শনিবার, ২৬ সেপ্টেম্বর, ২০২০ ০০:০০ টা

পিঁয়াজে সমস্যা কোথায়

কাজে লাগছে না কোনো উদ্যোগ, চাহিদা ও জোগানে ঘাটতি

রুকনুজ্জামান অঞ্জন

পিঁয়াজে সমস্যা কোথায়

দেশে এখনো পিঁয়াজের মজুদ আছে প্রায় ৫ লাখ মেট্রিক টন। চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে আরও ৬ লাখ মেট্রিক টন আমদানির উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। আমদানি শুল্ক কমানো হয়েছে। ৩০ টাকা কেজির পিঁয়াজ নিয়ে বাজারে নেমেছে টিসিবি। মজুদ বন্ধ করতে মাঠে আছেন গোয়েন্দারা। অতি মুনাফা আর কারসাজি বন্ধে ঘুরছে মনিটরিং টিম। কিন্তু কোনো উদ্যোগেই কাজে আসছে না। ভারত পিঁয়াজ রপ্তানি বন্ধ ঘোষণার পর  দেশি পিঁয়াজের দাম দ্বিগুণ বেড়ে ১০০ টাকায় ওঠার পর এখনো কমবেশি সেই দামেই বিক্রি হচ্ছে পণ্যটি। আমদানি পিঁয়াজ এখনো ৮০ থেকে ৯০ টাকা কেজি দরে দাম হাঁকা হচ্ছে। বাজার বিশ্লেষকরা বলছেন, বারবার একই ধরনের সংকট তৈরি হওয়ার পরও পিঁয়াজের মূল সমস্যাটি কোথায়, কেন সতর্কতার পরও সংকট সমাধানে গৃহীত উদ্যোগ কাজে লাগছে না সরকারের সংশ্লিষ্টদের উচিত সে বিষয়গুলো গভীরভাবে খতিয়ে দেখা। বাজারের সাধারণ সূত্র মেনে শুধু চাহিদা ও জোগানের মধ্যে সমন্বয়হীনতার কারণেই পিঁয়াজ নিয়ে এই সংকট নাকি অভ্যন্তরীণ উৎপাদন ও ভোগের পরিসংখ্যানগত ত্রুটির কারণে বারবার এমনটি ঘটছে- যার সুযোগ নিচ্ছে অসাধু ব্যবসায়ীরা, এসব বিষয়েও অনুসন্ধান করতে হবে। অন্যথায় কোনো উদ্যোগেই থামানো যাবে না, পিঁয়াজের দামে কারসাজি আর অতি মুনাফাখোরি।

জানা গেছে, পিঁয়াজের উৎপাদন ও বাজার পরিস্থিতির ওপর একটি বিশ্লেষণাত্মক প্রতিবেদন বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে জমা দিয়েছে ট্যারিফ কমিশন। ওই প্রতিবেদনে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের তথ্য দিয়ে চাহিদা ও স্থানীয় উৎপাদন বিষয়ে বলা হয়েছে : দেশে পিঁয়াজের বার্ষিক চাহিদা প্রায় ২৫ লাখ মেট্রিক টন। গত অর্থবছরে পিঁয়াজের স্থানীয় উৎপাদন ছিল ২৫ দশমিক ৫৭ লাখ টন। এর মধ্যে ২২ থেকে ২৫ শতাংশ সংগ্রহ ও সংরক্ষণের সময় নষ্ট হয়ে যাওয়ায় দেশে উৎপাদিত পিঁয়াজের পরিমাণ দাঁড়ায় ১৯ লাখ মেট্রিক টন প্রায়। ট্যারিফ কমিশনের তথ্য অনুযায়ী  দেখা যাচ্ছে পণ্যটির ঘাটতি আছে প্রায় ৬ লাখ মেট্রিক টন। অর্থাৎ এই ঘাটতি পূরণ করতে হবে আমদানি দিয়ে।

