মঙ্গলবার, ১২ জানুয়ারি, ২০১৬ ০০:০০ টা

একে একে উদ্ধার হলো ১১ নারীর লাশ

মির্জা মেহেদী তমাল

একে একে উদ্ধার হলো ১১ নারীর লাশ

২০০৭ থেকে ২০০৯ সালের জুলাই মাস। এ সময়ের মধ্যে চাঁদপুরের ফরিদগঞ্জে ছয়টি লাশ উদ্ধার করল পুলিশ। লাশগুলোর সবই থেকে যাচ্ছিল অজ্ঞাতনামা। শ্রেণি-পেশায় মিল ছিল না কোনো লাশের। তবে একটি জায়গায় মিল ছিল—সব লাশই নারীর। ধর্ষণের পর কে বা কারা তাদের খুন করে ফেলে রাখছে খালে, বিলে, নদীতে এর কোনো হদিস বের করা সম্ভব হচ্ছিল না। পুলিশ যখন খুনের আলামত খুঁজে পেতে দিশাহারা, তখন নিরাপদে আরও খুন করে বেড়াচ্ছিল খুনি। এই যখন অবস্থা তখন একটি ফ্যান চুরির মামলা খুলে দিল হত্যারহস্য উন্মোচনের পথ। ধরা পড়ল সেই খুনি। সে হলো চাঁদপুরের নরপিশাচ রসু খাঁ।

শুধু ফরিদগঞ্জের এই ছয়টিই নয়, রোমাঞ্চকর গল্পের চরিত্রের মতো ১১ নারীকে খুন করে নিরাপদে পালিয়ে ছিল রসু খাঁ। স্বীকার করল পুলিশের কাছে। স্বীকার করল ১০১ নারীকে খুন করার শপথ নেওয়ার কথা। সেই থেকে রসু খাঁ দেশের ইতিহাসে অবিস্মরণীয় সিরিয়াল কিলারের নাম। সেই রসু খাঁ এখন জেলখানায় বন্দী। বিচারের মুখোমুখি বীভৎস সেসব খুনের ঘটনায়। রসু গ্রেফতারের পর চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয় সারা দেশে। একে একে খুনের ঘটনাগুলো ফাঁস হওয়ার পর গোয়েন্দারা রীতিমতো হতবাক হয়ে পড়েন। ২০০৯ সালের ৭ অক্টোবর রাতে গাজীপুর জেলার টঙ্গীর নিরাশপাড়া এলাকার বাসা থেকে গ্রেফতার করা হয় রসুকে। ফ্যান চুরির ঘটনায় রসুর মোবাইল ফোনের কলের তালিকা পরীক্ষা করে পুলিশ। গ্রেফতারের পর তাকে দেখানো হলো আগের দুই বছরে ফরিদগঞ্জের বিভিন্ন এলাকা থেকে উদ্ধার করা নারীদের লাশের ছবি। দেখে দেখে শনাক্ত করল রসু। জানাল খুনের ভয়ঙ্কর কাহিনী। তার মুখ দিয়ে বেরিয়ে এলো ১১ খুনের স্বীকৃতি, ফরিদগঞ্জের ছয় খুনের বর্ণনা এবং ১০১ নারীকে খুনের শপথের কথা। পুলিশ ও তদন্ত-সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের কাছ থেকে জানা গেছে সেসব রোমহর্ষক কাহিনী। সূত্র জানায়, নানা কৌশলে মেয়েদের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তাদের নিয়ে অভিসারে যাওয়ার কথা বলে একের পর এক হত্যা করত রসু খাঁ। শুধু খুনেই এই নরপিশাচের প্রতিহিংসার সমাপ্তি ঘটেনি, খুনের আগে কোনো কোনো ক্ষেত্রে ওই নারীদের ধর্ষণও করে সে। রসু খাঁর পিশাচজীবনের শুরু ২০০৭ সালের প্রথম দিকে শ্যালক মান্নানের স্ত্রী রিনাকে হত্যার মধ্য দিয়ে। রিনার বাড়ি হাতিয়ায়। মিথ্যা বলে ফরিদগঞ্জের ভাটিয়ালপুরে এনে ধর্ষণের পর শ্বাসরোধে হত্যা করে ডাকাতিয়া নদীর পারে ফেলে দেওয়া হয় তাকে। এরপর রসু খাঁ একে একে চালায় আরও ১০টি হত্যাযজ্ঞ। যাদের খুন করা হয় তাদের বয়স ১৭ থেকে ৩৫ বছরের মধ্যে। হত্যার আগে শুধু পছন্দের নারীদেরই ধর্ষণ করত দাবি করে রসু খাঁ জানায়, সবাইকে সে শ্বাসরোধে হত্যা করেছে। চাঁদপুরের জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আমিরুল ইসলামের আদালতে ১৬৪ ধারায় রসু জবানবন্দি দেয়। এতে ফরিদগঞ্জে সংঘটিত সব খুনের বর্ণনা দেয় সে। সর্বশেষ ওই বছরের ২০ জুলাই ফরিদগঞ্জের হাসা গ্রামের একটি খালপাড়ে রসু ও তার ভাগ্নে জহিরুল মিলে পালাক্রমে ধর্ষণ শেষে খুন করে পারভীন নামের এক নারীকে। এর আগে ২০০৭ সালে ফরিদগঞ্জের ভাটিয়ালপুরে শহিদা নামে আরেক নারীকে ধর্ষণের পর খুন করে রসু। একই বছর ফরিদগঞ্জের প্রত্যাশী এলাকায় বন্ধু মানিকের প্রেমিকা আঙ্গুর বেগম বন্ধুর সঙ্গে প্রতারণা করায় ফরিদগঞ্জে এনে তাকে খুন করে রসু। ২০০৯ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি টঙ্গীতে ভাড়া থাকার সময় পাশের ভাড়াটিয়ার ছোট ভাই শাহিনের সঙ্গে এক মেয়ে প্রতারণা করায় তাকেও ফরিদগঞ্জের হাসা গ্রামে এনে ধর্ষণের পর পানিতে চুবিয়ে হত্যা করে রসু। ২০০৭ সালে ওই গ্রামের হোসনে আরা নামে একজন এবং একই বছর বালিথুবায় বিআর খালে পলাশ নামে আরেক নারীকে নির্যাতনের পর হত্যা করে সে। ২০০৮ সালের ১৮ ডিসেম্বর ফরিদগঞ্জের নানুপুর খালপাড়ে এনে ধর্ষণ শেষে খুন করে ফরিদপুুরের শহিদাকে। ওই বছর ২৩ ডিসেম্বর দক্ষিণ বালিয়া গ্রামে এনে খুন করে কুমিল্লার কোহিনূরকে। ২০০৯ সালের ১৩ মার্চ উপজেলার দুর্গাদি গ্রামে এনে খুন করা হয় রংপুরের মেয়ে মেহেদীকে। রসুর হাতে খুন হওয়া নারীদের লাশগুলো উদ্ধারের পর পুলিশ অজ্ঞাত বলে শনাক্ত করলেও প্রতিটি ক্ষেত্রে মামলা হয়েছে। এর মধ্যে ফরিদগঞ্জ থানায় ছয়টি, চাঁদপুর সদর থানায় চারটি ও হাইমচর থানায় একটি। এদিকে চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারে প্রায়ই ভাবলেশহীন থাকে বহুল আলোচিত সিরিয়াল কিলার রসু খাঁ। তবে হঠাৎ বিগড়ে যায় সে। বিনা কারণে সাধারণ কয়েদিদের মেরে ফেলার হুমকিও দেয় রসু। নাম প্রকাশ না করার শর্তে একই ওয়ার্ডে থাকা সদ্য জামিনপ্রাপ্ত এক আসামি এসব কথা বলেন। রসু খাঁর ১১ মামলার মধ্যে চট্টগ্রাম বিভাগীয় দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে বিচারাধীন চারটি হত্যা মামলা শুনানি শেষে চাঁদপুরের আদালতে ফেরত পাঠানোর আদেশ দিয়েছেন বিচারক রবিউল হাসান। চাঁদপুরে রুনা, কোহিনূর আক্তার, পারভিন আক্তার ও জাহানারা খাতুনকে ধর্ষণের পর হত্যার অভিযোগে রসু খাঁর বিরুদ্ধে সদর থানায় পৃথক চারটি মামলা করা হয়।

