শুক্রবার, ৬ নভেম্বর, ২০২০ ০০:০০ টা

পুরান ঢাকার ঐতিহ্য হোসনি দালান

মোস্তফা মতিহার

পুরান ঢাকার ঐতিহ্য হোসনি দালান

শিয়াদের অনন্য স্থাপনা হোসনি দালান ইমামবাড়া। শিয়াদের উপাসনালয় এবং কবরস্থান। এটি পুরান ঢাকার চকবাজার থানার অন্তর্গত ২৭ নম্বর ওয়ার্ডের চানখারপুলের তেজপাতা গলিতে অবস্থিত। ইমারতের শিলালিপিতে ফারসি ভাষায় লেখা কবিতা অনুসারে এর প্রকৃত উচ্চারণ হোসায়নি দালান। ৬১ হিজরির ১০ মহররম অর্থাৎ ৬৮০ সালের ১০ অক্টোবর ইরাকের কারবালা প্রান্তরে শহীদ হন মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর নাতি ইমাম হুসাইন (রা.)। তাঁর স্মরণে স্মৃতিসৌধ হিসেবে নির্মাণ করা হয় এই হোসনি দালান। দালানটি সাদা রঙের এবং এর বহিরাংশে নীল রঙের ক্যালিগ্রাফি বা লিপিচিত্রের কারুকাজ রয়েছে। উঁচু মঞ্চের ওপর ভবনটি নির্মিত। পূর্বদিকের সিঁড়ির সাহায্যে এই মঞ্চে উঠতে হয়। পাশাপাশি সংযুক্ত দুটি হলরুম নিয়েই মূল ইমারতটি। এর মধ্যে দক্ষিণমুখী ‘শিরনি’ হলটি ইমাম হুসাইনের মৃত্যুর জন্য দুঃখ ও শোক প্রকাশের উদ্দেশ্যে কালো রং করা হয়েছিল। উত্তরমুখী ‘খুতবা’ হলে রয়েছে সাত ধাপবিশিষ্ট একটি কাঠের তৈরি মিম্বার। শেষের হলরুমটিতে ধর্মীয় বিভিন্ন প্রতীক ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। এই দুটি হলের ডানে ও বামে নারীদের জন্য দ্বিতলবিশিষ্ট সম্পূরক হলরুম নির্মিত হয়েছে। দক্ষিণ দিকের সম্মুখভাগের দুই প্রান্তে দুটি তিনতলা বহুভুজ ফাঁপা বুরুজ রয়েছে। বুরুজগুলোর শীর্ষে রয়েছে গম্বুজ। ইমারতের দক্ষিণাংশে বর্গাকৃতির পুকুর ও উত্তরাংশে শিয়া বংশোদ্ভূত ব্যক্তিদের কবরস্থান। বর্তমানে তিনজন খাদেম ও একজন সুপারিনটেনডেন্ট দ্বারা পরিচালিত হচ্ছে ইমামবাড়াটি। শিয়া সম্প্রদায়ের এই ইমামবাড়াটির প্রধান প্রবেশপথে রয়েছে দারুল কোরআন নামে একটি লাইব্রেরি। মূল ফটক শেষে পশ্চিম দিকে রয়েছে দারুল শেফা নামে একটি হাসপাতাল। শিয়া সম্প্রদায়ের মানুষদের সমাজসেবার অনন্য দৃষ্টান্ত হয়ে আছে এই হাসপাতাল। ১৭শ শতকে মোগল সম্রাট শাহজাহানের আমলে নির্মাণ করা হয় এই স্থাপনাটি। তবে ইমারতটির নির্মাণকাল নিয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে মতভেদ রয়েছে। ইমামবাড়াটির দেয়ালের শিলালিপি থেকে প্রাপ্ত তথ্য মতে, শাহ সুজার সুবেদারির সময় তার নৌ-সেনাপতি সৈয়দ মীর মুরাদ ১৬৪২ সালে ইমামবাড়াটি নির্মাণ করেন। প্রথমে তিনি একটি তাজিয়া কোনা নির্মাণ করেন। আবুল কালাম মোহাম্মদ যাকারিয়া তার ‘বাংলাদেশের প্রত্নসম্পদ’ বইয়ে ভবনের দেয়ালে লাগানো শিলালিপির কথা উল্লেখ করেছেন। প্রত্নতাত্ত্বিকরা পরীক্ষার পর দেখেছেন ওই শিলালিপিটিতে হোসনি দালানের নির্মাতা সৈয়দ মীর মুরাদের নাম উল্লেখ রয়েছে। ঐতিহাসিক এম হাসান দানীর মতেও, মীর মুরাদই এখানে প্রথম ছোট আকারের একটি ইমামবাড়া স্থাপন করেছিলেন। সৈয়দ মীর মুরাদ একদা স্বপ্নে ইমাম হোসেনকে ‘তাজিয়াখানা’ নির্মাণ করতে দেখে এই ইমারত নির্মাণে উৎসাহিত হন। তিনিই এই ইমারতের নাম রাখেন হোসনি দালান। ইমামবাড়াটি নিয়ে এমন লোককাহিনীও প্রচলিত রয়েছে। প্রথমে এটি ছোট্ট একটি তাজিয়া বা স্থাপনা ছিল। পরে এটি ভেঙে গেলে নায়েব-নাজিমরা নতুন করে নির্মাণ করেন। ১৮৩২ সালেও আদি ইমামবাড়া টিকে ছিল এমনটি নিজের বইয়ে উল্লেখ করেন ইতিহাসবিদ জেমস টেলর। এরপর ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসনামলে দুই দফায় ইমামবাড়ার সংস্কার হয়। ১৮৯৭ সালের ভূমিকম্পে ভবনটি প্রায় বিধ্বস্ত হয়। পরে খাজা আহসানউল্লাহ লক্ষাধিক টাকা ব্যয় করে তা পুনঃনির্মাণ ও সংস্কার করেন। ১৯৯৫-এ একবার এবং পরবর্তীতে ২০১১ তে আবার দক্ষিণের পুকুরটির সংস্কার করা হয়। ইরান সরকারের উদ্যাগে তাদের আর্থিক ও কারিগরি সহযোগিতায় ওই বছরই হোসনি দালানের ব্যাপক সংস্কার করা হয়। ইরানের স্থপতি ও শিল্পীরা দেশটির ধর্মীয় স্থাপনার বাহ্যিক রূপ ও নান্দনিকতা সংস্কার কাজে তুলে ধরেন। সংস্কারের আগে ভিতরে রং-বেরঙের নকশা করা কাচের মাধ্যমে যে সৌন্দর্য ফুটিয়ে তোলা হয়েছিল, তা পরিবর্তন করে বিভিন্ন আয়াত ও মুদ্রা লিখিত নীল রঙের টাইলস লাগানো হয়। একইভাবে এর পূর্বদিকের ফটকে এবং উত্তর দিকের চৌকোনা থামগুলোয় ইরান থেকে আমদানি করা টাইলসে সেই দেশের ধর্মীয় শিল্পকলা ক্যালিগ্রাফি ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। ইমারতটির প্যারাপেটে রয়েছে রঙিন পদ্ম-পাপড়ির নকশা। এর চার কোণের শীর্ষে রয়েছে চারটি ছত্রী। এখানকার জনৈক খাদেম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে জানান, মহররমের ১০ দিন পর থেকে দুই মাস ৮ দিন পর এখানে গাম-এ-হুসাইন বা হুসাইনের শোক পালন করা হয়। এই শোক পালন উপলক্ষে ইমারতের জারি-এ-মোবারক থেকে আলাম বা পাঞ্জা বের করা হয়। মহররমের ৪০ দিন পর জুলুস বা মিছিল বের করা হয় বলেও জানান এই খাদেম। এজিদ কর্তৃক ইমাম হুসাইনকে নির্মমভাবে শহীদ করার কারণে প্রতি বছরের ৯ রবিউল আউয়াল শোক, বিক্ষোভ, মাতমসহ নানা আয়োজনে এজিদের ওপর নালত বা অভিশাপ পাঠায় শিয়া সম্প্রদায়ের মানুষেরা। ভালোবাসা ও শ্রদ্ধায় শিয়া ভক্তদের হৃদয়ে আজও ইমাম হুসাইন (রা.) চিরজাগরূক হয়ে আছেন এই বিষয়টি লক্ষ্য করা গেছে হোসনি দালান পরিদর্শনে গিয়ে। দিনরাত ভক্তরা ভিড় জমান ইমামবাড়ায়। মহররমের ১ থেকে ১০ তারিখ হোসনি দালান ঢাকা শহরের মূল আকর্ষণে পরিণত হয়। শিয়া সম্প্রদায়ের লোকেরা এখানে সমবেত হয়ে ‘হায় হোসেন, হায় হোসেন’ বলে মাতম করতে থাকেন। আশুরার দিনে অর্থাৎ ১০ মহররমে এখান থেকে বিশাল তাজিয়া মিছিল বের করা হয়। মিছিলটি রাজধানীর প্রধান প্রধান সড়ক প্রদক্ষিণ করে প্রতীকীভাবে কারবালা নাম দেওয়া একটি স্থানে গিয়ে শেষ হয়। ২০১৫ সালের ২৩ অক্টোবর দিবাগত রাতে তাজিয়া মিছিলের প্রস্তুতির সময় হোসনি দালান এলাকায় বোমা হামলা হয়। এরপর থেকে ইমামবাড়াটিকে সিসিটিভির আওতায় আনা হয়।

সর্বশেষ খবর