আমদানি পরিস্থিতি : বাংলাদেশ ব্যাংকের বরাত দিয়ে ট্যারিফ কমিশন ওই প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে আগস্ট পর্যন্ত দেশে পিঁয়াজ আমদানির পরিমাণ ৪ লাখ ৩৬ হাজার টন। ২০১৯ ও ২০১৮ সালের আগস্ট থেকে জানুয়ারি পর্যন্ত আলোচ্য সময়ে আমদানির পরিমাণ ছিল যথাক্রমে ৬ লাখ ৭৪ হাজার মেট্রিক টন ও ৬ লাখ ৯৬ হাজার মেট্রিক টন। অর্থাৎ গত দুই অর্থবছরে যে পরিমাণ আমদানি হয়েছে আগস্ট পর্যন্ত এবার তার চেয়ে প্রায় আড়াই লাখ মেট্রিক টন কম হয়েছে।

বিশ্লেষকরা বলছেন, অভ্যন্তরীণ উৎপাদনে ঘাটতি ৬ লাখ মেট্রিক টন আর সময়ের তুলনায় আমদানিতে ঘাটতি আরও আড়াই লাখ মেট্রিক টন। সরকারি পরিসংখ্যান অনুযায়ী দেশে এখন প্রায় সাড়ে ৮ লাখ মেট্রিক টন পিঁয়াজের জোগান কম আছে। বড় আকারের এই ঘাটতি সম্পর্কে ব্যবসায়ীরা ওয়াকিবহাল। ফলে তারা দেশি সংরক্ষণযোগ্য পিঁয়াজ ধরে রেখে এক ধরনের মূল্য কারসাজি করে থাকতে পারেন।  

কনজুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)-এর সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, পিঁয়াজের চাহিদা ও জোগানের মধ্যে সমস্যা আছে, এর সুযোগ নিচ্ছে ব্যবসায়ীরা। এ কারণে সরকার নানা ধরনের উদ্যোগ নিলেও সেটি কাজ করছে না। সাবেক এই সচিব অবশ্য প্রত্যাশা করছেন, পরিস্থিতি অস্বাভাবিক হলেও গতবারের মতো এবার পণ্যটির দাম অসহনীয় হবে না। 

গতবারের অভিজ্ঞতা কী বলছে : গত বছরও ঠিক সেপ্টেম্বর মাসে এই একই কারণে অর্থাৎ অতিবৃষ্টি ও বন্যায় পণ্যটির উৎপাদন ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় ভারত রপ্তানি নিষেধাজ্ঞা দেয়। এতে করে পণ্যটির দাম দেশের বাজারে বাড়তে বাড়তে ৩০০ টাকায় ওঠে। এবারও একই ঘটনা ঘটেছে। তবে গতবার নিষেধাজ্ঞার আগে ভারত রপ্তানি মূল্য বেঁধে দিয়েছিল একাধিকবার। মূল্য নিয়ন্ত্রণে না থাকায় শেষে ২৯ সেপ্টেম্বর নিষেধাজ্ঞা দেয়। এবার কিন্তু সে ধরনের কোনো ঝুঁকি নেয়নি দেশটির। মহারাষ্ট্রের নাসিকে পণ্যটির দাম ৩০ রুপিতে ওঠার পরই প্রথম দফাতেই নিষেধাজ্ঞা জারি করে দিয়েছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ভারত যে শিক্ষা গতবার পেয়েছিল, তা থেকে তারা এবার ছিল অতিরিক্ত সতর্ক। ফলে পণ্যটির দামের ঊর্ধ্বগতির শুরুতেই তারা পণ্যটি রপ্তানি বন্ধ করে দিয়েছে। এ ক্ষেত্রে দেশটি পিঁয়াজের দামের চেয়ে যে বিষয়টিতে নজর দিয়েছিল তা হলো আবহাওয়ার পূর্বাভাস। প্রযুক্তির কারণে এখন পরবর্তী ৩ থেকে ৬ মাসের আবহাওয়া-বৃষ্টিপাত সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়, ভারত যখন দেখল এবার সেপ্টেম্বরে একটি নিম্নচাপ সৃষ্টি হতে পারে যার ফলে মাসজুড়েই চলতে পারে অতিবৃষ্টি এমনকি বন্যা দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে, তখন তারা শুরুতেই আটকে দিয়েছে পণ্যটি। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কৃষিপণ্য হিসেবে পিঁয়াজ উৎপাদন ও আমদানি পর্যায়ে আবহাওয়াজনিত পূর্বাভাসকে আমলে নেয়নি সরকার?

