মাদকদ্রব্য অপব্যবহার ও অবৈধ পাচারবিরোধী আন্তর্জাতিক দিবস আজ। দিবসটির এবারের প্রতিপাদ্য ‘শৃঙ্খল ভাঙার আহ্বান : সবার জন্য প্রতিরোধ, চিকিৎসা ও নিরাময়’। বাংলাদেশে নানা কর্মসূচির মাধ্যমে দিবসটি পালিত হচ্ছে। তবে মাদকের ভয়াবহ ছোবল থেকে বেরিয়ে আসতে পারেনি বাংলাদেশ। দেশে মাদকাসক্তির পাশাপাশি বড়ছে মাদক পাচার। জানা যায়, শুধু ভোক্তা নয়, মাদক পাচারের আন্তর্জাতিক ট্রানজিট হিসেবে এখনো ব্যবহার হচ্ছে বাংলাদেশ। বিমানবন্দর, স্থলবন্দর এবং সমুদ্রবন্দরের নানাবিধ দুর্বলতার সুযোগে অতীতের মতো আন্তর্জাতিক মাদক মাফিয়াদের চোখ এখনো বাংলাদেশে। ইয়াবা, আইস, কোকেন, গাঁজা, হেরোইন, ফেনসিডিলসহ হরেক রকমের মাদক নানা কৌশলে বাংলাদেশে নিয়ে এসে ফের অন্য দেশে পাচার করছে তারা। জাতিসংঘের ইউএনওডিসির একাধিক প্রতিবেদনে ট্রানজিট হিসেবে বাংলাদেশের নাম উঠে আসার পরও এ দুর্নাম ঘোচাতে কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণে এখনো অনেক পিছিয়ে সরকার। এ ছাড়া আফগানিস্তানের পপি এখন মিয়ানমারে চাষ শুরু হওয়ায় উদ্বেগ বেড়েছে মাদক নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থাগুলোর। গতকাল সচিবালয়ে অনুষ্ঠিত এক সভায় স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লে. জেনারেল (অব.) জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেছেন, ভৌগলিকভাবে গোল্ডেন ক্রিসেন্ট ও গোল্ডেন ট্রায়াঙ্গেল নামের দুটি সক্রিয় মাদক পাচারকারী বলয়ের মাঝখানে (বাংলাদেশের) অবস্থানের জন্য আমরা মাদক সমস্যা দ্বারা আক্রান্ত। আমাদের সীমান্তের উল্লেখযোগ্য অংশ দুর্গম। অনেক ক্ষেত্রেই সেখানে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা যথাযথ নজরদারি করতে পারে না। ভৌগলিক এ নাজুক পরিস্থিতিকে পুঁজি করে মাদক চোরাকারবারিরা আমাদের দেশকে মাদক পাচারের টার্গেট হিসেবে ব্যবহার করছে।
অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলছে, অধিকাংশ সীমান্তে এখনো সিসিটিভি, ড্রোন বা থার্মাল ইমেজিং সিস্টেম নেই। এ কারণ অনেকদিন ধরেই আন্তর্জাতিক মাদক মানচিত্রে ট্রানজিট হিসেবে বাংলাদেশের নাম উঠে আসছে। সীমান্তে প্রযুক্তিগত নজরদারি বাড়ানো, টহল জোরদার, বন্দর নিরাপত্তা আধুনিকীকরণ, মাদক কারবারিদের অর্থনৈতিক তথ্যভাণ্ডার গড়া এবং কূটনৈতিক উদ্যোগ- এমন সমন্বিত পরিকল্পনা ছাড়া মাদকের বিরুদ্ধে এ ‘নীরব যুদ্ধ’ জেতা কঠিন। এ বিষয়ে র্যাবের অতিরিক্ত মহাপরিচালক কর্নেল ইফতেখার আহমেদ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, মাদকের বিষয়ে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেয় র্যাব। গত পাঁচ মাসে আমরা কেবল ৪৫ লাখ ইয়াবা উদ্ধার করেছি। সীমান্তবর্তী এলাকার জলপথে আমরা কোস্টগার্ডের সহায়তা নিয়ে থাকি। র্যাবের সবগুলো ব্যাটালিয়নকে মাদকের বিষয়ে বিশেষ গোয়েন্দা তৎপরতা চালাতে নির্দেশনা দেওয়া আছে। মাদকের ব্যাপারে কোনো ছাড় নেই। সেনাবাহিনীর সহযোগিতায় গত ২২ এপ্রিল রাজশাহীর গোদাগাড়ীতে সাড়ে ৬ কেজি হেরোইন এবং নগদ ১৩ লাখ টাকাসহ তারেক হোসেন নামের শীর্ষ এক মাদক ব্যবসায়ীকে গ্রেপ্তার করে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর (ডিএনসি)। গোয়েন্দারা বলছেন, বাংলাদেশে হেরোইন এবং আইসের খুব একটা চাহিদা না থাকলেও দেশের অভ্যন্তর থেকে এসবের বড় বড় চালান উদ্ধার হচ্ছে বিভিন্ন সময়। এগুলো অবশ্যই বাংলাদেশকে ব্যবহার করে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পাচার হয়ে আসছে। গোয়েন্দা সূত্র বলছে, দেশের অভ্যন্তরেও শক্তিশালী মাদক সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছে। যারা আন্তর্জাতিক চক্রের অংশ। এরাই দেশের বিভিন্ন সংস্থার দুর্নীতিগ্রস্ত সদস্যদের ম্যানেজ করে দেশে মাদক নিয়ে আসছে। বিশেষ করে মিয়ানমার, আফগানিস্তান, ভারত, পাকিস্তান থেকে আসা মাদক মালয়েশিয়া, সৌদি আরব, থাইল্যান্ড, ইউরোপ এমনকি অস্ট্রেলিয়া পর্যন্ত যাচ্ছে। ডিএনসির পরিচালক (প্রশাসন) মো. মাসুদ হোসেন বলেন, আফগানিস্তানে আফিম নিষিদ্ধ হয়েছে। সেটি পুরোপুরি মিয়ানমারে শিফট হয়েছে। বাংলাদেশের সঙ্গে মিয়ানমারের সীমান্ত থাকার কারণে এসব ড্রাগস নানা কায়দায় দেশে ঢুকছে। তবে আমরা বসে নেই। মাঝেমাঝেই চালান আমাদের হাতে ধরা পড়ছে।
অপরাধ বিশেষজ্ঞ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ড. তৌহিদুল হক বলেন, মাদক প্রবেশ এবং পাচার ঠেকাতে আমাদের দুর্বলতাগুলো আগে চিহ্নিত করতে হবে। পরবর্তীতে এগুলো সমাধান এবং মনিটরিংয়ের বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে। তবে এ ক্ষেত্রে জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে সরকারের উচ্চ মহল থেকে।
যেভাবে ব্যবহার হচ্ছে ট্রানজিট : সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র জানায়, আফগানিস্তান ও পাকিস্তান থেকে হেরোইন-বেইজড পণ্য এখনো আসছে ভারত হয়ে সিলেট এবং যশোর সীমান্ত দিয়ে। পরে এসব মাদক চট্টগ্রাম ও মোংলা বন্দর হয়ে কন্টেইনারে লুকিয়ে পাচার হয় ইউরোপ, দুবাই ও শ্রীলঙ্কায়। এমনকি ল্যাটিন আমেরিকা থেকে আসা কিছু কোকেনবাহী কন্টেইনার প্রথমে বাংলাদেশে আসে। অবতরণ করে চট্টগ্রাম বা মোংলা বন্দরে। পরবর্তীতে কৌশলে ‘রি-এক্সপোর্ট’ দেখিয়ে তা ফের বিদেশে চালান হয়ে যায়। এতে সন্দেহ কম হয়। এ ছাড়া অনেক ক্ষেত্রে ডিপ্লোম্যাটিক ব্যাগ ও হাই-প্রোফাইল সুবিধার অপব্যবহার করে মাদকের বড় বড় চালান পাচার হয়ে থাকে। এ ক্ষেত্রে মাদক মাফিয়ারা রাষ্ট্রীয় পরিচয়ে সুবিধা নেওয়ার চেষ্টা করে। সূত্র মতে, ঢাকার অভিজাত এলাকা হয়ে মধ্যপ্রাচ্যে যায় ‘পার্টি ড্রাগস’। গুলশান, বনানী ও বারিধারার অভিজাত এলাকায় আগেই মজুদ করা হয় আইস, এলএসডি ও এমডিএমএ। পরবর্তীতে সুবিধামতো সময়ে এসব মাদক ‘পার্টি গিফট’ বা হ্যান্ড লাগেজে করে দুবাই, কাতার, বাহরাইন ও কুয়েতে পাচার করা হয়।
ছয়টি রুটে ঢুকছে মাদকের বড় অংশ : মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের (ডিএনসির) তথ্য বলছে, দেশের ২৯টি সীমান্তবর্তী জেলার ১৬২টি রুট দিয়ে দেশে দেদার প্রবেশ করছে মাদক। একাধিক গোয়েন্দা প্রতিবেদনে উঠে এসেছে ছয়টি বড় করিডর দিয়ে এখনো মাদকের বড় একটি অংশ দেশে ঢুকছে। প্রতিবেদন অনুযায়ী কক্সবাজার-টেকনাফ হয়ে ঢুকছে ইয়াবা ও আইস, বান্দরবান সীমান্ত দিয়ে হেরোইন, রাজশাহী-চাঁপাইনবাবগঞ্জ দিয়ে ফেনসিডিল এবং হেরোইন, সিলেট-মেঘালয় সীমান্ত দিয়ে ইয়াবা-গাঁজা-ফেনসিডিল, চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে লিকুইড কোকেন, মোংলা বন্দর হয়ে আসছে আন্তর্জাতিক সিনথেটিক ড্রাগস। এ রুটগুলোতে চোরাকারবারিরা আধুনিক প্রযুক্তি, স্যাটেলাইট ফোন এবং সীমান্তবর্তী গ্রামবাসীদের ব্যবহার করছে। অনেকে আবার আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দুর্নীতিগ্রস্ত সদস্যদের ‘মদদে’ও চালিয়ে যাচ্ছে এ ব্যবসা।
আন্তর্জাতিক মাদকবিরোধী দিবস আজ : মাদকদ্রব্য অপব্যবহার ও অবৈধ পাচারবিরোধী আন্তর্জাতিক দিবস আজ। দিবসটির এবারের প্রতিপাদ্য ‘শৃঙ্খল ভাঙার আহ্বান : সবার জন্য প্রতিরোধ, চিকিৎসা ও নিরাময়’। ১৯৮৭ সালে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের সভায় প্রতি বছরের ২৬ জুনকে আন্তর্জাতিক মাদকবিরোধী দিবস হিসেবে পালনের সিদ্ধান্ত হয়। এর মূল লক্ষ্য মানব সম্প্রদায়কে মাদকদ্রব্যের ক্ষতিকর দিক সম্পর্কে সচেতন করা। নানা কর্মসূচির মাধ্যমে দিবসটি পালিত হচ্ছে বাংলাদেশে।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর (ডিএনসি) দিবসটি উপলক্ষে রাজধানীর রমনা পার্কে মাদকবিরোধী র্যালি ও মানববন্ধন এবং ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে আলোচনা সভা ও পুরস্কার বিতরণীর আয়োজন করা হয়েছে।