ফাঁসির রায় : খুলনার এক নারীকে চাঁদপুরে এনে ধর্ষণের পর হত্যার দায়ে ‘আত্মস্বীকৃত সিরিয়াল কিলার’ রসু খাঁর ফাঁসির রায় দেন একটি আদালত। গত বছর ২২ এপ্রিল চাঁদপুরের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের বিচারক অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ অরুণাভ চক্রবর্তী এ রায় ঘোষণা করেন। রায়ে একটি ধারায় আসামিকে মৃত্যুদণ্ডের পাশাপাশি ৫০ হাজার টাকা জরিমানা করেন বিচারক। এ ছাড়া অন্য একটি ধারায় তাকে আট বছরের কারাদণ্ড ও ১০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়। মামলার বিবরণে বলা হয়, ২০০৮ সালের ১৮ আগস্ট ফরিদগঞ্জের নানুপুর খালপাড়ে খুলনার দৌলতপুরের সজলা গ্রামের সাহিদা বেগমকে ধর্ষণের পর হত্যা করে রসু। পরে পুলিশ সাহিদার হাত-পা বাঁধা লাশ উদ্ধার করে।

পপি হত্যা মামলায় খালাস : ফরিদপুরের কিশোরী পপি ধর্ষণ ও হত্যার ঘটনায় বিভাগীয় দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল বেকসুর খালাস দিয়েছেন রসু খাঁকে। তবে গ্রেফতারের পর পপিকে রসু হত্যার কথা স্বীকার করে জবানবন্দি দিয়েছিল।

সর্বশেষ খবর