহারে দুর্বলতার কারণে চলতি অর্থবছরে বরাদ্দ ১৯ হাজার কোটি টাকা কমিয়ে সংশোধন করা হয়।
২০২৩-২৪ অর্থবছরে বিদেশি সহায়তা বরাদ্দ ছিল ৯৪ হাজার কোটি টাকা (পরবর্তীতে সংশোধিত হয়ে ৮৩ হাজার কোটি টাকা) এবং এর আগের বছরেও প্রায় ৯৩ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ ছিল। বাস্তবায়নে প্রতিবন্ধকতা : ২০২৪ সালের জুলাইয়ে হঠাৎ সহিংস আন্দোলনের ফলে শেখ হাসিনা সরকারের পতন হয় এবং নোবেল বিজয়ী অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে একটি অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়। চাপ কমাতে সরকার রাজনৈতিকভাবে প্রভাবিত প্রকল্পগুলো পুনর্মূল্যায়ন ও ব্যয় সাশ্রয়ী নীতি গ্রহণ করে। বিগত সরকারের ঘনিষ্ঠ অনেক ঠিকাদার প্রকল্প ত্যাগ করলে বিদ্যমান প্রকল্প বাস্তবায়ন আরও ধীরগতির হয়ে পড়ে। ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম ৯ মাসে এডিপি বাস্তবায়নের হার মাত্র ৩৬ দশমিক ৬৫ শতাংশে নেমে এসেছে, যা গত পাঁচ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন। এই সময়ে ব্যয় হয়েছে ৮২ হাজার ৮৯৪ কোটি টাকা, যেখানে গত অর্থবছরের একই সময়ে ব্যয় ছিল ১ লাখ ৭ হাজার ৬১২ কোটি টাকা বা ৪২ দশমিক ৩ শতাংশ। এমনকি মহামারির বছর ২০২০-২১ অর্থবছরেও এই হার ছিল ৪১ দশমিক ৯১ শতাংশ। চলতি অর্থবছরের জুলাই-মার্চ সময়কালে বিদেশি সহায়তা ব্যবহারের হার ছিল মাত্র ৩২ দশমিক ৫ শতাংশ বা ৩২ হাজার ৪১১ কোটি টাকা, যেখানে আগের বছর একই সময়ে ছিল ৪৬ দশমিক ৮ শতাংশ বা ৪৪ হাজার ৬৬ কোটি টাকা।
কাঠামোগত দুর্বলতা : অর্থ মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বলছেন, বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বাস্তবায়নকারী সংস্থার দক্ষতার ঘাটতি ও কাঠামোগত দুর্বলতা কম বরাদ্দের মূল কারণ। একজন কর্মকর্তা বলেন, ‘বাস্তবায়ন সক্ষমতার ক্ষেত্রে তেমন কোনো অগ্রগতি হয়নি। তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে সামগ্রিক বাজেট আকার সংকুচিত হওয়ার সম্ভাবনা, ফলে সম্পদের অগ্রাধিকার বেছে নিতে হচ্ছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, চলমান রাজনৈতিক রূপান্তর প্রকল্প বাস্তবায়ন আরও জটিল করে তুলেছে। গত কয়েক বছরে বিদেশি সহায়তা ব্যবহারে উন্নতির চেষ্টা সত্ত্বেও ব্যবস্থাগত সীমাবদ্ধতা বিদ্যমান। ২০২৪ সালের জুলাই পর্যন্ত বাংলাদেশের ৪২ দশমিক ৮৫ বিলিয়ন ডলার বিদেশি সহায়তা অব্যবহৃত ছিল। এমনকি চলতি বছরের বরাদ্দ পুরোপুরি ব্যয় হলেও তা মোট সহায়তার মাত্র ১৬ শতাংশ।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, ২০ শতাংশ ব্যবহারের হারকেই সন্তোষজনক ধরা হয়। ২০১০-১১ থেকে ২০২০-২১ অর্থবছর পর্যন্ত এই হার ছিল ১১ শতাংশ থেকে ১৩ শতাংশের মধ্যে, যা ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বেড়ে ১৯ শতাংশ হয়েছিল। অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রকল্প বাস্তবায়নে বিলম্ব, ব্যয় ও সময় অতিরিক্ত হওয়া এবং দেশীয় ঋণের ওপর নির্ভরতা বৃদ্ধির ফলে ভারসাম্যহীনতা বাড়ছে। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, দুর্বল প্রকল্প পরিকল্পনা, যথাযথ সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের অভাব, প্রকল্প কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণের অভাব, সংস্থাগুলোর মধ্যে সমন্বয়হীনতা সবচেয়ে বড় সমস্যা।
এ ছাড়াও প্রকল্প প্রস্তাব বারবার সংশোধন, অনুমোদনে দীর্ঘসূত্রতা, দক্ষ জনবলের অভাব, ঘন ঘন কর্মকর্তার বদলি, ক্রয় বিলম্ব এবং জমি অধিগ্রহণে জটিলতা প্রকল্প বাস্তবায়নে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় বলছে, এসব অকার্যকারিতা প্রকল্প ব্যয় বাড়ানোর পাশাপাশি ঋণদাতাদের কাছে উচ্চতর প্রতিশ্রুতি সুদের বোঝা তৈরি করছে। তাই ২০২৫-২৬ অর্থবছরের এডিপিতে বিদেশি সহায়তা বরাদ্দ কমানোর সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন সক্ষমতার সঙ্গে খাপ খাইয়ে উন্নয়ন পরিকল্পনা সাজানোর লক্ষ্য নেওয়া হয়েছে।