গত বছর অতিবৃষ্টি ও বন্যার কারণে পণ্যটির দাম ৩০০ টাকায় ওঠার পর রাষ্ট্রায়ত্ত গবেষণা সংস্থা বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বিআইডিএস)-এর জ্যেষ্ঠ গবেষণা ফেলো ড. নাজনীন আহমেদের নেতৃত্বে ‘অনিয়ন মার্কেট অব বাংলাদেশ : রোল অব ডিফরেন্ট প্লেয়ার্স অ্যান্ড অ্যাসেজিং কম্পিটিটিভনেস’ নামক একটি গবেষণা প্রতিবেদন প্রতিযোগিতা কমিশনে জমা দেওয়া হয়েছিল। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, যেহেতু বাংলাদেশের পিঁয়াজের বাজার ভারতনির্ভর। এ বিষয়টি আগাম মনিটরিং করে বিকল্প বাজার খুঁজলে বর্তমান পরিস্থিতি এড়ানো সম্ভব হতো। বাংলাদেশে পিঁয়াজের মূল্য নিয়ন্ত্রণে ভারতের বাজার সব সময় পর্যবেক্ষণ জরুরি। ভারতে বন্যার সময় থেকেই বাংলাদেশের আরও সতর্ক হয়ে বিকল্প বাজার খোঁজা জরুরি ছিল বলে গবেষণা প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছিল।  গতকাল সন্ধ্যায় টেলিফোনে যোগাযোগ করা হলে ড. নাজনীন আহমেদ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, গতবারই আমরা গবেষণা প্রতিবেদনে সরকারকে সতর্ক করে দিয়েছিলাম, ভারতের বাজারের ওপর মনিটরিং বাড়াতে। এবারও একই পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। কিন্তু পার্শ্ববর্তী দেশটির বাজার সরকার ভালোভাবে মনিটরিং করেনি। বিআইডিএস’র এই সিনিয়র ফেলো বলেন, বৃষ্টি ও বন্যা পরিস্থিতি যেহেতু পিঁয়াজের মতো পচনশীল কৃষিপণ্যের উৎপাদন ও আমদানিতে প্রভাব ফেলে, সে কারণে বিকল্প দেশ থেকে আগেভাগেই আমদানির উদ্যোগ নেওয়া উচিত ছিল। পাশাপাশি অন্তত জুলাই মাস থেকে আবহাওয়া পূর্বাভাসের দিকে গুরুত্বের সঙ্গে নজর রাখা উচিত ছিল।

গোলাম রহমান বলেন, কৃষিপণ্য উৎপাদন আবহাওয়ার সঙ্গে জড়িত, তবে বাস্তবতা হচ্ছে- যে দেশ থেকে আমদানি হবে, সেই দেশের উৎপাদনে আবহাওয়া কী ধরনের প্রভাব ফেলবে সেটি বলা সহজ নয়। তিনি বলেন, ভারতের সঙ্গে আমাদের একটি সমঝোতা ছিল, তারা নিত্যপণ্য রপ্তানি নিষেধাজ্ঞার আগে বাংলাদেশকে জানাবে। এবার পিঁয়াজের ক্ষেত্রে যেটি হলো এটিকে সুপ্রতিবেশীসুলভ আচরণ বলা যায় না। পরিস্থিতি যাই হোক পিঁয়াজের সংকট কাটাতে উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের জন্য কৃষকের কাছে ভালো বীজ পৌঁছে দেওয়ার পাশাপাশি কৃষিপণ্যটি সঠিকভাবে সংরক্ষণের দিকে সরকারকে গুরুত্ব দেওয়ার পরামর্শ দেন তিনি।

 

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর