জটিল সমীকরণে আটকে গেছে জুলাই জাতীয় সনদ স্বাক্ষর ও বাস্তবায়ন। বিষয়টির সঙ্গে জড়িয়ে গেছে জাতীয় নির্বাচন। রাষ্ট্র সংস্কার করা না হলে নির্বাচনে অংশ নেওয়া হবে না, এমন বার্তা দিয়েছে কয়েকটি রাজনৈতিক দল। বিপরীতে নির্বাচনের পর রাষ্ট্রীয় মূল সংস্কার করা হবে বলে অঙ্গীকার করেছে কয়েকটি দল। জাতীয় ঐকমত্য কমিশন এ ইস্যুতে অনানুষ্ঠানিক ও আনুষ্ঠানিক উপায়ে দলগুলোর শীর্ষনেতাদের সঙ্গে বৈঠকের পর বৈঠক করলেও সমাধান হয়নি। উল্টো বিভেদ আরও বেড়েছে। তাই অনেকটা চ্যালেঞ্জে পড়েছে অন্তর্বর্তী সরকারের নির্বাচনি রোডম্যাপ। শঙ্কা দেখা দিয়েছে ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন নিয়ে।
এ প্রসঙ্গে গতকাল এক অনুষ্ঠানে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেন, ‘আগামী ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় নির্বাচন না হলে বাংলাদেশে অভ্যন্তরীণ অস্থিতিশীলতা তৈরি হওয়ার পাশাপাশি জাতীয় নিরাপত্তাও বিঘ্নিত হবে। রাষ্ট্রের কাঠামোগত পরিবর্তনগুলোর ব্যাপারে যদি একমত না হওয়া যায়, তাহলে আমার শঙ্কা হচ্ছে, নির্বাচনের মাধ্যমে আমরা যে জায়গায় দাঁড়াব, তাতে মৌলিক কোনো হেরফের ঘটবে না।’
কিছু সংস্কারের বিষয়ে দলগুলো ঐকমত্য হলেও সংবিধান সংস্কার নিয়ে দেখা দিয়েছে বড় ধরনের মতপার্থক্য। শুরু থেকে বিষয়টি নিয়ে দলগুলো যে অবস্থানের কথা জানিয়েছে শেষ পর্যন্ত তারা একই অবস্থানে আছে। বিশেষ করে বিএনপি, জামায়াত ও এনসিপির মধ্যে বিষয়টি নিয়ে বিরোধ এখন তুঙ্গে। অন্যদিকে তাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছে সমমনা জোটের দলগুলো। কমিশনের পক্ষ থেকে একাধিক রাজনৈতিক দলের সঙ্গে অনানুষ্ঠানিকভাবে বৈঠকের ব্যবস্থা করে দিলেও তারা একমত হতে পারেননি। তাই শেষ পর্যন্ত চেষ্টার হাল ছেড়ে দিয়েছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। এখন তারা বিষয়টি ছেড়ে দিচ্ছে অন্তর্বর্তী সরকারের ওপর। জটিল সমীকরণের বিষয়টি জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সভাপতি ও অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে আনুষ্ঠানিকভাবে অবহিত করা হয়েছে। সরকারের পক্ষ থেকে এখন বিষয়টি সমাধানে পথ খোঁজা হচ্ছে।
সংবিধানসম্পর্কিত বিষয় ছাড়া অন্যান্য প্রস্তাব বাস্তবায়নে অধ্যাদেশ ও নির্বাহী আদেশ ব্যবহারে দলগুলো আংশিক সমঝোতায় পৌঁছালেও মূল বিতর্ক রয়ে গেছে সাংবিধানিক সংস্কার বাস্তবায়নের উপায় নিয়ে। বিএনপি সংসদকেন্দ্রিক সমাধানের ওপর জোর দিচ্ছে, জামায়াত চাইছে বিশেষ সাংবিধানিক আদেশ ও এনসিপি নতুন সংবিধানের দাবিতে গণপরিষদ গঠনের প্রস্তাব জানিয়েছে। বিশেষজ্ঞরা অধ্যাদেশ, নির্বাহী আদেশ, গণভোট ও বিশেষ সাংবিধানিক আদেশ- এই চারটি পদ্ধতিকে সম্ভাব্য সমাধান হিসেবে তুলে ধরলেও দলগুলো এখনো ঐকমত্যে আসতে পারেনি। আজ ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে ফের বৈঠকে বসবে দলগুলো। সংসদের বাইরে সংবিধান সংশোধনকে অবৈধ মনে করে বিএনপি। তারা সাংবিধানিক আদেশের ঘোর বিরোধী। জামায়াতে ইসলামী, এনসিপি, ইসলামী আন্দোলনসহ কয়েকটি দল সংবিধানের সংস্কার ছাড়া সনদে সইয়ে রাজি নয়।
বিএনপি সাংবিধানিক আদেশের মাধ্যমে সংবিধান সংশোধনের বিরোধী। দলটির অবস্থান হলো, নির্বাচিত সংসদ ছাড়া কারও সংবিধানের পরিবর্তন আনার ক্ষমতা নেই। যেসব সংস্কারের জন্য সংবিধানে পরিবর্তন প্রয়োজন নেই, সেগুলো অধ্যাদেশে বা নির্বাহী আদেশে নির্বাচনের আগে বাস্তবায়ন করতে পারবে সরকার। সংবিধানের ১০৬ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী সুপ্রিম কোর্টের মতামতে অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের মাধ্যমে সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা অক্ষুণ্ন থাকায় সাংবিধানিক আদেশ জারির ক্ষমতা নেই বর্তমান সরকারের। বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ বলেছেন, অধ্যাদেশ এবং নির্বাহী আদেশে সেই সংস্কার প্রস্তাবগুলো বাস্তবায়ন করা যাবে, যেগুলো সংবিধানকে স্পর্শ করে না। এ বিষয়ে লিখিত মতামত, মৌখিক মতামত সব সময় দেওয়া ছিল এবং অন্যান্য রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকেও একই রকম মতামত দেওয়া হয়েছে। প্রশ্ন আসছে, সংবিধান সংশোধনী-সংক্রান্ত ১৯টি মৌলিক বিষয় নির্ধারণ করা হয়েছে, এগুলো বাস্তবায়নের জন্য কী প্রক্রিয়া অনুসরণ করা যায়। তিনি বলেন, আশু বাস্তবায়নযোগ্য যে কোনো সুপারিশ, যেগুলো জুলাই সনদ অন্তর্ভুক্ত হয়েছে, সেগুলো বাস্তবায়নাধীন আছে এবং সম্পূর্ণ বাস্তবায়ন করতে পারে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার অধ্যাদেশ জারির মাধ্যমে, নির্বাহী আদেশের মধ্য দিয়ে অথবা অফিস আদেশসহ অন্যান্য বৈধ যে কোনো প্রক্রিয়ায়। যে প্রস্তাবগুলো আশু বাস্তবায়নযোগ্য নয়, অথচ বাস্তবায়ন করার সুযোগ আছে, সেই সুপারিশগুলো বাস্তবায়নের জন্য এই সরকার উদ্যোগ নিতে পারে, এমনকি সমাপ্তও করতে পারে, যদি সম্পন্ন না হয় পরবর্তী সরকার সেটা চালিয়ে যাবে, বাস্তবায়ন করবে।
জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির ডা. সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের বলেছেন, ‘ঐকমত্য কমিশন পাঁচটি বিকল্প দিলেও জামায়াতের সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব আছে। আশা করি, আলোচনার মাধ্যমে কাছাকাছি আসতে পারব। সাংবিধানিক আদেশ জারি না হলে গণভোটকে বিকল্প হিসেবে রেখেছি।’ জামায়াতের আইনজীবী শিশির মনির বলেছেন, ‘বিশেষ সাংবিধানিক আদেশ জারির মাধ্যমে সনদ বাস্তবায়নের কথা বলেছি। সংস্কারের যেসব সিদ্ধান্ত সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক, সেগুলো সংবিধানের ওপরে প্রাধান্য দেওয়া উচিত।’ গণ অভ্যুত্থানের পর সাংবিধানিক ব্যবস্থা অনুসরণের সুযোগ নেই উল্লেখ করে শিশির মনির বলেন, সংবিধানের ১৫৩টি অনুচ্ছেদের মধ্যে ৫৭টি ইতিমধ্যে অকার্যকর। এজন্য সাংবিধানিক আদেশ প্রয়োজন।
জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) যুগ্ম আহ্বায়ক জাভেদ রাসিন বলেন, সংবিধানের মৌলিক যে বিষয়গুলোতে সংশোধনী আনতে হবে সেগুলোর সংশোধনী আনলে আর সংবিধানের চরিত্রই পাল্টে যাবে। যে কোনো সংশোধনীর মাধ্যমে আনলেও কোর্টে চ্যালেঞ্জের সুযোগ থেকে যায়। সংবিধান সভা বা গণপরিষদই উত্তম ও গণতান্ত্রিক উপায়। যার মধ্য দিয়ে ভবিষ্যতে যে কোনো বিতর্ক এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব হবে।
অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেন, ‘সংবিধান এখন যে পরিস্থিতিতে আছে, আমরা সংবিধানের মধ্যেই আছি। এই অর্থে যে অনুচ্ছেদ ১০৬ দিয়েই এই সরকার গঠিত হয়েছে। এটা কমিশনের বক্তব্য নয়, আমার ব্যক্তিগত মত।’
ঐকমত্য কমিশনের বৈঠকে আজ, যোগ দেবেন প্রধান উপদেষ্টা : রাষ্ট্র সংস্কারে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের ধারাবাহিক বৈঠকের আজ (রবিবার) শেষ দিনে যোগ দেবেন কমিশনের সভাপতি ও অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। বিকালে রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে বৈঠকটি অনুষ্ঠিত হবে। এতে অংশ নেবেন ৩০টি রাজনৈতিক দলের নেতারা।
কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, আজ বিকাল ৩টায় প্রধান উপদেষ্টা কমিশনের বৈঠকে যোগ দেবেন। তিনি কিছুক্ষণ থেকে পরে চলে যাবেন। জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা গতকাল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে জানান, গতকাল রাতে হঠাৎ করেই প্রধান উপদেষ্টার যোগদানের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে চলমান সংলাপে এটাই হতে যাচ্ছে প্রধান উপদেষ্টার প্রথম বৈঠক।
এদিকে গতকাল রাতে (এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত) জুলাই সনদ স্বাক্ষরের জন্য বিএনপিসহ ১৫টি রাজনৈতিক দলের নেতারা দুজন করে প্রতিনিধির নাম পাঠিয়েছে বলে জানিয়েছে কমিশন। বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ও দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিনের নাম দেওয়া হয়েছে। বিকাল ৫টা পর্যন্ত নির্ধারিত সময় দেওয়া হলেও রাত পর্যন্ত দলগুলো তাদের নাম পাঠিয়েছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।